মেমোরিয়াল ক্লাব বিষয়বৈচিত্র্যে মহাকাব্যিক শিল্পায়োজন
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২১, ১২:১৩ এএম
‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ (২০২০) মজিদ মাহমুদের (জ. ১৯৬৬) প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি চারটি পরিচ্ছেদে সুবিন্যস্ত। উপন্যাস-আখ্যানের দিকে তাকালে এটিকে পৃথক চারটি উপন্যাসও বলা যায়। আবার পরিচ্ছেদগুলোর মধ্যকার সুগভীর আন্তঃসম্পর্কও লক্ষ করা যায়। মর্জিনা-মলিনা, ইয়াছিন, হাসান-হাজেরা, আকলিমা অথবা আব্দুল খালেকের মতো মানুষেরা জীবনযন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। বেলাশেষে এরা সবাই নিদারুণ জীবনবাস্তবতার মুখোমুখি এমনকি স্বজীবন সুরক্ষা করতে পারছে না। বিধবা চাচির সঙ্গে জেনার অভিযোগে বাদী অথবা সাক্ষীসাবুদ ছাড়াই ইয়াছিনের চুলকেটে, মাথায় ঘোল ঢেলে, মহিষের পিঠে চড়িয়ে পুরো গ্রাম প্রদক্ষিণ করায়। অপমান সইতে না পেরে ইয়াছিন ঘটনার তিনদিন পর তেঁতুলগাছে ঝুলে জীবনাবসান ঘটায়। বিয়ের ৭ মাস পর সন্তান প্রসব করায় প্রতিবেশীরা হাজেরাকে অসতীর বদনাম দেয়। শ^শুরকুলের লোকজনও নবজাতকের বংশপরিচয় নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ করে। সালোয়ার-কামিজ পরতে না পরতেই আকলিমা গর্ভবতী হয়। নির্মম নির্যাতনের মুখে ঘর থেকে বের করে দেয় শিশুমাতাকে। শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে ভিক্ষা করতে করতে কোথাও হারিয়ে যায় শিশুমাতা।
মাতৃহীন মলিনার মাথায় খানিকটা গণ্ডগোল। মা অথবা মুরব্বিগোছের মেয়ে মানুষ না থাকায়, পিতা দূরে থাকায় কেউ তাকে সংসারের দরকারি রীতিনীতি শিখিয়ে দেয়নি। নিজের মধ্যেও ন্যায়-অন্যায় বোধবুদ্ধি তৈরি হয়নি। ধারে কাছের মানুষজনও সুযোগটা কাজে লাগায়। পাকবাহিনী আধপাগলা মলিনাকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায়। দিনকুড়ি পর ছাড়া পেয়ে মলিনা ফিরে এলে পোয়াতির খবর রাষ্ট্র হয়। জারজ সন্তান ধারণ করায় গ্রামবাসী বিচার সভায় বসে। লুকমান ও লুকমানের মেয়ে মলিনা মাটির ওপর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে অধোমুখে বসে থাকে। দর্শকসারি থেকে ভয়ংকর সব শাস্তির প্রস্তাব আসতে থাকে। চুল কর্তন করা, তওবা পড়ানো, পিষ্ঠদেশে আঘাত অথবা একঘরে করার মতো নানাবিধ প্রস্তাব এলেও আখেরে গ্রামবাসী শিশুসন্তানসহ মলিনাকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আঘাত সইতে না পেরে মলিনার বয়োবৃদ্ধ নানি আগেই বসতবাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যায়। দিনকয়েক পরে হতভাগ্য পিতা লুকমানও মেয়ে মলিনার হাত ধরে জন্মভূমির মোহমায়া বিসর্জন দিয়ে গভীর রজনীতে বসতভিটে ছেড়ে পালিয়ে যায়। রূপবতী কন্যা মর্জিনাও জীবনটা উপভোগ করতে পারেনি। সতিত্ব হারানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রাণটাও হারিয়েছে অকালে। