ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে পাকিস্তানি ব্যাংক
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২১, ১০:৫৮ এএম
ন্যাশনাল ব্যাংক পাকিস্তান।
একে একে বন্ধ হচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক পাকিস্তানের শাখা।
অনিয়ম, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, ধারাবাহিক লোকসান ও বড় ধরনের ঋণ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে যাচ্ছে বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক পাকিস্তান (এনবিপি)। একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের শাখাগুলো। সব মিলিয়ে চারটি শাখার মধ্যে সম্প্রতি সিলেট শাখা বন্ধ করার নির্দেশ এসেছে করাচি থেকে। এ মুহূর্তে বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে রয়েছে ব্যাংকটি। গত বছরের শেষে এনবিপির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৮ কোটি টাকা, যা তার মোট ঋণের ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের শতভাগই মন্দঋণে রূপান্তরিত হয়েছে, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে।
‘ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান’ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় মালিকানার বাণিজ্যিক ব্যাংক। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ব্যাংকটির সব শাখা অধিগ্রহণ করে সোনালী ব্যাংক। পরে বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে নতুন করে কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন পায়। ২০০৮ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে। ২০১০ সালের পর ক্রমান্বয়ে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এনবিপির ৭৬ জন কর্মচারী নিয়ে দেশে চারটি শাখা রয়েছে, তবে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণ কার্যক্রম বেশ কয়েক বছর ধরে স্থবির রয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংক পাকিস্তান এ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করেছে ১ হাজার ৫০২ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শেষে এনবিপির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৮ কোটি টাকা, যা তার মোট ঋণের ৯৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের শতভাগই মন্দঋণে রূপান্তরিত হয়েছে, যা আদায়ের সম্ভাবনা খুবই কম। এ বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশনের ঘাটতি রয়েছে প্রায় সাড়ে ৪শ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণে তাগিদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, প্রভিশন সংরক্ষণ করতে না পারলে ব্যাংকটি তলানিতে পড়ে যাবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ন্যাশনাল ব্যাংক পাকিস্তানের গুলশানের আঞ্চলিক প্রধান শাখায় চিঠি পাঠানো হয়।
জানা গেছে, দুর্বল ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এনবিপি) কার্যক্রম। বড় কিছু গ্রাহক মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় ও নতুন গ্রাহক ধরতে না পারায় বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে। বাংলাদেশের ৬০ ব্যাংকের মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের অবস্থান সবচেয়ে তলানিতে। বিদেশি ৯ ব্যাংকের মধ্যেও ব্যাংকটির অবস্থান সবচেয়ে নাজুক। ঢাকা, গুলশান, চট্টগ্রাম ও সিলেট শাখার মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সম্প্রতি ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় করাচি থেকে বাংলাদেশের সিলেট শাখা গুটিয়ে ফেলার নির্দেশ এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে লোকসানে চলা এনবিপি প্রাথমিকভাবে শুধু সিলেট শাখা বন্ধের আবেদন করেছে। পর্যায়ক্রমে অন্য শাখা বন্ধের আবেদন করলে তা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের মধ্যে রয়েছে ইব্রাহিম টেক্সটাইল, কটন গ্রুপ, কোবা গ্রুপ, ওয়ার্ল্ড টেল বিডি, ডিজি নিটিং কোম্পানি, আলেয়া সোয়েটার এবং সারা গ্রুপ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকটির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই ঋণ আমাদের পক্ষে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে, কারণ পাকিস্তানি ব্যাংক হওয়ার কারণে তারা এটা ফেরত দিতে চান না। এজন্যই খেলাপিদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধারে স্বচ্ছ অগ্রগতির অভাবে ব্যাংক বছরের পর বছর লোকসানে থাকে।’ এ প্রতিবেদক ব্যাংকের মতিঝিল এবং গুলশান শাখায় গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও কোনো গ্রাহকের দেখা পাননি। অসল সময় পার করছিলেন কর্মকর্তারা।
