×

মুক্তচিন্তা

হেফাজতের ক্ষমতার শেকড় এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২১, ১২:১১ এএম

করোনা ভাইরাস মহামারির পর এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট সম্ভবত ধর্মকে ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এর কারণ হচ্ছে ধর্মান্ধ, মৌলবাদী, স্বাধীনতাবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলো হেফাজতে ইসলাম নামের একটি কথিত অরাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে এক ছাতার নিচে জড়ো হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনায় কুঠারাঘাত করতে চেয়েছিল। সরকার তাদের সেই পরিকল্পনা ধূলিসাৎ করে দিলে সাপের খোলস পাল্টানোর মতো আত্মরক্ষার্থে সংগঠনটি তাদের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে। কমিটি বাতিলের একদিন আগে আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের প্রচলিত সব ধরনের রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকার ঘোষণা দেয়া হয়। তবে সম্প্রতি বিলুপ্তির দেড় মাসের মাথায় কওমি মাদ্রাসার সেই শিক্ষকদের রেখেই ৩৩ সদস্যবিশিষ্ট নতুন কমিটি ঘোষণা করেছে হেফাজতে ইসলাম। কমিটির অবশিষ্টদের পরে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আগের কমিটির প্রায় ৯০ শতাংশ নেতা বর্তমান কমিটিতে বাদ পড়লেও আমির পদে জুনায়েদ বাবুনগরী এবং মহাসচিব পদে নুরুল ইসলাম জিহাদী বহাল রয়েছেন। সদ্য ঘোষিত এই কমিটিতে বিতর্কিত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর আত্মীয়স্বজন ও অনুসারীদের জায়গা করে দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নাশকতা-তাণ্ডবে মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত অনেকেই স্থান পেয়েছে। মানে অনেকটা ‘যেই লাউ সেই কদু’ টাইপের কমিটি। নতুন কমিটিতে হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত আল্লামা শাহ আহমদ শফীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে লোক দেখানো কারণে স্থান দেয়া হলেও তার অনুসারীদের কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তার সমর্থকরা কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। হেফাজতের জন্ম নারীবিদ্বেষ দিয়ে। সরকার ২০০৯ সালে নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করলে প্রথমবারের মতো হেফাজত তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। তবে তারা প্রথম আলোচনায় আসে ৭ বছর আগে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে প্রগতিশীল ছাত্র-জনতা শাহবাগে আন্দোলনে নামলে আহমদ শফীর নেতৃত্বে তাদের বিরুদ্ধে ১৩ দফা দাবি নিয়ে রাজপথে নামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। এক পর্যায়ে ৫ মে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটানোর উদ্দেশ্যে শাপলা চত্বরে লাখ লাখ মানুষ জমায়েত করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সেদিন তাদের মিত্র ছিল সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। তখন হেফাজতের তৎকালীন মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাক্ষাৎ হয়েছিল বলেও খবর এসেছে। খালেদা জিয়া ভেবেছিলেন, হেফাজতি অভ্যুত্থান দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো যাবে। এজন্য তারা হেফাজতকে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা করে। কিন্তু সরকারের পতন ঘটেনি। গভীর রাতে পুলিশ হেফাজতকর্মীদের ঢাকা থেকে বিতাড়িত করে। তখন বিএনপি ও হেফাজত উভয় নেতৃত্বই নিরাশ হয়েছিল। তবে শাপলা চত্বরের নাশকতার পর হেফাজতের সঙ্গে সরকারের একটি গোপন সমঝোতা হয় বলে অনেকেই মনে করেন। সেই সমঝোতার পেছনে নানা লেনদেন, জমি বরাদ্দের কথাও প্রচলিত আছে। পাশাপাশি তাদের এমন কিছু দাবি মেনে নেয়া হয়, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন আনা হয়, কওমি সনদকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আবেগে গদগদ হয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী বিশাল সমাবেশে শেখ হাসিনাকে কওমি জননী উপাধি দেন। তিনি মঞ্চে উঠে শেখ হাসিনার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়াও চেয়েছিলেন ওই সময়ে। তবে গত বছর চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় রীতিমতো ক্যু করে জুনায়েদ বাবুনগরী-মামুনুল হকরা ক্ষমতা দখল করলে দৃশ্যপট পালটে যায়। হেফাজতের সরকারবিরোধী অংশটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। আহমদ শফীর অনুসারীদের বাদ দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়। নতুন আমির হিসেবে নিয়ে আসা হয় আহমদ শফী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি জুনায়েদ বাবুনগরীকে। বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে জড়িতদের প্রাধান্য দেয়া হয় কমিটিতে। হেফাজত সরকারবিরোধী অবস্থান দৃশ্যমান করে তোলে। যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ আরো কয়েকজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হেফাজতের নেতৃত্বে এসে ওয়াজ মাহফিলের নামে দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য আসে। