×

জাতীয়

স্বাস্থ্য খাতে লুটপাটের অনুসন্ধান-তদন্তে ভাটা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২১, ০৯:০৭ এএম

স্বাস্থ্য খাতে লুটপাটের অনুসন্ধান-তদন্তে ভাটা

ফাইল ছবি

মহামারিকালে ফুটে ওঠা দেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশায় এ খাতের দুর্নীতির কথা বর্তমানে মানুষের মুখে মুখে। চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটা, নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, বদলিসহ সব ক্ষেত্রেই চলছে দুর্নীতি-অনিয়মের মহোৎসব। এর মধ্যে মহামারির শুরুতে এ খাতের বহুল আলোচিত বিষয় ছিল মাস্ক-পিপিই কেলেঙ্কারি, রিজেন্টকাণ্ড ও তার সঙ্গে কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ, জেকেজিকাণ্ড, কোটিপতি গাড়িচালক, তৃতীয় শ্রেণির এক কর্মচারীর দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড়, ঢাকার ৯টি হাসপাতালে কয়েকশ কোটি টাকার দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা। এসব ঘটনায় দু-চারজন ছোটখাটো দুর্নীতিবাজ ধরা পড়লেও অধরাই রয়ে গেছে পেছনের রুই-কাতলারা। এ অবস্থায় নাটের গুরু গডফাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে দীর্ঘমেয়াদে কোনো ফল হবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবের শুরুতে বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান জেএমআইয়ের নকল মাস্ক ও পিপিই সরবরাহ, বিনামূল্যের করোনা টেস্টে রিজেন্টের অবৈধ অর্থ আত্মসাৎ ও জেকেজির ভুয়া করোনা রিপোর্ট প্রদান ও বিভিন্ন হাসপাতালে কেনাকাটায় স্বাস্থ্য খাতে শত শত কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। পরবর্তী সময়ে লাগামহীন এসব ঘটনায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ২৫টি মামলা করে দুদক। প্রায় এক বছর হলেও এসব মামলার আসামিদের অবৈধ সম্পদের তদন্ত শেষ করতে পারেনি সংস্থাটি। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতের ৪৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবৈধ সম্পদ থাকার অভিযোগে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নোটিস দেয়া হয়, সে অনুসন্ধানও শেষ হয়নি।

মাস্ক-পিপিই দুর্নীতি : করোনার মতো অতিমারির মধ্যেও নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্যের সরঞ্জাম ক্রয় ও সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনা ছিল গত বছরের আলোচিত ঘটনা। দুদকের অনুসন্ধানেও এর সত্যতা মেলে। অনিয়মের অভিযোগে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) ছয় কর্মকর্তা ও জেএমআই হাসপাতাল রিকুইজিট ম্যানুফ্যাকচারিং লিমিটেডের কর্ণধার মো. আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। মামলার এজাহারে জেএমআই গ্রুপের ২০ হাজার ৬১০টি সরবরাহ করা মাস্ক ‘এন- ৯৫’ নয় বলে উল্লেখ করা হয়। যার তদন্ত এখনো চলমান।

রিজেন্ট হাসপাতালের দুর্নীতি : লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই রিজেন্ট হাসপাতালকে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে রূপান্তর, মেমরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ) করতে অনিয়ম এবং সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে কোভিড পরীক্ষা করেও অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মতো ঘটনা ঘটে গত বছর। এমন অনিয়মের ঘটনায় আলোচিত রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম চরিত্রটি ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। সাহেদ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক আমিনুল হাসানসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করলেও আসামি করা হয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদকে। মামলায় ৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়া সাহেদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, আয়কর ফাঁকি, ভুয়া নাম ও পরিচয়ে ব্যাংকঋণ নিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎসহ অবৈধ সম্পদ অর্জনের পৃথক মামলা দুদকের তদন্তাধীন।

জেকেজির ভুয়া সনদ : ২০২০ সালের মার্চে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে সরকারের কাছ থেকে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহের অনুমতি নিলেও টাকা আদায় করে জেকেজি হেলথ কেয়ার। এমনকি নমুনা পরীক্ষা না করেও রোগীদের ভুয়া সনদ দিচ্ছিল তারা। এসব অভিযোগে গত বছরের ২২ জুন জেকেজির সাবেক দুই কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আরিফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। করোনা ভাইরাসের ভুয়া প্রতিবেদন দিয়ে জেকেজি হেলথ কেয়ারের ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে ডা. সাবরিনা ও আরিফের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে দুদক। যা বর্তমানে শেষ পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।

হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে দুর্নীতির মামলা : স্বাস্থ্য খাতের যন্ত্রপাতি ক্রয় নিয়ে অর্থ আত্মসাৎ ও দুর্নীতির অভিযোগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুড়িগ্রাম হাসপাতাল, গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ হাসপাতাল, নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পাবনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের ঠিকাদার ও ক্রয় কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিরুদ্ধে প্রায় ২৫টি মামলা দায়ের করে দুদক। এসব মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। তবে এসব মামলার তদন্তে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পায় বলে দুদক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া দুদক সূত্র জানায়, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালসহ বগুড়া, সিলেট, গাইবান্ধার সিভিল সার্জন অফিসের মালামাল কেনার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ অনুসন্ধানাধীন।

স্বাস্থ্যের গাড়িচালক মালেক ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজালের এত সম্পদ : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আলোচিত গাড়িচালক আবদুল মালেকের চারটি বাড়ি ও তিনটি প্লটসহ শত কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে দাবি ছিল র‌্যাব ও দুদকের। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দুদকের মামলায় মালেক ও তার স্ত্রী নার্গিস বেগমের বিরুদ্ধে সোয়া ৩ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয়। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর তুরাগের বামনারটেক এলাকার একটি সাততলা ভবন থেকে গ্রেপ্তার হন আবদুল মালেক। এ মামলাটিও এখনো তদন্তাধীন। এছাড়া আবজাল ও তার স্ত্রীর নামে দেশ-বিদেশে শত শত কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে দুদক সূত্র নিশ্চিত করেছে। ইতোমধ্যে আবজালের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান গণমাধ্যমকে বলেছেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির অনুসন্ধানে কিছুটা ধীরগতি তৈরি হয়। তবে অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এখন পর্যন্ত এ খাতে দুর্নীতির অভিযোগে ২৫টির মতো মামলা হয়েছে। আরো ৮ থেকে ৯টি মামলা প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া ১০টি অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত কয়েক বছর স্বাস্থ্য খাতে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে আলোচিত নামটি ছিল মোজাহেরুল ইসলাম মিঠু। সাবেক এক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মিঠু বর্তমান সরকারের আমলে আড়ালে থেকে স্বাস্থ্য খাতে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নানা দুর্নীতি করলেও দুদকের কোনো অনুসন্ধানে মিঠুর নাম আসেনি। এমনকি এখন পর্যন্ত যেসব মামলা হয়েছে সেসব মামলার কোনোটিতেই মিঠুকে আসামি করা হয়নি। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দুদক থেকে ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়। সে তালিকাতেও মিঠুর প্রতিষ্ঠান নেই।

জানা যায়, ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্ব একটি টিম। পরে করোনাকালে পরিচালক জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে আরেকটি টিম গঠন করা হয়। দুটি পৃথক টিমের অনুসন্ধানে ২৫টি মামলা করা হয়। এ অনুসন্ধানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে অনুসন্ধান শুরু হয়ে এ পর্যন্ত ২৫টি মামলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাসহ অভিযোগ সংশ্লিষ্ট অনেক আসামিকে গ্রেপ্তার করেছিল দুদক। আসামিদের অনেকেই উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছে। অধিকাংশ মামলা ঢাকার বাইরে। নানা কারণে এসব মামলা তদন্তে সময় লাগছে। এছাড়া করোনার কারণেও তদন্ত আগায়নি।

এদিকে ২০১৯ সালে একটি প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য খাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি মিলিয়ে দুর্নীতি বেশি হয়, এমন ১১টি খাত চিহ্নিত করে ২৫ দফা সুপারিশ দিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এছাড়া গত বছরেই দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, করোনা ভাইরাস সংকটের সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আস্থার সংকটে পড়েছে স্বাস্থ্য খাত। কিন্তু গণমাধ্যমে বড় বড় অনিয়ম-দুর্নীতি তথ্যপ্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশের পরও তেমন কোনো ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত, সেখানে দুর্নীতি বা অনিয়মের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এরকম ক্ষেত্রে খুব কমই আমরা কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাই। বড় জোর বদলি হয়, যা আসলে কোনো পদক্ষেপ নয়। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষ থেকেও খুব যে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়, তা নয়। কখনো কখনো চুনোপুঁটি ছোটখাটো কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়, যাদের রাজনৈতিক যোগসাজশ নেই। কিন্তু রুই-কাতলাদের ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হতে দেখা যায় না। এ কারণে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে। এছাড়া মহামারিকে দুর্নীতির একটি মহোৎসবে পরিণত করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App