মুসলিম লীগে মোহভঙ্গ থেকেই আওয়ামী লীগ
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২১, ০৮:৫৮ এএম
আওয়ামী লীগের একাল-সেকাল- ১
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট- যা ছিল মূলত মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ। পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কারণে রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষা, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে পদে পদে বৈষম্যের শিকার হন পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকরা। এসব কারণে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করলেও পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে তখনো দলটির একচেটিয়া দাপট ছিল।
এর মধ্যে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় চর ভাসানে দীর্ঘ সময় মুসলিম লীগের রাজনীতি শেষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকায় চলে আসেন। মুসলিম লীগ সরকারের ভয়ভীতি ও নির্যাতন উপেক্ষা করে তিনি নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। তারা একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। কিন্তু সেই সভা করার জন্য কোনো অডিটোরিয়াম পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহ্বান জানান।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে আড়াইশ থেকে তিনশ লোকের উপস্থিতিতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। নতুন দল গঠনের পর কার্যনির্বাহী কমিটি গঠনের দায়িত্ব পান মওলানা ভাসানী। সবার পরামর্শে কমিটি ঘোষণা করেন। নতুন কমিটির সভাপতি মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর ১০ মাসের মধ্যেই আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা কি ছিল- এর জবাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ ভোরের কাগজকে বলেন, ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে তিনটি রাষ্ট্রের কথা স্পষ্ট ছিল- পৃথক পাকিস্তান, পূর্ব বাংলা, আসাম ও পূর্ব ভারতের অংশ নিয়ে একটি রাষ্ট্র আর বাকি অংশ নিয়ে ভারত। বাস্তবে তা হলো না; বরং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হলো। কিন্তু পূর্ব বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি ঘটেনি। আমরা উপনিবেশে পরিণত হলাম। এই পরিস্থিতিতে সোহরাওয়ার্দী রণে ভঙ্গ দিলেও বঙ্গবন্ধু এই জাতি নিপীড়ন মেনে নিতে পারেননি। বাঙালির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ এবং ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্ম। পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের উত্থান। প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য বাঙালির অধিকার আদায়। বিশ্লেষকদের মতে, বিরুদ্ধবাদীদের ওপর মুসলিম লীগ সরকারের জুলুম-নির্যাতন এত বেড়েছিল যে তখন বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন সহজ ব্যাপার ছিল না। জানতে চাইলে ইতিহাসবিদ, প্রাইম এশিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, পাকিস্তানের কাছে এই বাংলার মানুষের যে প্রত্যাশা ছিল সেই প্রত্যাশার অপমৃত্যু ঘটে স্বল্প সময়ের মধ্যে। জনগণের প্রত্যাশা থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল মুসলিম লীগের অবস্থান। এ কারণে জনগণের দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক, লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িতরা সবাই মুসলিম লীগ করতেন। কিন্তু মুসলিম লীগে পরিবেশ ছিল না। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী নেতারা নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। ওই সময় মওলানা ভাসানী সভা ডাকলেন এবং তখনই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এভাবেই আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম। পরে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তনে দলেও পরিবর্তন আসে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগের ইতিহাস মানে বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও গৌরবের ইতিহাস। এ রাজনৈতিক দলটি এদেশের সুদীর্ঘ রাজনীতি এবং বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। রোজগার্ডেনে জন্মগ্রহণের পর থেকে নানা লড়াই, সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি এখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, প্রবীণ রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু ভোরের কাগজকে বলেন, পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে বঙ্গবন্ধু আখ্যায়িত করেছিলেন ‘ফাঁকির স্বাধীনতা’ বলে। সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালিদের অবস্থা এক শকুনির হাত থেকে আরেক শকুনির হাতে পড়ার মতো। বৈষম্য-শোষণের রাজনৈতিক পটভূমিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর ১০ মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে দেশের প্রথম বিরোধী দল- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।
আওয়ামী লীগ মানেই বাঙালী জাতীয়বাদের মূল ধারা। আওয়ামী লীগ মানেই সংগ্রামী মানুষের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশের কাদামাটি গায়ে মাখা খেঁটে খাওয়া মানুষের কাফেলা। অতীতের মতো বাংলাবাঙালী জাতির মুক্তির মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে গণতান্ত্রিকভাবে জন্ম নেয়া উপমহাদেশে আওয়ামী প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলও হচ্ছে আওয়ামী লীগ। স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা, সর্বশেষ সামরিক স্বৈরশাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তোরণ- এর প্রতিটি অর্জনের সংগ্রাম-লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী একটিই রাজনৈতিক দল, তা হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাঙালী জাতির প্রতিটি অর্জনেরও দাবিদার প্রাচীন ও সুবিশাল এই রাজনৈতিক দলটির।