×

মুক্তচিন্তা

দেশান্তরিতদের ভারতে নাগরিকত্ব প্রসঙ্গে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ জুন ২০২১, ১২:২৯ এএম

দেশান্তরিতদের ভারতে নাগরিকত্ব প্রসঙ্গে

নরেন্দ্র মোদি সরকার যখন দ্বিতীয়বার ২০১৯-এ ক্ষমতায় আসে তখন লোকসভার ৫৪৩ জন নির্বাচিত সাংসদের মধ্যে বিজেপি ও তার সহযোগীরা মিলে ৩৫০ জনের এক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে শাসনাধিষ্ঠিত হয়। মোদি সরকারের প্রথম কার্যকাল দেশে-বিদেশে উচ্চ প্রশংসিত হলেও সরকারের নিজস্ব আত্মতৃপ্তির জায়গায় কিছুটা হতাশা অবশ্যই ছিল। তার কারণ হচ্ছে বিজেপির একান্ত আপন বা মৌল নীতিগুলোর বাস্তবায়ন করতে না পারা। এর মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে অথবা সে ভয়ে ভারতে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, পার্শি, জৈন, শিখদের আইন সংশোধন করে নাগরিকত্ব প্রদান। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদান নিয়ে বিরোধীদের প্রবল প্রতিবাদ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সব আঞ্চলিক শক্তির তীব্র আন্দোলনের মুখেও মোদি সরকার তার প্রথম কার্যকালের শেষের দিকে লোকসভায় সংখ্যার জোরে বিধেয়কটি পাস করিয়ে নেয়। কিন্তু সংসদের উচ্চসদন অর্থাৎ রাজ্য সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় বিধেয়ক আটকে যায়। ২০১৯-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে কাশ্মিরের জন্য ৩৭০ ধারা বাতিল, রাম মন্দির নির্মাণের মতো ইস্যুগুলোর সঙ্গে ওই তিনটি দেশ থেকে আগত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টিও বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। ২০১৯-এর নির্বাচনের সময় উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রচারে এসে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিধেয়ক নিয়ে তুমুল প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ আসামে দাঁড়িয়ে অকম্পিত স্বরে মোদি ঘোষণা দিয়ে যান যে যদি তার সরকার এবার ক্ষমতায় আসে তবে তিনি অনতিবিলম্বে বিল পাস করিয়ে আইন বানাবেন। কারণ এটি ভারতীয় জনতা পার্টির মৌল নীতি এবং তিনি মা ভারতীর দেশান্তরিত সন্তানদের প্রতি দেশভাগের সময় যে অন্যায় হয়েছিল তার প্রায়শ্চিত্ত করবেন। সেদিনই দেশের মানুষ বুঝে গিয়েছিলেন যে মোদি তীব্র আন্দোলনের মুখেও কতটা আকুতভয় এবং সংকল্পে অনড়। মানুষের অনুমান বাস্তবে রূপ নিতে অবশ্য দীর্ঘ সময় লাগেনি। দ্বিতীয় কার্যকালের ১০০ দিনের মধ্যে তার সরকার কাশ্মিরের জন্য প্রযোজ্য ৩৭০ ধারা বাতিল করে। ন্যায়ালয়ের রায়ে রাম মন্দির নির্মাণের বাধা দূর হয়। নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আগত ওই ৬টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্ব প্রদানের ধারা সন্নিবিষ্ট হয়। যার ফলে এখন এই তিনটি দেশ থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-এর আগে ভারতে আসা ওই ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে সিলমোহর দেয়া হয়েছে। কিন্তু দেশে করোনা মহামারির প্রকোপে এখনো আইনের বিধি প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বিধি প্রস্তুত করার জন্য সংসদীয় কমিটির কাছে আরো ৩ মাস সময় চেয়ে নিয়েছে। এরই ফাঁকে গত ২৮ মে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের জারি করা এক নির্দেশ নিয়ে আবার রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে। বিরোধী