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্দুল খালেকের জীবনপ্রদীপ তেলহীন প্রদীপের ন্যায় ধপ করে নিভে যায়। এভাবে প্রতিটি পরিচ্ছদে একের পর এক নিপীড়িত-নিষ্পেষিত অসহায় নারীপুরুষের অস্ফুট ক্রন্দনধ্বনি শুনতে পাই। তবে এরা কেউই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নয়; প্রধান চরিত্ররূপে উপন্যাসের আদিঅন্ত জুড়ে রয়েছে নায়ক হাসান।
এই হাসানকে কেন্দ্র করেই গ্রন্থটির গল্পকথা খানিকটা ট্রাজিক পরিণতির দিকে এগিয়েছে। বিলকিস ওরফে বিলুর সঙ্গে হাসানের কিছুটা প্রেমপ্রেম ভাব জমলেও এটি মোটেও প্রেমপ্রধান উপন্যাস নয়। এটিকে চেতনাপ্রবাহ রীতির অথবা মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসও বলা যেতে পারে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) অনেকটা কামু অথবা সাত্রের আদলে ‘লালসালু’ অথবা ‘কাঁদো নদী কাঁদো’র ন্যায় দুখানা উপন্যাস লিখেছিলেন। সেখানে আরেফ আলী অথবা মুহম্মদ মুস্তফা চরিত্রে চেতনাপ্রবাহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সেই চেতনাপ্রবাহ ছিল অস্তিত্ববাদী সংকট অথবা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। কিন্তু হাসানের মনোজগতের সংকট আরো বহুমুখী ও বিপুল ব্যাপ্তি নিয়ে। ক্রমান্বয়ে নানাবিধ বোধ ও ভাবনা হাসানকে অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরে। ভ্রাতৃহত্যাকারী অশোকের অহিংসার বাণী প্রচার, পিতার ঔরস থেকে হারিয়ে যাওয়া কোটি কোটি শুক্রাণু সহোদরের কথা, নিয়ন্ত্রণের কথা বলে পরাশক্তির পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো; গ্রাম থেকে শহরে আসা অন্নহীন কালো মানুষের ঢেউ, আইল্যান্ডে শায়িত শীর্ণ নারীর ইহকাল-পরকালের পারাপার প্রসঙ্গ, ফুটপাতের আলোহীন পথশিশু, দাসব্যবসা, টোব্যাকো কোম্পানির নিকোটিন সরবরাহ, অসংখ্য মানুষের ফুসফুস ধ্বংস হওয়াÑ জগৎ ও জীবন সম্পর্কিত ইত্যাকার নানাবিধ সংকট ও সমস্যায় হাসানের শরীরমন অবশ হয়ে আসে। চাইলেই হাসান এসব ভাবনা এড়িয়ে যেতে পারে না। এসব মানুষের নিদারুণ ঘটনাবলি হাসানকে গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত করে। মুক্তির কূলকিনারা কোনো হুদিস খুঁজে পায় না হাসান। নিজের মুক্তিও নিজের হাতে নেই। মাঝেমধ্যে নিজেকে টিকটিকি মনে হয়। এমনকি আরো নিম্নস্তরের। একটি টিকটিকির নিজেকে সুরক্ষার যত সুকৌশল আছে হাসানের তাও নেই।
বাস্তবিকই গভীর সংকটের মুখোমুখি হাসান। গভীর রাতে সংবাদ অফিস থেকে গৃহে প্রত্যাবর্তনকালে পথিমধ্যে পথবালিকার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। মানবিক অনুভবে হাসান পথবালিকাকে কিছুটা আর্থিক সহায়তা করতে গিয়ে নিশিপুলিশের হাতে সন্দেহভাজনরূপে গ্রেপ্তার হয়। রাতে ডিবি অফিসে ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হাসান। সাংবাদিক হিসেবে হাসান মনে মনে মুক্তির প্রত্যাশা করলেও