পাকিস্তানি ব্যাংকের বাংলাদেশের কার্যক্রমের প্রধান নির্বাহী মো. কামরুজ্জামান বলেন, গত বছরের থেকে ঋণ বিতরণ স্থগিত করা হয়েছে। আমরা এখন খেলাপিদের কাছ থেকে টাকা পুনরুদ্ধারের ওপর বেশি জোর দিচ্ছি। আমরা মূলধন উদ্ধারের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।
অর্থ পুনরুদ্ধারের জন্য ১০৪ খেলাপির বিরুদ্ধে ব্যাংক মোট ১৪৩টি মামলা করেছে বলে জানান এনবিপির বাংলাদেশি প্রধান কামরুজ্জামান। ২০১৫ সাল থেকে এনবিপি খেলাপিদের কাছ থেকে মোট ১৯৩ দশমিক ৯৯ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে বলেও তিনি জানান। বিষয়টি পুরো ব্যাংকিং খাতের ভাবমূর্তি কলুষিত করছে- মন্তব্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, যদিও এটি একটি বিদেশি ব্যাংক, তবুও আমানতকারীদের জন্য এটি খারাপ সংবাদ যে, কোনো ব্যাংক বছরের পর বছর লোকসান করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
গত বছর স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এসবিপি) সুপারভিশন এন্ড এনফোর্সমেন্ট ডিপার্টমেন্ট বলেছে, বাংলাদেশে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি) লোকসান দিয়েছে ১৮৫০ কোটি রুপি। বাংলাদেশি টাকায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এ অর্থ লোকসান হয়েছে, না কি দুর্নীতি হয়েছে তা নিয়ে তদন্ত করছে আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান কেপিএমজি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র বলছে, মূলত ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশ শাখায় সমস্যা শুরু হয় খেলাপি ঋণ নিয়ে। সেই সময়ে ১৯টি অভিযোগ প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
জানা গেছে, ২০০৩ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে এনবিপির বাংলাদেশ শাখা প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়াই সন্দেহজনক বেশ কিছু কোম্পানিকে ঋণ দেয়। বর্তমানে আর্থিক খাতের শীর্ষে থাকা বেশ কিছু কর্মকর্তা ওই সময় এনবিপির এই কার্যক্রমের দায়িত্বে ছিলেন। সূত্র জানায়, সেই সময়ের ঋণ শাখা এবং বিদেশি কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা প্রধান কর্মকর্তারা এবার তদন্তের আওতায় এসেছেন। সেই সময়ে প্রয়োজনীয় জামানত ছাড়াই যে ঋণ দেয়া হয়েছে, তাতে ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা কিংবা তারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন কিনা, এ বিষয়টি তদন্ত করছে।
সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ বছর ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের (এনবিপি) বাংলাদেশ শাখায় বড় অঙ্কের লোকসানের জন্য ৬১ কর্মকর্তাকে দায়ী করে রিপোর্ট দেয় পাকিস্তানের একটি পার্লামেন্টারি প্যানেল। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এনবিপির বাংলাদেশ শাখায় লোকসানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ব্যাংকের ৬১ জন কর্মকর্তা। যারা শুধু বাংলাদেশ শাখায় নয়, আঞ্চলিক অফিস বাহরাইন এবং প্রধান কার্যালয় করাচিতেও ছিল। এদিকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের প্রাথমিক তথ্যেও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণেই ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। পরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ডিসেম্বরের মধ্যে এনবিপিকে একটি কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। এ বিষয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক পাকিস্তানের প্রধান অর্থ ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ খবিরুল হক খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। ব্যাংকটির গুলশান শাখা ও মতিঝিল শাখায় ফোন দিলেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত পাকিস্তানজুড়ে ব্যাংকটির ১ হাজার ৫১১টি শাখা রয়েছে, যার মূল্যমান প্রায় ২০ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাকিস্তান বাদে বিশে^র ২১টি দেশে শাখা রয়েছে এনবিপির।