×

জাতীয়

বিস্ফোরণের উৎস নিয়ে ধূম্রজাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২১, ০৯:০২ এএম

বিস্ফোরণের উৎস নিয়ে ধূম্রজাল

রাজধানীর মগবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় নিহত ‘আজমেরী গ্লোরী’ বাসের মালিক-চালক আবুল কাসেম মোল্লার মরদেহ নিতে এসে সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেয়ে মীম। ছবি: ভোরের কাগজ

রাজধানীর মগবাজারে তিন তলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনার প্রকৃত কারণ কী- এ নিয়ে ধূম্রজাল কাটছে না। যদিও প্রাথমিকভাবে গ্যাস লিকেজ থেকেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছে দমকল বাহিনী ও পুলিশ। তবে নাশকতাসহ অন্য বিষয়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রকৃত কারণ জানতে পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হবে।

এদিকে বিস্ফোরক পরিদপ্তর বলছে এত বড় বিস্ফোরণের কারণ কী, তা নিয়ে তারাও দুশ্চিন্তায় রয়েছে। শুধু গ্যাস লিকেজ বা সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এত ক্ষয়ক্ষতি হয় না। এর পেছনে আরো কোনো কারণ থাকতে পারে কিনা- তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গতকাল সোমবারও বিধ্বস্ত ভবনের নিচতলায় হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অন্যদিকে প্রায় ধসে যাওয়া ভবনটিতে অবস্থিত শর্মা হাউজে গ্যাস সিলিন্ডারে রান্নার কাজ চলত বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। কিন্তু এ সিলিন্ডার বসানোর বিষয়ে তাদের অনুমোদন ছিল কিনা তা জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

তবে স্থানীয় প্রতিনিধি জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তার সংশয় রয়েছে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বিস্ফোরণে ধসে যাওয়া ভবনটি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী। এটি বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ। এদিকে বিস্ফোরণে নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনায় একটি মামলা দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

ঘটনাস্থলে গিয়ে গতকাল সোমবার দেখা যায়, বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে সিআইডির ফরেনসিক ও ডিএমপির সোয়াট ইউনিটের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট আলামত সংগ্রহ করছে। ভবনটির নিচতলায় গ্র্যান্ড কনফেকশনারি, তার পাশেই শর্মা হাউজ, বেঙ্গল মিট ও গুরমিত বুচারের দোকান। দোতলায় সিঙ্গার ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন ও এ ব্র্যান্ডের অন্যান্য পণ্যের গুদাম। বিস্ফোরণে ভবনটির গুদামের পণ্য বাইরে দেখা যাচ্ছে। ভবনটি কাত হয়ে বাইরের দিকে ঝুকে আছে। আর বেঙ্গল মিটের সামনে একটি নীল রংয়ের জেনারেটর অক্ষত অবস্থায় দেখা যায়। তাই জেনারেটর বিস্ফোরণ থেকে এ ঘটনা ঘটেনি বলে ধারণা করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

মগবাজারের বিস্ফোরণস্থল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার আবুল বাশার গতকাল সোমবার ভোরের কাগজকে বলেন, খাবার দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার বসাতে অনুমতি নিতে হয়।

তবে তারা নিয়েছিল কিনা সে বিষয়ে সংশয় আছে। তবে নিশ্চিত হতে কাজ চলছে। রবিবারের ঘটনায় মেয়রের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডসহ উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রতি ওয়ার্ডে খাবার দোকানের গ্যাস সিলিন্ডারগুলো কি অবস্থায় আছে আমরা দেখব। আমরা ওয়ার্ডভিত্তিক টিম করছি। যারা অনুমতি ছাড়া এমন কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা কাজ করবে।

এদিকে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের ধারণা- বিস্ফোরণের ঘটনাটি পাইপলাইনের লিকেজ নয়, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা হতে পারে। দুর্ঘটনা তদন্তে এরই মধ্যে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিতাস গ্যাস কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজারকে (ভিজিল্যান্স) প্রধান করে রবিবার রাতে তিন সদস্যের এই কমিটি গঠন করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী ইকবাল মো. নুরুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিকভাবে সেখানে যে গ্যাসের লাইন পেয়েছি, সেটি খুবই ছোট। ৩-৪ ইঞ্চি ডায়ামিটারের পাইপলাইন, যেটার চাপ মাত্র ২ পিএসআই। এতে খুব বেশি গ্যাস থাকার কথা নয়। ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি, নিচতলায় দুইটি এলপিজি সিলিন্ডার দিয়ে রান্নার কাজ হতো। আমরা ধারণা করছি, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ফলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তবে বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।

অন্যদিকে গতকাল সকালেই ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন পুলিশপ্রধান ড. বেনজীর আহমেদ। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, গত রবিবার সন্ধ্যায় মগবাজারে একটি মারাত্মক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানি হয়েছে। পথযাত্রী, দোকানের ক্রেতা-কর্মচারী ও শিশুসহ ৬ জনকে হারিয়েছি। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। এ বছর যদি খেয়াল করেন, অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে, শনির আখড়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি করেছে। তবে ফায়ার সার্ভিস ও আমাদের ফায়ার এক্সপ্লোরেশন বিভাগ মিলে পুলিশের পক্ষ থেকেও একটা তদন্ত কমিটি করা হবে। আমরা একসঙ্গে কাজ করব। আমরা চাই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে।

