×

সাহিত্য

গণআন্দোলন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুলাই ২০২১, ০৯:০৩ এএম

আগরতলা মামলা শুরু হওয়ার পর থেকেই পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত হতে থাকে। ১৯৬৮ সালের জুন মাস থেকে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত আট মাস ধরে এ মামলার শুনানি ও জেরার কাজ চলেছিল। এ সকল শুনানির বিবরণ প্রত্যেক দিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ওই বিবরণী পাঠ করে বাংলার মানুষ জানতে পারল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগণ পূর্ব বাংলাকে কী রকম পাশবিকভাবে অত্যাচার, শাসন ও শোষণ করছিল। তারা আরো বুঝতে পারল যে পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দরুণই শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা মামলায় মিথ্যাভাবে জড়িত করা হয়েছে।

১৯৬৬ সালের ৭ জুনের গণআন্দোলনের পর যখন আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী কারারুদ্ধ হন তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক কার্যক্রমে কিছুটা স্থবিরতা দেখা দিয়েছিল। ১৯৬৮ সালের শেষ ভাগেও আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতারা জেলে বন্দি ছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতারা কোনো তৎপরতার প্রমাণ দিতে পারেননি।

কিন্তু ছাত্র-যুব সমাজ ও শ্রমিক শ্রেণি এ অবস্থায় ১৯৬৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় এক অভ‚তপূর্ব গণজাগরণের সৃষ্টি করেছিল। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ, বিশেষত ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (দুই অংশ) এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) এ গণআন্দোলন সৃষ্টিতে ঐতিহাসিক নেতৃত্ব দেয়।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ : সারা পূর্ব বাংলায় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। পূর্ব বাংলার মূল ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের দুই অংশের নেতারা এবং ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ছাত্র সংসদের

সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুুরী এবং অন্যান্য কয়েকজন ছাত্রনেতা এ কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন। এ সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১-দফার যে দাবিনামা ও প্রচারপত্র প্রকাশিত হয়েছিল তাতে ছাত্রলীগ এবং দুই ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা এবং ডাকসুর সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষর ছিল। তোফায়েল আহমেদ এবং সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিকের নেতৃত্বে ১১-দফা আন্দোলন দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায়।

ছাত্র সমাজ প্রদত্ত ১১-দফা যে জনগণের মধ্যে সমর্থন লাভ করেছিল তার কারণ ওই দাবির মধ্যে বাংলাদেশের সামাজিক শ্রেণি, পেশা ও জনগণের দাবি সন্নিবেশিত হয়েছিল। ১১ দফার তিন নম্বর দাবিতে নামোল্লেখ ছাড়াই ছয়টি উপধারায় ৬-দফার দাবিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এ কারণে ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত ১১-দফা দাবির আন্দোলনে ১৯৬৯ সালের প্রথম ভাগে বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। ১১ দফা আন্দোলনের সাফল্যের কারণ বুঝতে হলে ওই দফাগুলোর অন্তনির্হিত তাৎপর্য বুঝতে হবে।

১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারিতে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি এবং ছাত্র সংগ্রাম কমিটির কর্মসূচি অনুসারে এ আন্দোলনের শুরু হয়। ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট জঙ্গিরূপ ধারণ করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ধর্মঘটে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। বিশ^বিদ্যালয় এলাকায় ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। ঢাকা শহরের অন্যান্য স্থানেও পুলিশ ছাত্র মিছিলের ওপর লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। বিকালে আধা সামরিক ইপিআর বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো ছাত্রাবাসে প্রবেশ করে ছাত্রদের প্রহার করে। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। পুলিশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাসভবনেও হামলা চালায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ ছাত্রদের ওপর পুলিশ ও ইপিআর বাহিনীর হামলার তীব্র নিন্দা করে। ঢাকার বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের কর্মকর্তারা ছাত্রদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের নিন্দা করেন। ১১ দফা দাবির সমর্থনে ২০ জানুয়ারি ’৬৯ সারা প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করেন।

২০ জানুয়ারি পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুসারে ঢাকা ও সারা পূর্ব বাংলায় ছাত্র ধর্মঘট হয়। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র মিছিল বের করা হয়। মিছিলে যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা আগে থেকেই সমবেত। পুলিশ ও ইপিআর বাধা দেয়ায় মিছিলটি কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন রাজপথ পরিক্রম করে। এমনি একটি মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন একজন পুলিশ অফিসারের পিস্তলের গুলিতে ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান মৃত্যুবরণ করেন।

আসাদুজ্জামানের মৃত্যুতে ছাত্র ও জনগণের মধ্যে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। ওই দিন দুপুরেই মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সেখান থেকে এক বিশাল শোক মিছিল বের করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আসাদুজ্জামানের স্মরণে সারাদেশে তিন দিনব্যাপী শোক পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২১ জানুয়ারি ঢাকা শহরে সাধারণ হরতাল পালিত হয়। ২২ জানুয়ারি প্রদেশব্যাপী মিছিল ও প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মশাল মিছিল বের করা হয়। ২৪ জানুয়ারি হরতালের ডাক দেয়া হয়।

আগামীকাল প্রকাশিত হবে ‘আইয়ুবের আগমন’ ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’- বইটি পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রকাশনে (ভোরের কাগজ কার্যালয়, ৭০ শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা)। এছাড়া সংগ্রহ করা যাবে bhorerkagojprokashan.com থেকেও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App