আখেরে জেলজরিমানা ভোগ করতে হয়। এক মাস ১০ দিন পর জেলমুক্ত হয়ে হাসান অফিসে এলে সবাই সন্দেহ করে এমনকি ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিলুও। বিমর্ষ হৃদয়ে হাসান স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করলে আরেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। এবার স্ত্রী ফারিয়া ওরফে রিয়ার সন্দেহতীরে হাসান ক্ষতবিক্ষত। রিয়া কোনোমতেই হাসানকে গ্রহণ করতে চায় না। রাস্তার মেয়ে মানুষের কথা বলে রিয়া তীব্রভাবে হাসানকে প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি শেষতক ডিভোর্স লেটার ফাইল করে। নিদারুণ জীবনযন্ত্রণা হাসানের মস্তিষ্কে গভীর ক্ষত তৈরি করে। তীব্র যন্ত্রণায় বিকারগ্রস্ত হলে হাসানকে অবশেষে মানসিক অ্যাসাইলামে ভর্তি করা হয়।
কেবল হাসান নয়, মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাচেতনার অভিঘাত বিলু ওরফে বিলকিসের মধ্যেও কম নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে বেশি। উপন্যাসের দ্বিতীয় পরিচ্ছদে ‘বেথেলহেমের পথে পথে’ আমরা বিলুকে দেখতে পাই। বিলু এই উপন্যাসের চিন্তাশীল নারীব্যক্তিত্ব। মানুষের জন্ম, উৎপত্তি ও তার সভ্যতার ক্রমবিকাশ নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। জলের যোনি থেকে মানুষের উৎপত্তি। আজো জলজীবন থেকে মানুষের উত্তরণ হয়নি। মানবশরীরে রয়েছে সমুদ্রের গুণাগুণ। সেখানে জোয়ার-ভাটা আসে। যতদিন জোয়ার-ভাটা আছে ততদিন শরীর জীবিত; অন্যকে ধারণ করতে সক্ষম। শুকিয়ে গেলে মরা নদীতে কেউ সাঁতার কাটতে আসে না। বিলু নারীর পিরিয়ডকে চাঁদের কলার সঙ্গে তুলনা করে। চাঁদকে পূর্ণ হওয়ার জন্যই ক্ষয়ে যেতে হয়, নারীদেহও তেমনি। মানবজন্ম প্রক্রিয়া বিলুর কাছে অদ্ভুত লাগে। দুজন অপরিচিত ভিন্ন মানুষের মধ্যে তার বীজ প্রথমে উপ্ত হয়েছিল। যারা শ্রমিক হিসেবে শারীরিক সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেনি। যারা কারখানায় কয়লায় দিতে পারে উত্তাপ। যারা টানতে পারে হাপর। তবে শরীর গড়িয়ে পরা রক্তবিন্দু দেখে বিলুর খারাপ লাগে। মানবশিশু জন্মদানে কোনো প্রাণীর এমন বেহাল দশা হয় না। চার পায়ের পরিবর্তে তাকে দুপায়ে ভর দিয়ে চলতে হয়। বিহঙ্গ হাজার মাইল উড়ে খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু মানুষের উড়াল শিখতে লেগেছে লাখো কোটি বছর। জীবন ও জগৎ সম্পৃক্ত এসব ভাবনাচিন্তার পাশাপাশি ফুফুবাড়ির কাজের মেয়ে আকলিমার কথাও মনে পড়ে বিলুর। আকলিমা এখন কোথায়? আকলিমার সেই শিশু বেঁচে আছে কি? নাকি বেথেলহেমের পথে পথে এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে; নাকি হামাসের রকেটের বিস্ফোরক হয়ে পিতার অনুসন্ধানে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে যাচ্ছে; নাকি বুকের সঙ্গে বোমা বেঁধে আদম বোমা বিস্ফোরিত হয়ে যাচ্ছে। একটু নিবিড় দৃষ্টি দিলে