দল ও একাংশ প্রাদেশিক সংগঠনের অভিযোগ হচ্ছে যে, যেহেতু মোদি সরকার দেশে করোনা মহামারির ফলে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য সংশোধিত আইনের বিধি প্রস্তুত করতে পারছে না তাই পেছনের দরজা দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আগত অমুসলিম মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদানের পথ খুলে দিচ্ছে। এ নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী সংগঠন যেমন সরব হয়েছে তেমনি ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব মুসলিম লিগ আরেক ধাপ এগিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন দাখিল করে এই নির্দেশ রদ করার আর্জি জানিয়েছে। ২৮ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের জারি করা নির্দেশের মূল কথা হচ্ছে গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং ছত্তিশগড়ের ১৩টি নির্দিষ্ট জেলায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে আসা ওই ছয়টি ধর্মাবলম্বী মানুষ নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। ভারতীয় রাজপত্র বা গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলো এবং জেলা শাসকদের তাৎক্ষণিকভাবে এই নির্দেশ কার্যকর করতে এবং কঠোরভাবে পালন করতে বলা হয়েছে। মুসলিম লিগের বক্তব্য হলো ধর্মের নামে ৩টি দেশের দেশান্তরিত মানুষকে নাগরিকত্ব প্রদানের আইন নিয়ে ইতোমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে প্রায় ৫০টি মামলা বিচারাধীন এবং এই আইন বলবৎ করার ক্ষেত্রে বাদীপক্ষ স্থগিতাদেশ চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র সরকারের জবাব ছিল যে যেহেতু এখনো এই আইনের বিধি এবং প্রণালি প্রস্তুত হয়নি তাই স্থগিতাদেশ অপ্রয়োজনীয়। তাই এ মুহূর্তে নতুন করে ওই তিন দেশ থেকে আগত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব প্রদানের পদক্ষেপ বেআইনি এবং আদালতকে দেয়া প্রতিশ্রুতিরও লঙ্ঘন। এ ধরনের নির্দেশ যে এবারই প্রথম জারি হয়েছে তা নয়। ২০১৬ সালেও দেশের ৭টি রাজ্যের নির্দিষ্ট কিছু জেলায় বসবাসকারী ওই শ্রেণিভুক্ত মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদানের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ফলে যারা পাসপোর্টের মতো বৈধ নথি নিয়ে ভারতে এসেছেন এবং পাসপোর্টের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে তারা যেমন ভারতে থাকার সুবিধা পাচ্ছেন তেমনি বৈধ নথিপত্র ছাড়া যারা ভারতে এসেছেন তারাও এখানে থাকতে পারছেন। তবে শর্ত হচ্ছে তাদের এলটিভি অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি ভিসা পেতে হবে। এখানেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯-এর সঙ্গে জোড়া নোটিফিকেশনের তফাত। জোড়া নোটিফিকেশনে নাগরিকত্ব পেতে গেলে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা হচ্ছে পূর্বশর্ত। এখানে নাগরিকত্ব দুটি প্রক্রিয়াতে হয়, এক. পঞ্জিয়ন [by registration] দুই স্বাভাবিকরণ [by naturalization]. কিন্তু সংশোধিত আইনে নাগরিকত্ব পেতে এলটিভি থাকা বা না থাকার প্রশ্ন নেই। কিন্তু দুবারের এই নির্দেশে আসাম বা পশ্চিমবঙ্গের কোনো উল্লেখ না থাকায় বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুরা এই নোটিফিকেশনের সুফল এ পর্যন্ত পাননি। তবে এবারই প্রথম খুব তাৎপর্যপূর্ণভাবে সরকার গত ১৯ মার্চ এক নির্দেশ দিয়ে আসামের পুলিশ সুপারদের এবং ফরেনার্স