×

ফিচার

বাঁধাধরা নকশার ব্যতিক্রম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জুন ২০২১, ০৯:১৬ এএম

তাসখন্দ চুক্তির বিরোধিতা করে শেখ মুজিব আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই জোরদার এবং সকল বৈষম্য অবসানের লক্ষ্যে লাহোরে ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন। যা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম সোপান।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তান হতে পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা ব্যবস্থার সামরিক মৌলনীতির অসারত্ব প্রামণিত হলো। মূলত যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তান ও বহির্বিশ^ হতে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন ও অরক্ষিত হয়ে পড়ে। দেশপ্রেমিক বাঙালি জাতি যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মউপলব্ধিতে উপনীত হলো যে, পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি কোনো প্রকার দায়দায়িত্ব নেই। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই বাঙালির নিকট উচ্চারিত ‘শক্তিশালী কেন্দ্র’ ও ‘একককেন্দ্রিক’ শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা এনে দেয়।

জেনারেল আইয়ুবের এতদিনব্যাপী প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী কেন্দ্রের ফর্মুলা প্রকৃত বিপদের দিনে যে কোনোই কাজে আসবে না এই অভিজ্ঞতা বাঙালিকে নতুন করে সচেতন করে তোলে। যুদ্ধকালীন এই বিচ্ছিন্নতার কারণে বাঙালি জাতি বুঝতে শিখল আইয়ুব ও তার বংশদগণ যাই বলুক না কেন, বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষার মতো মৌলিক বিষয়েও বাঙালির কোনো অংশীদারিত্ব ও ভ‚মিকা নেই। দেশরক্ষার ব্যাপারে পূর্ববাংলার প্রতি এতদিনের বঞ্চনা ও ধোঁকাবাজি বাঙালি জাতিকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে।

যুদ্ধে বাঙালি সেনা-বৈমানিকদের নিপুণতা ও সাহস বাঙালি যে যোদ্ধাজাতি নয় এই প্রচারণার অসারত্ব প্রমাণ করে এবং পরিণতিতে জাতীয় গর্বের আত্মপ্রত্যয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী মূল চেতনার ধারাকেই শক্তিশালী করে।

১৯৬৬ সালের জানুয়ারিতে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার অব্যবহিত পরেই পশ্চিম পাকিস্তানে উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্ররোচনায় ওই চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়। লাহোরে অনুষ্ঠিত তাসখন্দ চুক্তিবিরোধী এই চক্রের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে শেখ মুজিব স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই জোরদার, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র, প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে লাহোরে ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন।

[caption id="attachment_284880" align="aligncenter" width="595"] যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম বইটির কভার ফটো[/caption]

শেখ মুজিবুর রহমান ৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর যান এবং পর দিন সাবজেক্ট কমিটির মিটিংয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের দাবি হিসেবে ‘ছয় দফা’ পেশ করেন এবং এগুলো কনফারেন্সের আলোচ্যসূচিতে গ্রহণ করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু লাহোর কনফারেন্স আসলে ছিল একটি ভারতবিরোধী সমাবেশ। যার মূল লক্ষ্য ছিল কাশ্মির উদ্ধারের ব্যাপারে আন্দোলনের রূপরেখা ঠিক করা। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামপন্থি নেতারা শেখ মুজিবের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং পর দিন পশ্চিম পাকিস্তানি পত্র-পত্রিকায় ছয় দফার বিকৃত বিবরণ ছাপিয়ে শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদীরূপে চিত্রিত করা হয়। ফলে মুজিব ৬ ফেব্রুয়ারির মূল কনফারেন্সে যোগ না দিয়ে কয়েক দিন পর ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরে আসেন।

যখন লাহোরে বিরোধীদলীয় কনভেনশন ডাকা হয় তখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের কাছে পাকিস্তানের রাষ্ট্র সত্তার এক বৈপ্লবিক পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব ছিল। তিনি এ নিয়ে দলে তার কয়েকজন সহযোগী এবং দলের বাইরে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আলোচনাও করেছিলেন। তিনি এক্ষেত্রে তখনো দলের ওয়ার্কিং কমিটিকে আস্থায় নেননি। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক বৈঠক নির্ধারিত ছিল। সম্পাদক চাইলে এ বৈঠক পূর্বেই হতে পারত। তবে এর বদলে ওই বৈঠক স্থগিত করা হয় লাহোর কনভেনশনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের যোগদানের সুবিধার জন্য।