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার আস্ফালনের কথা তোলে। সরকার ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে পিছিয়ে এলে হেফাজত আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। অতঃপর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতা করতে নেমে ২৬ মার্চ থেকে দেশে যে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালায় সেটি ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বর, বায়তুল মোকাররম, পল্টনে ঘটে যাওয়া তাণ্ডবকে আবার দেশবাসীর মনে করিয়ে দেয়। বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে, আহমদ শফীর মৃত্যুর পরে হেফাজতে ইসলামের আড়ালে ফের সক্রিয় হচ্ছিল জঙ্গিরা। নেপথ্যে এসবের কলকাঠি নেড়েছে জামায়াতে ইসলামী। আর এ সময়ে হেফাজতে ইসলামের অর্থের প্রধান জোগানদাতা স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জামায়াত। গত বছর সংবাদ সম্মেলন করে প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর একদল অনুসারী দাবি করেছিলেন, সংগঠনটির নেতৃত্ব জামায়াত-বিএনপির প্রেসক্রিপশনে চলছে। তদুপরি হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে ব্যাংককে বিএনপি নেতাদের গোপন বৈঠকে এবং নাশকতার ষড়যন্ত্রও ফাঁস হয়েছে। আরো জানা গেছে, ব্যাংকক ষড়যন্ত্রের ছক কষা হয়েছিল লন্ডন থেকে। সেই বৈঠকে সিদ্ধান্ত আসে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য হেফাজতের নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সহিংস সন্ত্রাসের তাণ্ডব চালানো হবে। এসব কিছুর ইকুয়েশন বলছে, হেফাজতকে এবার আর ছাড় দেয়ার অবস্থা নেই। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে সরকারও কেবল গ্রেপ্তার করেই বসে থাকেনি। টান দিয়েছে হেফাজতের শক্তির আসল উৎস ধরে। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। মামুনুলের ব্যাংক হিসেবে এক বছরে ৬ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য মিলেছে। একজন মাদ্রাসা শিক্ষক কীভাবে, কোত্থেকে এত টাকা পান? তদুপরি, হেফাজত ইসলামকে বিভিন্ন সময়ে অর্থের জোগান দিয়ে সহযোগিতা করেছে এমন ৩১৩ জন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এসব টাকা মামুনুল হকের দুই ব্যাংক হিসেবে জমা হয়েছে। এর পাশাপাশি জুনায়েদ বাবুনগরীসহ বিলুপ্ত কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের ৪৬ জন নেতাকর্মীর সম্পদের তথ্য চেয়ে সরকারের ৪টি দপ্তরে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অজ্ঞাত উৎস থেকে অর্থ প্রাপ্তি, পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগসহ যেসব তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পেয়েছে। গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রকাশ হচ্ছে, তার ভিত্তিতে সরকার কী ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার তার অবস্থান ধরে রাখলে হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কমিটির যেসব নেতা সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত, যারা বিভিন্ন সময় নানা সন্ত্রাসী কাজে সংশ্লিষ্ট থেকেছে, ভিন্ন দেশ থেকে টাকাসহ সমর্থন পেয়ে বাংলাদেশবিরোধী কার্যকলাপ চালিয়ে গেছে, তারা এবার শাস্তি এড়াতে পারবে না। বর্তমানে সরকার হার্ডলাইনে থাকার কারণে হেফাজত কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তবে এতে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। কারণ মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাবিরোধী এই অপশক্তি সুযোগ পেলে আবারো ছোবল দেবে। বিপদে পড়েছে বলেই এখন তাদের সুর নরম। চাপের মুখে তারা কৌশল বদল করলেও বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি। এদের উদ্দেশ্য ইসলামের হেফাজত নয়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। তাই এই কুচক্রীদের অশুভ তৎপরতা এখনই বন্ধ করতে হবে। সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে এই সাম্প্রদায়িক পাকিস্তানপন্থিদের মোকাবিলা করতে হবে, অন্যথায় বিপদ অনিবার্য। মর্তুজা হাসান সৈকত : কবি ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App