দেখব, কেবল আকলিমা নয়, পরপর দুটি প্রজন্ম শিকড়হীন হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি লেখক ঐতিহাসিক পুরাণ প্রসঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উপস্থাপন করেছেন। এবং ঘটমান বর্তমান কালের প্রয়োগ দেখিয়ে দেখাচ্ছেন, ওই মানব দুঃখের এখনো অবসান তো ঘটেইনি বরং পুরুষাণুক্রমে পরবর্তী প্রজন্মের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ফিলিস্তিনি জনমানুষের জন্মান্তরের অসহায়ত্ব আকলিমাকেও খানিকটা অসহায় করে তোলে।
দেখা যাচ্ছে, এই বিশ্বসমাজ-সংসারের নানা বিষয় হাসান এবং বিলুর চিন্তাজগতে ক্রমান্বয়ে মিছিল করে হাজির হচ্ছে। হাসান অথবা বিলু ওরফে বিলকিসের চিন্তাপ্রবাহ মূলত লেখকের নিজস্ব চেতনাপ্রবাহেরই প্রতিচ্ছবি। সচেতনতাই মজিদ মাহমুদ উপন্যাসের চরিত্রের অন্তর্জগতে শিল্পসংরাগে প্রতিস্থাপন করে দিচ্ছেন। তবে মজিদ মাহমুদ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-১৯৭১) ন্যায় কোনো একটি একক বিন্দুতে স্থির থাকছেন না তিনি। বরং অনেকগুলো বিন্দুর সমন্বয় একটি সামগ্রিক জীবন ও জগৎ দেখাতে সচেষ্ট হচ্ছেন। এজন্য ক্রমান্বয়ে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছেন। চরবিলকাদা থেকে ফকিরাপুল অথবা মানিক মিয়া এভিনিউ, ঢাকা থেকে বেইজিং, রবীন্দ্র-নজরুল থেকে পূর্বকালের প্রাচীন জীবন ও জনপদ ছুঁয়ে ছুঁয়ে উপন্যাস-আখ্যানের কাহিনী-কাঠামো গড়ে তুলছেন। এক্ষেত্রে ইতিহাস এসেছে সহায়ক শক্তিরূপে বিশেষত সাহিত্যের পূর্বাপর ইতিহাস ও পুরাণপ্রসঙ্গ। গীতাউপনিষদ, বেদবাইবেল, বাল্মীকী-বেদব্যাস, রামায়ণ, মহাভারত, হোমার, ইলিয়াড-ওডিসি, রবীন্দ্র-নজরুল থেকে জীবনানন্দ দাশ-প্রতিভাবসু পর্যন্ত বিপুল ব্যাপ্তি নিয়ে এই আখ্যান। প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্য, স্বকাল থেকে অতীতকাল, ইতিহাস থেকে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতিসহ বহুবিধ প্রসঙ্গ উপন্যাসের জমিন জুড়ে বিরাজমান। রয়েছে লেখকের নিজস্ব চিন্তাদর্শন। ‘কেউ তো আর বেশ্যা হয়ে জন্মায় না, সমাজ বেশ্যা বানায়’, ‘প্রত্যেক বাড়ির মধ্যেই তো আলাদা আলাদা মিলনের ঘর থাকে, মানুষের মিলনের দরকার না থাকলে, আলাদা ঘরের ধারণার বিলুপ্তি ঘটতো’, ‘সকল প্রাণের মধ্যেই মৃত্যুর বীজ লুকিয়ে থাকে’ ইত্যাকার ভাবনা। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট, কাহিনীর বয়ানবিন্যাস, চরিত্র নির্বাচন ও উপস্থাপন, বিষয়বৈচিত্র্যে ও ব্যাপকতায়, সর্বোপরি স্বচ্ছ সুললিত গদ্যশৈলী সবমিলিয়ে এ এক মহাকাব্যিক শিল্পায়োজন।
মেমোরিয়াল ক্লাব, মজিদ মাহমুদ, প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০২০, ভোরের কাগজ প্রকাশন, মূল্য : ৩০০, প্রচ্ছদ : পীযূষ দস্তিদার
পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রধান কার্যালয় ও ভোরের কাগজ প্রকাশন অনলাইন থেকেও সংগ্রহ করতে পারেন।