×

জাতীয়

ইসি মন্ত্রণালয় টানাপড়েন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২১, ০৮:৩০ এএম

জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন (এনআইডি) কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে শুরু হয়েছে টানাপড়েন। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি পত্র দিয়ে এনআইডি কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে দেয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। এদিকে সরকারের এ সিদ্ধান্ত মানতে নারাজ ইসি।

বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এনআইডি তৈরির কাজ ইসির নয়, তারা ভোটার তালিকা তৈরি করবে। ইসির উচিত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া। তবে পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে গতকাল প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ১২ বছর ধরে এনআইডি কার্যক্রম ইসি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে আসছে। এ কাজের ধারাবাহিকতা, প্রযুক্তি এবং বিদ্যমান জনবল কীভাবে কোথায় থাকবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না জানিয়ে ইসির হাত থেকে এনআইডি তৈরির দায়িত্ব অন্যত্র ন্যস্ত হতে পারে না।

সিইসি বলেছেন, এনআইডি হস্তান্তরের আগে আমাদের সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলোচনা হতে হবে। এটা তো চেয়ার-টেবিল নয় যে তুলে পাঠিয়ে দিলাম। সুতরাং চিঠি দিলেই হবে না। আমাদের সঙ্গে বসে আলোচনা করে আমাদের যুক্তি শুনতে হবে। এসব জনবল ও প্রযুক্তি কীভাবে কোথায় কাজ করবে তা স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এনআইডি হস্তান্তর করা যাবে না। এটা জটিল কাজ। আমরা মনে করি, এনআইডি ইসির কাছে থাকা উচিত। এ বিষয়ে তিনি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ইসি এবং স্বরাষ্ট্রকে নিয়ে বৈঠক করার আহ্বান জানান।

এদিকে এনআইডি কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে দেয়ার বিষয়ে গত ১৮ মে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক চিঠি নির্বাচন কমিশনে পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তারপরই শুরু হয় টানাপড়েন। তবে এ বিষয়ে ইসির সার্ভিসেস এসোশিয়েশন দুই দুই বার সিইসি কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে দেখা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ চিঠির প্রতিবাদ জানান।

অন্যদিকে সরকার চাইলেও তা সাংবিধানিক সংস্থার অধীনেই (ইসিতে) রাখার পক্ষপাতি ইসি। আগের মতোই ইসির অধীনে তা বহাল রাখার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে কিছুদিন আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠায় তারা, যাতে ইসিতে রাখার যুক্তি তুলে ধরা হয়। সে চিঠির পরেও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত ২০ জুন ইসি সচিবকে এনআইডি কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দেয়ার বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দিয়ে চিঠি পাঠায়।

সিইসি বলেন, মন্ত্রিপরিষদ আমাদের কাছে উচ্চপর্যায়। সেখান থেকে আমরা চিঠি পেয়েছি। তাদের আমরা উত্তর দিয়েছি। আমরা এই পর্যায়ে আছি। তারা যদি এ বিষয়ে আমাদের কাছে মতামত নেয় তাহলে আনুষ্ঠানিকভাবে বসে আমাদের বক্তব্য তুলে ধরব। কীভাবে নেবে আলোচনা করতে হবে। এরপর সরকার কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেবে না নেবে এটা তো পরের কথা।

এ বিষয়ে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, এনআইডি নিয়ে যেসব কথা হচ্ছে তা অবান্তর। আমরা জেনেবুঝেই এনআইডি সেবাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনছি। মন্ত্রণালয়ের অধীনে এলে এনআইডি সেবা নিয়ে কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি হবে না। বরং এনআইডি সেবা এখন যথাস্থানে আসছে।

তিনি বলেন, ইসির কাজ ভোটার তালিকা তৈরি করা। নাগরিকদের ডাটাবেইজ এই এনআইডি বিশ্বের অধিকাংশ দেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ই পরিচালনা করে। সুষ্ঠুভাবে এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শও নেয়া হয়েছে।

এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনায় সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হুসাইন বলেন, কেন কী সুবিধার জন্য এনআইডি এতদিন ইসির হাতে ছিল তা কোনো আলোচনা না করে কেনই বা নেবে? এ বিষয়ে ইসির সঙ্গে আগে আলোচনা করতে হবে। এটা তো জোর করে নেবার মতোই হচ্ছে। এনআইডির কাজ শুরু করেছে ইসি, তারা এটাকে দাঁড় করিয়ে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা এবং পরে বিশ্বব্যাংকসহ বিদেশি সহায়তায় এনআইডি কার্যক্রম শুরু করে। তাতে তারা এতদিন কাজ করে দক্ষতা দেখিয়েছে।

তিনি বলেন, এনআইডির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একবার ভোটারের কাছে যাবে, আবার ভোটার তালিকা করার জন্য ইসির কর্মকর্তারা ভোটারদের কাছে যাবে। এতে জটিলতা বাড়বে। তাছাড়া দেশের এত কোটি মানুষে ইসিকে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য গোপন তথ্য সংরক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই তথ্য গোপনের কী গ্যারান্টি আছে? এটা ইসির হাতেই থাকা উচিত।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আসলে সব দেশেই এনআইডির কার্যক্রম পরিচালনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতেই থাকে। আমাদের দেশে ভিন্ন পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালে এটি ইসির হাতে গেছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তাদের বিশ্বাস সযোগ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা, অনিয়ম-দুনীতি নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। এনআইডি নিয়ে দুর্নীতি বাড়বে কিনা এ নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ইসির হাতে এনআইডি রাখার যেমন যুক্তি আছে, একইভাবে এনআইডি নিয়ে ইসির অনিয়মে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার ভুয়া এনআইডি কার্ড তারা করেছে, যাতে ইসির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা জড়িত।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, নির্বাচন কমিশনার সেনাবাহিনীর সহায়তার একটা সুন্দর এনআইডি সিস্টেম বা ডাটাবেইজ চালু করেছে। এটা যদি স্বরাষ্ট্রে চলে যায় তাহলে সমস্যার সৃষ্টি হবে, খরচও বেড়ে যাবে। তাছাড়া ইসি এটা করতে গিয়ে কোনো বড় ধরনের ভুল করেনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ফের ডাটা বেইজ তৈরি করতে হবে। তাতে ভোটারদের ভোগান্তি ও খরচ বাড়বে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে ভোটার আইডি কার্ড করে নির্বাচন কমিশন। আবার ভারতে কেন্দ্রীয় সরকার আধার কার্ডের কাজ করছে। নেপালে নির্বাচন কমিশন এনআইডি বা ভোটার লিস্ট করে, শ্রীলঙ্কায় নির্বাচন কমিশন স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে এনআইডি বা ভোটার কার্ড তৈরি করে, পাকিস্তানেও ইসি স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় এ কাজটি করে। তবে আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ বেশ কয়েকটি দেশে স্থানীয় কাউন্সিলর অফিসে গিয়ে ফরম পূরণ করে ভোটার হতে হয়। পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ দেশে নির্বাচন কমিশন রয়েছে বলে জানা গেছে।

বর্তমান কমিশন ২০০৭-০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকার কাজ শুরু করে। বর্তমানে দেশের ১১ কোটি ১৭ লাখের বেশি নাগরিক ভোটার তালিকাভুক্ত রয়েছে। ২০১০ সালে ইসির অধীনে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ একটি আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App