রেজিস্ট্রেশন অফিসারকে জোড়া নোটিফিকেশনের অধীনে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা প্রাপকদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে বলেছে। আসামে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা পেয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা অতি নগণ্য। কেন প্রায় নেই, কেন এখানে অভিবাসীদের নাগরিকত্ব প্রদানে এত তুমুল বিরোধিতা তার একটি বাস্তবিক প্রেক্ষাপট একটু আলোচনা প্রয়োজন। ১৯৮৫-তে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর উপস্থিতিতে আন্দোলনকারী সংগঠন সারা আসাম ছাত্র সংস্থা, গণসংগ্রাম পরিষদ, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার এক ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা ‘আসাম চুক্তি’ নামে বিখ্যাত। এখানে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এটাও মীমাংসা হয় যে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর আগে আসামে আসা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকে পঞ্জিয়নের ভিত্তিতে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করা হবে। রাজীব গান্ধী সরকার সংসদে চুক্তির এই অংশটুকু পাস করিয়ে ভারতের নাগরিকত্ব আইনে সন্নিবিষ্ট করেন। ফলে যেখানে সমগ্র ভারতে নাগরিকত্বের কাট অব ইয়ার ১৯৫১ সেখানে মানবিক কারণে আসামের ক্ষেত্রে তা ১৯৭১। তাই ২৪ মার্চ ১৯৭১-এর মধ্যরাত্রির পর হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে একজনকেও গ্রহণ করতে রাজি নয় জাতীয়তাবাদী দল সংগঠনগুলো। তাই দীর্ঘমেয়াদি ভিসা প্রাপকের সংখ্যা আসামে নেইর বরাবর। কারণ ভিসা পেতে গেলে প্রথমেই আবেদনকারীকে স্বীকার করতে হবে যে তিনি বহির্দেশ থেকে এসেছেন এবং ভিসার মেয়াদোত্তীর্ণ হলেই তাকে দেশত্যাগ করতে হবে অন্যথায় তিনি বিদেশি তকমা নিয়ে ন্যায়াধিকরণে বিচারযোগ্য আসামি হবেন। এখানে আরেকটা প্রাসঙ্গিক কথা উল্লেখ প্রয়োজন যে আসামের বিদেশি সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধানে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে বিদেশি শনাক্তকরণের জন্য ইতোমধ্যেই নাগরিকপঞ্জি উন্নীতকরণ প্রক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে এবং ৩১ আগস্ট ২০১৯-এ প্রকাশিত তালিকায় ১৯ লাখ ৬ হাজার মানুষ বৈধ নথিপত্রের অভাবে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। আসাম সরকার অবশ্য নিজেই এই তালিকায় কিছু বিসঙ্গতি আছে বলে তালিকাটির পুনর্বার যাচাই চায় এবং নাগরিকপঞ্জি বিষয়ক রাজ্য সমন্বয়ক সুপ্রিম কোর্টে এ সংক্রান্ত একটি আবেদন গত ১১ মে দাখিল করেছেন, যা এখনো শুনানির জন্য গৃহীত হয়নি। এ বিষয়ে আদালত কী সিদ্ধান্ত নেয় তা সময় বলবে। তবুও এটুকু বলা যায় যে যেহেতু গত ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর দেশে এ মুহূর্তে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বহাল আছে এবং অনুমান যে করোনা অতিমারির প্রকোপ একটু নিয়ন্ত্রণে এলেই বিধি পেশ করা হবে, তাই ধর্মীয় নির্যাতনের ফলে এদেশে আসা সেইসব অভিবাসীর ভাসমান জনগোষ্ঠী হয়ে থাকার দিন শেষের পথে। সে সঙ্গে এটাও প্রায় স্পষ্ট যে নাগরিকপঞ্জি উন্নীত করার ফলে সেই তালিকা থেকে আখেরে যারা বাদ পড়বেন তারাও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সুবিধাপ্রাপক হলে বেঁচে যাবেন!

দীপঙ্কর ঘোষ : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App