বিষয়টি সুনিশ্চিত আভাস দেয় যে, তার ফর্মুলার ব্যাপারে বিরোধিতার কোনো ঝুঁকিই তিনি নিতে চাচ্ছিলেন না সেটি লাহোর কনভেনশনে উত্থাপনের আগে। কেননা, অন্যথায় ফর্মুলার প্রাক অনুমোদনের জন্য দলের স্বাভাবিক কার্যকলাপের আওতায় একটি জরুরি বৈঠক ডাকা যেত। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা তার ফর্মুলার ব্যাপারে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন সে বিষয়ে সম্ভবত তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। যদিও তিনি জনগণের অনক‚ল প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সুনিশ্চিতভাবেই আস্থাবান ছিলেন। আর তাই তিনি এমন কুশলী উপায় অবলম্বন করলেন যাতে করে ওয়ার্কিং কমিটির মধ্যে বিদ্যমান সম্ভাব্য বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদের পক্ষে ওটা ঠেকানোর কোনো পথ রইল না। কৌশলটি ভালোই কাজে দিল। কেননা গোড়ার দিকে অনেকে যারা ফর্মুলার ব্যাপারে অনেকটাই শীতল মনোভাব দেখিয়েছিলেন তারা আর এই পর্যায়ে তেমন বিরোধিতা করতে পারলেন না। এভাবে ওয়ার্কিং কমিটিকে পাশ কাটানোর কাজটি বস্তুত অগণতান্ত্রিক হলেও এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, কেননা সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়া হয় পারস্পরিক সমঝোতা ও সমন্বয়ক্রমে। আর এটির একটি ‘প্রয়োজনীয়তা কৌশলগত তাৎপর্যও’ ছিল।

১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ‘ছয় দফা’ প্রস্তাব ও তার জন্য আন্দোলনের কর্মসূচি পেশ করেন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এ সময় শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আহমদের দুটি ভ‚মিকাসহ ছয় দফা বিবৃত করে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৮ মার্চ তারিখে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের স্বনামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয়-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক আর একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। এই পুস্তিকায় ‘ছয়-দফা’র বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছিল।

লাহোরে অনুষ্ঠিত তাসখন্দ চুক্তিবিরোধী এই চক্রের কার্যধারার বিরোধিতা করে শেখ মুজিবুর রহমান স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুবের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই জোরদার, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র, প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে লাহোরে ৬ দফা কর্মসূচি পেশ করেন। ৬ দফা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম সোপান। পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষার জন্য ৬ দফা প্রণীত হয়নি। এ সম্পর্কে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, ‘৬ দফা পরিকল্পনা পেশের সময় শেখ মুজিব তাকে এবং রুহুল কুদ্দুসকে ডেকে বলেছিলেন, আসলে এটা ৬ দফা নয়, এক দফাই, ঘুরিয়ে বললাম শুধু।’

এ প্রসঙ্গে মোজাফফর আহমদ আরো বলেন, ১৯৪৭ সনে কলকাতা থেকে এসেই শেখ মুজিব ‘পাঞ্জাবী খেদাও’-এর ডাক দিয়েছিলেন। তিনি এটা প্রকাশ্যেই করতেন। মুজিব যা বিশ্বাস করতেন, তা অবশ্যই করে ছাড়তেন, কখনো নানা কৌশল করতেন, কিন্তু কাজটা তিনি ঠিকই করে ছাড়তেন। ১৯৫৪ সনে প্রাদেশিক পরিষদে আমি যে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনে প্রস্তাব করেছিলাম আওয়ামী লীগের বিরোধিতা সত্তে্ব ও মুজিব তা প্রকাশ্যে সমর্থন করেছিলেন। পরবর্তীতে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ছয়-দফা কর্মসূচী’ পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করেন। স্বাক্ষর করেন শেখ মুজিবুর রহমান।

উপসংহারে তিনি বলেন, আমার ছয় দফা দাবিতে একটিও অন্যায়, অসঙ্গত, পশ্চিম পাকিস্তান বিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তি তর্ক সহকারে দেখাইলাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তান আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হবে। তথাপি কায়েমি স্বার্থের মুখপাত্ররা আমরা বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছেন। এটা নতুন ও বিস্ময়ের কথাও নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগণের পক্ষে কথা বলতে গিয়ে আমার বাপ-দাদার মতো মুরুব্বিরাই এদের কাছে গাল খাইয়াছেন। এদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছিলেন; আর আমি কোন ছার? দেশবাসীর মনে আছে, আমাদের নয়নমণি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকও পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা, পাকিস্তানের সর্বজনমান্য জাতীয়নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবরণ করিতে হইয়াছিল এদেরই হাতে। দেখা গেল পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবির কথা বলতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেল-জুলুমের ঝুঁকি নিয়েই সে কাজ করিতে হইবে। অতীতে এমন অনেক জেল-জুলুম ভুগিবার তকদির আমার হয়েছে। মুরুব্বিদের দোয়ায় সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সে সব সহ্য করিবার মতো মনের বল আল্লাহ আমাদের দান করেছে। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানির ভালোবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যে কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। আমার দেশের প্রিয় ভাইবোনেরা আল্লাহর দরগায় শুধু এই দোয়া করিবেন, বাকি জীবনটুকু আমি যেন তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি।

ছয় দফা কর্মসূচি পূর্ব পাকিস্তানে খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশের এই পর্যায়ে জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ রাষ্টপরিচালনার হাতিয়ার হিসেবে সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে বাঙালির স্বশাসন, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আত্মকর্তৃত্বের দাবিকে ছয় দফার মধ্যে বঙ্গবন্ধু উপস্থাপন করলেন।

আগামীকাল প্রকাশিত হবে ‘আইয়ুবের হুমকি : মুজিবের জবাব’ ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’- বইটি পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রকাশনে (ভোরের কাগজ কার্যালয়, ৭০ শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা)। এছাড়া সংগ্রহ করা যাবে bhorerkagojprokashan.com থেকেও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App