×

জাতীয়

মন্ত্রীর আশ্বাসে এনবিআরের না

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২১, ০৮:৫২ এএম

জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়ে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য না থাকায় অর্থনীবিদ থেকে শুরু করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান; এমনকি দেশে কাজ করা দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠানগুলোও অর্থমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানায়। কিন্তু একদিন পর বাজেট পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রীর আশ্বাসে হতাশ তারা। সেই সঙ্গে হতাশ সৎ করদাতারা। জাতীয় বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত এবং রাজস্ব আহরণকারী সরকারি সংস্থা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনোভাবেই আর কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিতে রাজি নয়। এনবিআর চায় অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী জরিমানাসহ নির্ধারিত কর দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা নেই। চলতি অর্থবছরের নির্ধারিত খাতে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা রিটার্নে প্রদর্শনের সুযোগ রাখা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে এনবিআর কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আয়ের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন করার সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি অর্থ সাদা করা হয়। অর্থাৎ রিটার্নে প্রদর্শিত হয়।

এনবিআরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ১০ হাজার ৪৩৭ করদাতা প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা করেছেন। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে কালো টাকা থেকে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এদিকে সরকারের বিশাল রাজস্ব আহরণের জোগান দেন এর বাইরের করদাতারা। কিন্তু তাদের আয় প্রদর্শন করতে সরকারকে ২৫ শতাংশ কর দিতে হয়েছে। তাই আয়করে এই বৈষম্য দেখতে চায় না এনবিআর। সংস্থাটি বলছে, কালো টাকার অবাধ সুযোগ থাকলে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবে। এতে করদাতাদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম নেবে। বাজেটপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া ?যদি লাভজনক হয়, তাহলে অব্যাহত রাখার জন্য আলোচনা করা হবে। অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগের কেউ পক্ষে আবার কেউ বিপক্ষে রয়েছে।

তিনি বলেন, অনেকে বলছেন এক্ষেত্রে সমাজে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে না। তাই বিষয়টি বিবেচনা করে আমরা আরো একমাস এটা দেখব। তারপর আলোচনা হবে। যদিও জাতীয় সংসদে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা বা বৈধ করার বিষয়ে কিছু বলেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের অর্থবিলেও এই বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। গত বাজেটে অর্থাৎ শুধু চলতি অর্থবছরের জন্য কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন ছাড়াই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। এবারে বাজেটে নতুন করে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়নি। চলতি অর্থবছরে যেসব খাতে এমন সুযোগ আছে- তা আগামী ৩০ জুন শেষ হয়ে যাবে।

কালো টাকা সাদা করার সুযোগ প্রসঙ্গে এনবিআরের করনীতির সদস্য মো. আলমগীর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তী সময়ে তার সেল ফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যায়নি। তবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক বাজেট প্রণয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত এনবিআরের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, এনবিআর অপ্রদর্শিত অর্থ ঢালাওভাবে রিটার্নে প্রদর্শন করার সুযোগ দেবে না। অপ্রদর্শিত অর্থ রিটার্নে প্রদর্শন করতে হলে নির্ধারিত আয়কর দেয়ার পর জরিমানা দিয়ে প্রদর্শন করতে হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

জানা গেছে, দেশে ঘোষণা দিয়ে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। এ পর্যন্ত মোট ১৭ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে এবং বৈধ করা মোট টাকার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি টাকা সাদা হয়েছে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। এর আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সুযোগ নিয়েছিল। তখন রেকর্ড পরিমাণ ৯ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা বৈধ করা হয়েছিল।

এসব বিষয়ে বিশ্ব^ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ ঢালাও সুযোগ দেয়ার বিষয়ে বিবেচনা অনেক হয়েছে। এই অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। ঢালাও সুযোগ বন্ধ করে দেয়া উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

এ বিষয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, বিশে^র কোনো দেশেই কালো টাকা সাদা করার এমন নিয়ম নেই। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নির্ধারিত কর দেয়ার পর জরিমানা দিয়ে অর্থ রিটার্নে প্রদর্শন করতে হয়। এছাড়া প্রতি বছরের জন্য আলাদা করে ইন্টারেস্টও দিতে হয়। কালো টাকা সাদা করার ঢালাও সুযোগ দিলে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবে। এতে করদাতারা বৈষম্যের শিকার হবেন।

আয়কর আইনজীবীরা বলছেন, আইনে কালো টাকা হলো অপ্রদর্শিত আয়। যে আয়ের কর দেয়া হয়নি। সেই আয় বৈধ এবং অবৈধ দুটোই হতে পারে। এনবিআর আয়কর নেয়ার সময় আয়ের উৎস জানতে চায় না। এখানে আয় বৈধ না অবৈধ সেটা আলাদা করার সুযোগ নেই। তবে খরচের খাত যখন দেখানো হয়, তখন আয়ের উৎস বলতে হয়। এটি আয়কর দেয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।

এ বিষয়ে ঢাকা ট্যাক্সেস বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সুফী মোহাম্মদ আল মামুন ভোরের কাগজকে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা বিনিয়োগের ঢালাও সুযোগ নেই। তাই চলতি অর্থবছরের বাজেটের এই সুযোগ জুন পর্যন্ত থাকবে। পরবর্তী সময়ে এই সুযোগ আর কাজে আসবে না। তবে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের আগের যে নিয়ম ছিল, সেই নিয়মেই অর্থ প্রদর্শন করা যাবে বলে জানান এই আয়কর আইনজীবী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App