×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২১, ১২:১২ এএম

সবুজের পরামর্শ মেনে আমিও আত্মমগ্ন হতে চেষ্টা করলাম সারাদিন। পারভিন একবার ঠাট্টা করে বললো, “সন্ন্যাস নিতে চাইছিস?” আমি ওর কথার কোন উত্তর করলাম না। ও আর আমায় বিরক্ত করেনি। সন্ধ্যার আগে খালা এসে বললো, “পারুমনি খালা, আপনের একজন মেমান আইছুইন। গেইটে গিয়া দেহেন খাড়াইয়া রইছুইন।” আমি দুরু দুরু বুকে গেইটের দিকে পা বড়ালাম। গেইটের কাছে গিয়ে দেখলাম রেজা দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হলাম না মোটে। সামনে দাঁড়িয়ে আছি, কিছুই বলছে না সে। কয়েক মুহূর্ত চলে যাবার পর আমিই প্রশ্ন করলাম, “তুমি কি আমায় কিছু বলতে এসেছো? না-কি আমার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে এসেছো? যদি কিছু বলার থাকে জলদি বলে ফেলো, আমার কাজ আছে আরও!” রেজা তারপরও কিছুক্ষণ চুপ থেকে যেনো প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলো, “দেখো পারমিতা, তুমি আমার এলাকার মেয়ে, তুমি সুমন ভাইয়ের ইন্দ্রাণী, তারচেয়েও বড় কথা তুমি আমার সহপাঠী।” আমি রেজাকে মুখের উপর হাত তুলে থামিয়ে দিলাম, “দেখো রেজা, আমি তোমার সহপাঠী, তোমার এলাকার মেয়ে, ঠিক আছে, কিন্তু ভবিষ্যতে তোমার মুখ থেকে সুমনের মতো একটা স্টুপিডের নাম শুনতে চাই না আমি! সুমন তোমার রাজনৈতিক গুরু হতে পারে, মনে রাখবে আমার কাছে সে একটা অসভ্য! আর যদি তুমি আমার কাছে সুমনের দূতালি করতে আসো, মনে রেখো তোমার-আমার সম্পর্ক সেদিনই শেষ! অন্য কোন কথা থাকলে বলো, নইলে আসতে পারো! তোমার সাথে পিতলা আলাপের সময় আমার হাতে নেই! আর ভবিষ্যতে এসব ব্যাপারে কথা বলতে এলে আমি তোমার নামে কমপ্লেইন করবো কর্তৃপক্ষের কাছে!” রেজা একদণ্ড থেমে বলতে শুরু করলো, “আমি যা বলছি, তোমার ভালোর জন্যই বলছি। এই যে তুমি এখানে নির্বিঘ্নে পড়ালেখা করছো, শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছো, সিনেমা দেখতে যাচ্ছো, ফুচকা-চানাচুর-ঘুগনি খাচ্ছো, বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দিচ্ছো নিরাপদে; কেউ তোমার কাছে ঘেঁষছে না, সবই সম্ভব হচ্ছে; কারণ তোমার মাথার উপর একটা অদৃশ্য ছায়া অবস্থান করছে! ঐ ছায়ার আড়ালটি না থাকলে, অনেক আগেই তুমি হারিয়ে যেতে। অনেক আগেই তুমি এসিডদগ্ধ হতে, কিংবা লাপাত্তা হয়ে যেতে! এতোদিনে হয়তো দেয়ালে ছবি হয়ে ঝুলে থাকতে! তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু আমি জানি তোমার মাথার উপর ছায়াটি সুমন ভাই!” আমি ধৈর্য রাখতে পারলাম না, বেশ জোরের সাথেই চেঁচিয়ে উঠলাম, “দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে! আমায় থ্রেট করতে আসো! এতোবড় স্পর্ধা তোমার! আমি কারো অনুগ্রহে পড়তে আসিনি এখানে! কারো শক্তিতেও আমি এখানে অবস্থান করি না! কক্ষণো তুমি আসবে না আমার কাছে!” রেজা শ্লেষমাখা হাসি হাসলো, “এতগুলো মানুষকে শত্রু বানিয়ে কী লাভ হলো তোমার? আমাদের নাম বলে দিয়ে কী পেলে? আমরা সরি বললাম, আর কর্তৃপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ তুলে নিলো। গতকাল দেখলে না, এমপি-ডিসি-এসপি সবাই মিলে মিটিং করে আমাদের মুক্ত করে দিয়ে গেলো! কেন জানো? টপলেভেল থাকে নির্দেশনা এসেছিলো আমাদের জন্য! বুঝতেই পারছো আমরা দল করি। দলেরও প্রয়োজন আছে আমাদেরকে। যাক তোমাকে আমার পরামর্শ দেবার কিছু নেই। তবু একটা কথা বলে যাই, যদি নিজেকে রক্ষা করতে চাও, সুমন ভাইয়ের সাথে মিলে যাও। মনে রেখো সুমন ভাই জেনারেল জিয়ার পছন্দের তালিকায় ছিলেন; শহীদ জিয়ার মৃত্যুর পর এখনও সুমন ভাই দলের সেন্ট্রাল নেতাদের সুনজরে আছেন।” রেজা আর দাঁড়ায়নি; পা চালিয়ে চলে গেল। একটুক্ষণেই অন্ধকারে হারিয়ে গেল রেজার অসহ্য পদক্ষেপ। হঠাৎ যেনো সন্ধ্যাতেই গভীর রাত নেমে এলো। গেইট থেকে আমার কক্ষের দূরত্ব যেনো হঠাৎ বেড়ে গেলো, এইটুকু পথ হাঁটতে আমার গা ছমছম করছে, মাথা টলছে। বুকের ভেতর বাড়তি একটা উথাল-পাথাল অনুভব করছিলাম; অনেক কষ্টে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরটাকে টানতে টানতে নিজের ঘরে পৌঁছালাম। ঘরে পারভিন ছিলো না, হয়তো টিভি রুমে আছে; চুপচাপ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে থাকলাম কিছুক্ষণ। আমি চাই না পারভিন এসবের কিছু জানুক। পারভিন ফিরে এসে আমায় শুয়ে থাকতে দেখে পাশে বসে আমার কপালে হাত রাখলো, “কী-রে কী হয়েছে? কে এসেছিলো?” আমি চোখ বন্ধ রেখেই কথা বললাম, “রেজা এসে বলে গেলো, কর্তৃপক্ষ ওদের ক্ষমা করে দিয়েছে।” পারভিন ‘বেশ’ বলে উঠে গেলো। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম যথারীতি; কিন্তু সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। নিজেকে নিয়ে ভাবলাম, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়েÑস্বপ্ন নিয়েÑবাস্তবতা নিয়েÑসম্ভাবনা নিয়েÑদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবলাম, কিন্তু কিনারা করতে পারলাম না। বারবার মনে হচ্ছিলো আমি যেনো কোনো এক অজানা দ্বীপের সন্ধানে সীমাহীন সমুদ্রে ডিঙা ভাসিয়েছি। অকূলপাথারে কোথাও কোনো দিশা নেই; দূরের বাতিঘর হয়ে কেউ আমায় ইশারা করছে না। বুক ভেঙে কান্না এলো; নিঃশব্দে কাঁদলামও। মনে একবার আত্মহত্যার কথাও আসলো, কিন্তু মুহূর্তে তা মিলিয়েও গেলো। আর যাই হোক, পরিস্থিতি যাই হোক, কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করতে পারি না! প্রয়োজনে লড়তে লড়তে মরে যাবো, তবু আত্মসমর্পণ করবো না কোনোদিন। চোখে বারবার ১৯৭১-এর অস্পষ্ট স্মৃতি ভেসে উঠলো। সে সময় আক্রান্ত বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করেই বেঁচে ছিলো, যুদ্ধ করেই বিজয় অর্জন করেছিলো। লক্ষ লক্ষ মানুষ বুকের রক্ত দিয়েছে, লক্ষ মা-বোন সম্ভ্রম দিয়েছে; তবু কি পরাজয় মেনেছে বাংলাদেশ? কতই বা বয়স তখন আমার? সবে ক্লাস ফাইভে পড়ি; কুরুয়া-শ্রীবর্দী-ভায়াডাঙা-বকশিগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পালিয়ে বেড়াবার স্মৃতি আজও স্পষ্ট মনে আছে সব। রাতের অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা হয়ে যেতো, আব্বা তখন আমায় কোলে তুলে নিতেন, ভাইয়ার কাঁধে বোঝা, আর আম্মার কোলে দীপ্ত দুধের বাচ্চা। অন্ধকার রাত দূরে কোথাও গোলাগুলির শব্দ, আর আমরা প্রাণভয়ে পালাচ্ছি। সারি-সারি মানুষ, সামনে-পিছে ভয়ার্ত মানুষের সারি। বিভিন্ন গ্রামে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে এক রাতÑদু’রাত কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত বকশিগঞ্জে কাটিয়েছি অনেক দিন। সেখান থেকেই ভাইয়া একরাতে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় কাউকে কিছু না জানিয়ে। ভাইয়াকে খুঁজতে যাবার কথা বলে একদিন আব্বাও হারিয়ে যান। বড়’পার বিয়ে হয়ে গিয়েছিলো আগেই, ও চট্টগ্রামে স্বামীর সাথে, মেজ’পা তখন সবে ফার্স্টইয়ার। একদিন-দু’দিন করে যখন সপ্তাহ পেরিয়ে গেল, আব্বা ফিরলেন না, আমাদের পরিবারের মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়লো। সেই দুঃসময়ে আম্মাকে দেখেছি কতটা সাহস আর ধৈর্য নিয়ে দিন পাড়ি দিয়েছেন। ১৯৭১ তাই আমার দুঃসময়ের প্রেরণা। দুঃস্বপ্নের রাত কাটলো যেনো। যখন ভোরের আলো ফুটছে, তখন ঘুমিয়ে পড়লাম কখন। সকালে ঘুম ভাঙেনি, পারভিন একবার ডেকেছিলো, একবার তাকিয়ে ঘুমিয়ে গেছি আবার। কলেজে যাবার সময় পারভিন আবার ডাকলো, বললাম, “তুই যা ভাই, আমি আজ আর বেরুবো না।” ও বেরিয়ে গেলে আমি নিরুপদ্রব ঘুমের প্রস্তুতি নিতে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিলাম। চোখ বন্ধ করতেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, সাথে পারভিনের গলা, “তুই কি আবার ঘুমিয়ে পড়লি পারমিতা?” আমি উঠে দরজা খুলে দিতেই পারভিন ঘরে ঢুকে বললো, “মাসুম ভাই গেইটে দাঁড়িয়ে আছেন; তোকে না-কি খুব জরুরি প্রয়োজন।”

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App