গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮ জুন ২০২১, ১২:১০ এএম
আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি বিশ্বের অন্য জাতি থেকে আমাদের করেছে আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তবে এখন আর খুব একটা দৃশ্যমান নয় বাংলা ও বাঙালি জাতির সংস্কৃতির ঐতিহ্যগুলো। আধুনিকতার স্পর্শ আর সভ্যতার ক্রমবিকাশে হাজার বছরের লালিত বাংলার প্রতিটি ক্ষেত্র আজ বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তন হচ্ছে আজ গ্রামবাংলার দৃশ্যপট। অতীতে গ্রামবাংলার প্রতিটি বাড়িতে বাড়িতে ছিল আমোদ-প্রমোদের কতই না আয়োজন! দিনান্তের ক্লান্তি শেষে প্রতিটি মানুষ তাদের নিজস্ব নীড়ে ফিরে রাতে বিনোদনের উদ্দেশ্যে সবাই একত্র হয়ে একটা বাড়িতে আসর জমাত। তখন বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ছিল বিভিন্ন পালাগান, যাত্রা, জারি-সারি, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, মারফতি, ভাওয়াইয়া, বাউল গানের আসর। পুঁথিপাঠও ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। একজন বসে পাঠ করত আর আসরের সবাই তা মনোযোগ দিয়ে শুনত। তারা এই আসরে বসে নিজেরা গল্পগুজব করত, হাসি-ঠাট্টা করত, নিজেদের সুখ-দুঃখ একে অপরে ভাগ করে নিত। মানুষগুলো একে অপরকে কত সহজে বিশ্বাস করত! তাদের মধ্যে ছিল সরলতা, ছিল নিবিড় আত্মার সম্পর্ক। কিন্তু এখন আর তেমনটা দেখা যায় না। আজ আমাদের সমাজ সুশীল সমাজ হিসেবে স্বীকৃত। এখানে নেই কোনো ভালোবাসা, নেই কোনো মানুষে মানুষে মমত্ববোধ। এ সমাজ কেমন যেন অস্থির হয়ে আছে। সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। সময় অতি দ্রুত চলে যাচ্ছে আর আমাদের জীবনের সাধ যেন অপূর্ণই থেকে যাচ্ছে। হিংসা-প্রতিহিংসায় চলছে আমাদের দিনাতিপাত। যদি অতীত আর বর্তমান অবস্থার মধ্যে তুলনা করা হয় তাহলে বিস্তর ফারাক দেখতে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের একটি বিখ্যাত প্রবন্ধের নাম ‘সংস্কৃতির ভাঙা সেতু’। এই প্রবন্ধে তিনি সেই সময়ের সংস্কৃতির চিরায়ত রূপ তুলে ধরেছেন। তিনি তার প্রবন্ধে বলেছেন বর্তমানে আমরা যে সমাজে বসবাস করছি তা শুধু সংস্কৃতির ভাঙা সেতুর সঙ্গেই তুলনা করা যায়। এমন হওয়ার একটাই কারণ আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে চর্চা না করা।
আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল গরুর গাড়ি, ঢেঁকি, যাতা, মাটির ঘর, লাঙ্গল-জোয়াল এবং বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খেলাধুলা। ফজরের নামাজ পড়ে কৃষক তার গরু আর লাঙ্গল-জোয়াল নিয়ে বের হয়ে পড়ত মাঠের উদ্দেশে। তার জায়গায় এখন দখল করে নিয়েছে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর। এক সময় সভ্যতার প্রয়োজনে ঢেঁকির আবির্ভাব ঘটেছিল। কয়েক দশক আগেও আমাদের প্রতিটি বাড়িতে প্রায়ই দেখা মিলত ঢেঁকির। কবি-সাহিত্যিকরা কতই না কবিতা রচনা করেছেন, ঢেঁকিতে ধান ভানতে গিয়ে কাঁকন আর নূপুরের শব্দের সমন্বয়ে যে পরিবেশ সৃষ্টি হতো তা নিয়ে বাউলরা কত গান গেয়েছেন! কিন্তু আজ এগুলো সবই যেন রূপকথার গল্পের মতো শোনায়। পঞ্চাশ দশকের দিকে শুরু হয় চাল কলের প্রচলন। তারপর থেকেই ঢেঁকি বিলুপ্তের পথে। গাড়িয়াল ভাইয়ের জন্য এখন আর কেউ পথ চেয়ে থাকে না। থাকবেই বা কেন মেঠো পথ ধরে চলা গাড়িয়াল ভাইদের দেখা এখন পাওয়ায় ভার। এখন আর মেলা হয় না, নৌকাবাইচও হয় না, হয় না পুতুল নাচ। এমন আরো অসংখ্য ঐতিহ্য আমাদের থেকে হারিয়ে গেছে। বর্তমানে তো এমনও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে যেখানে খেলার মাঠ পর্যন্তও নেই। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতারও অভাব রয়েছে। যেমন তেলের ঘানি, মৃৎশিল্প, নকশিকাঁথা, বুনুন শিল্প, লাঠিখেলা, বায়োস্কোপ এগুলোও এখন বিলুপ্ত প্রায়।
জানি, ঐতিহ্যকে কালের পরিক্রমায় উত্তীর্ণ হতে হয়, টিকে থাকতে হয় সামাজিক ও নান্দনিক প্রয়োজনে। যদি তা হতে ব্যর্থ হয় তাহলে এ ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে যাবেই। কিন্তু আমাদের বাঙালির শিকড়কেই যদি আমরা ভুলে যাই তাহলে আমাদের বাঙালিয়ানা থাকল আর কোথায়? বিশ্বায়নের এই যুগে সংস্কৃতির আদান-প্রদান এখন একটি বাস্তবতা আমরা সবাই জানি আবার এটাও জানি যে, আমাদের ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে কিংবা সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই উদাসীন। আমাদের কোথায় যেন একটা সংশয়, দ্বিধা থেকে যায়। তবে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যারা গবেষণা করেন তারা মনে করেন যে, বিশ্ব নাগরিক হওয়ার জন্য নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিলীন করে দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, নিজের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করেই বিশ্ব নাগরিক হওয়া সম্ভব। তাই আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে ব্যক্তিগত উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতারও প্রয়োজন জরুরি বলে মনে করছি।
রিম্পা খাতুন
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]