এটা কোনো নাশকতা কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশপ্রধান বলেন, বড় ধরনের একটা শকড ওয়েভ তৈরি হয়েছিল, এখন পর্যন্ত এই বিস্ফোরণ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে না। গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হতে পারে। এখনো ভবনের ভেতর থেকে গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। এটা একমুখী ধ্বংসযজ্ঞ। নাশকতা বা বিস্ফোরণ হলে চতুর্মুখী বিস্ফোরণ হতো। আমরা চারদিকে কাচের টুকরো দেখছি। ভেতরে গ্যাসের অস্তিত্ব ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করছে। এখন পর্যন্ত শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখনো মনে হচ্ছে কোনো নাশকতার ঘটনা এটি নয়।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, আমরা আগে তদন্ত করি বিস্ফোরণটা কেন হলো। তারপর দেখব, পেছনে কোনো কারণ আছে কিনা। আমাদের ও ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞরা দেখছেন। অনেক বিষয় আছে। সেসব দেখা হচ্ছে। বাংলামোটর থেকে মগবাজার আসার পথের উড়াল সড়কের দ্বিতল অংশটি আপাতত বন্ধ রয়েছে। পর্যবেক্ষণ শেষে বিস্ফোরণে ক্ষতি না হলে তা খুলে দেয়া হবে।

এদিকে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের অ্যানার্জি এন্ড মিনারেল রিসোর্সেস বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, হাইড্রোকার্বন হলো প্রাকৃতিক গ্যাসের একটি উপাদান। তবে শুধু গ্যাস থেকে এত বড় বিস্ফোরণের ঘটনা অস্বাভাবিক। শুধু গ্যাস লিকেজ কিংবা সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এতো ক্ষয়ক্ষতি হয় না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে এটা আলাদা। এত বড় বিস্ফোরণের কারণ কী সেটা নিয়ে আমরাও দুশ্চিন্তায় আছি। এর পেছনে আরো কোনো কারণ থাকতে পারে। তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, গত রবিবার বিস্ফোরণের রাতেই আমাদের তিনজন পরিদর্শক ঘটনাস্থল দেখে যান। আজও (গতকাল) আমরা পরিদর্শন করেছি। সেখানে গ্যাস ডিটেক্টরের মাধ্যমে পরীক্ষা করে ঘটনাস্থলে হাইড্রোকার্বনের অস্তিত্ব মিলেছে। যা প্রাকৃতিক গ্যাস অর্থাৎ সরকারিভাবে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। বিস্ফোরণের তীব্রতায় সড়কে থাকা যানবাহনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেকে অনেক ধরনের ধারণা ও মত পোষণ করছেন। আমরা অধিকতর তদন্ত সাপেক্ষে আরো সুস্পষ্ট কারণ বলতে পারব।

এদিকে গতকাল ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খানের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি বলেন, গ্যাস থেকেও এ ধরনের ব্যাপক বিস্ফোরণ সম্ভব। ঘটনাস্থলে আমরা প্রায় ৯ শতাংশের মতো হাইড্রোকার্বনের উপস্থিতি দেখেছি। আর এখানে বোমা জাতীয় কিছু থাকলে আরো শক্তিশালী বিস্ফোরণ হতে পারত। সেফটি ম্যানেজমেন্ট ফাউন্ডেশনের এ উপদেষ্টা এক প্রশ্নের জবাবে আরো বলেন, সঠিক নজরদারির কোনো বালাই নেই এখানে। আমাদের সেফটি সিকিউরিটি সিস্টেম উদ্বেগজনক। সঠিক নজরদারি ও ব্যবস্থাপনা না থাকলে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। যা আমাদের জন্য অ্যালার্মিং। নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই।

ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটির সামনে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন এন্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল জিল্লুর রহমান গতকাল বলেন, ভবনটি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী। মেরামত করেও ব্যবহার করা যাবে না। কারণ ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণ ঘটেছে। এর ওপরে আরো দুটি তলা রয়েছে। এটি বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোনো সময় ভবনটি ভেঙে পড়ে যেতে পারে। ভবনের মালিককে বিষয়টি অবগত করা হবে। ভবনটি ভেঙে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে করা ৫ সদস্যের কমিটি তদন্ত শুরু করেছে। আজ (গতকাল) তদন্তের প্রথম দিন। কী কারণে এই ঘটনাটি ঘটেছে তা তদন্ত অগ্রসর হলে বলা যাবে। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ভবন ও দোকান ব্যবহারকারীদের কথা আমরা শুনব। পরবর্তীতে একটি প্যাটার্ন পাওয়া যাবে। কোনো গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে দমকল বাহিনীর এ কর্মকর্তা বলেন, নারায়ণগঞ্জে মসজিদে যে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল, সেটিও এখানকার সমপর্যায়ের উপাদান থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। নারায়ণগঞ্জের ঘটনা ও মগবাজারের ঘটনার আলামতের সঙ্গে মিল রয়েছে। আমরা মগবাজারের ঘটনাটিও তেমন অনুমান করছি।

তিনি বলেন, আমরা তদন্তের একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। ঘটনাস্থল থেকে বিচ্ছিন্নভাবে তথ্য ও আলামত সংগ্রহ করছি। এই তথ্যগুলো একত্রিত করে পর্যালোচনার মাধ্যমে আমরা একটি সিদ্ধান্তে যেত পারব।

গত রবিবারের বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত এক শিশুসহ ৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিকের মতো। শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট ও ঢাকা মেডিকেলসহ রাজধানীর কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন এ ঘটনায় আহতরা। এ বিষয়ে রমনা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার (এসি) বায়েজিদুর রহমান গতকাল ভোরের কাগজকে বলেন, এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের হবে। এ বিষয়ে কাজ চলছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App