×

মুক্তচিন্তা

এই যুদ্ধবিরতি কতটা স্থায়ী হবে?

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২১, ১২:৩১ এএম

করোনার প্রকোপ পুঁজিবাদকে কাবু করেনি, কাবু করেছে মানুষকে। পুঁজির মালিকরা এই সুযোগে ভালো মুনাফা করে নিচ্ছে। আবার করেনাকালেই তো বোঝা গেল অত্যাশ্চর্য উন্নতি ও উদ্ভাবনের ভেতরে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থাটা কতটা নাজুক। গরিব দেশে তো অবশ্যই, ধনী দেশেও। এবং এরই ভেতর পুঁজিবাদ-সৃষ্ট পুরনো উৎপাতগুলো নবীন উৎসাহে খলবল করে উঠেছে। যেমন, ধর্মীয় মৌলবাদ। ইসরায়েলের উন্নতি তো চমকপ্রদই। করোনাকালে তারা গ্রহণ-সক্ষম সকল নাগরিককে টিকা দিয়ে ফেলেছে। তাদের গোয়েন্দারা পৃথিবীর সর্বত্র তৎপর ও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের অভ্যন্তরে গিয়ে অনায়াসে হানা দিচ্ছে, হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। কিন্তু এরই মধ্যে দেখা গেল ধর্মীয় মৌলবাদী ওই রাষ্ট্রে একটি ধর্মীয় সমাবেশে ৪৪ জন মানুষ পদদলিত হয়ে মারা গেছে, যে ঘটনার কথা আমরা একটু আগে উল্লেখ করেছি। হামাসের রকেট হামলায় একজন নাগরিক মারা গেলে যেখানে বোমারু বিমান উড়িয়ে বিশ-ত্রিশ জনকে মেরে ফেলে, তবুও শান্ত হয় না, সেখানে নিজেরাই নিজেদের ৪৪ জনকে হত্যা করে ফেলেছে। সংবাদটি যখন পাওয়া গেল তখনই অনুমান করা গেছে ফ্যাসিবাদী ওই রাষ্ট্র আরো কিছু ঘটাবে। ঘরে যে হিংস্র, বাইরে কি সে শান্ত থাকবে? ঠিক তাই! চড়াও হয়েছে ফিলিস্তিনিদের ওপর। উদ্দেশ্য জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় উন্মাদনাকে জাগিয়ে তুলে সম্প্রসারণ বৃদ্ধি করা। জেরুজালেমকে তারা নিজেদের রাজধানী ঘোষণা করেছে, সেখানে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি সেগুলো ভেঙে নগরীর উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা বাধা দিতে গিয়েছিল। সেই প্রতিবাদকে অজুহাত করে রাবার বুলেট নিক্ষেপ সাধরণ মানুষ মারা হচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায় হামাস কিছু রকেট নিক্ষেপ করেছে, যেমনটা তারা করে থাকে। সম্প্রতি ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞে ২৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যাদের ৬৬ জনই শিশু। ঘরবাড়ি ছেড়ে যে কোনো আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি করেছে হাজার হাজার মানুষ। ১১ দিনের সহিংসতার পর কার্যকর হল যুদ্ধ বিরতি। ইসরায়েল ও হামাস দুইপক্ষেই এবারের সংঘাতে তাদের জয় দাবি করছে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আরব রাষ্ট্রগুলো দাঁড়াবে বলে এতকাল আশা করা হতো; সে-আশা এখন মরে গেছে; বেশ ক’টি রাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলেছে, অন্যরাও আগ্রহী। তাদের সবার হয়ে সৌদি আরবের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এতে সুবিধা হবে’। অবশ্যই হবে। তবে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের নয়, পীড়নকারী ইসরায়েলেরই। আর হবে ওই মুসলিম স্বৈরশাসকদের। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের যে লড়াই এটি আদতেই কোনো ধর্মযুদ্ধ নয়; এটি হচ্ছে দখলদারদের বিরুদ্ধে উৎপাটিতদের প্রতিরোধ। ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় উপেনের জমি যে দখল করে নেয় ধর্মপরিচয়ে সেও উপেনের মতো একজন হিন্দুই ছিল, কিন্তু দখলদার হিসেবে তার ধর্মীয় পরিচয় নয়, জমিদার পরিচয়টিই ছিল একমাত্র সত্য। ফিলিস্তিনিরা মার খাচ্ছে মুসলমান হিসেবে নয়, দুর্বল জনগোষ্ঠী হিসেবেই। ধর্মযুদ্ধ হলে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান রাজাবাদশা ও শাসকদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ছিল। সেটা তারা করেনি। সাড়াই দিচ্ছে না। প্রতিরোধ সংগ্রামে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নিরন্তর যিনি লিখেছেন ও বক্তৃতা করেছেন, বিশ্ববাসীকে সমস্যাটির বিষয়ে জানিয়েছেন, তিনি হচ্ছেন এডওয়ার্ড ডব্লু সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩); ধর্মপরিচয়ে তিনি ছিলেন খ্রিস্টান। আর সশস্ত্র প্রতিরোধ নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা তাদের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ধর্ষ ছিল যে পপুলার ফ্রন্ট তার নেতা জর্জ হাবাশও (১৯২৬-২০০৮) মুসলমান ছিলেন না, ছিলেন খ্রিস্টানই। জর্জ হাবাশের নেতৃত্বাধীন পপুলার ফ্রন্ট যুদ্ধটাকে সমরবাদে সীমিত রাখেনি, নিয়ে গিয়েছিল মনস্তাত্ত্বিক স্তরেও। তার পরিকল্পনাতে বিমান হাইজ্যাকের অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর সব ঘটনা ঘটেছে; ইউরোপে ইসরায়েলি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান ও দূতাবাসে হামলা হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা বুঝে নিয়েছে যে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতটা অত্যন্ত গভীর, মনের জোরও কেমন প্রচণ্ড। তাদেরকে ধমকে বা প্রবোধে নিবৃত্ত করা যাবে না। জর্জ হাবাশ ‘অসলো চুক্তি’র দুই-রাষ্ট্র নীতি মানতেন না। তার সংগঠনের বক্তব্য ছিল রাষ্ট্র হবে একটাই, আর তার চরিত্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক; সে রাষ্ট্রে ইহুদি, মুসলমান, খ্রিস্টানে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, সকলেরই থাকবে সমানাধিকার। ১৯৬৯ সালে নিজেদের সংগঠনটিকে তারা একটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিতে রূপান্তরিত করেন। স্বভাবতই তারা সুবিধা করতে পারেননি। ইসরায়েলের আক্রমণ তো ছিলই, ছিল উৎখাতের জন্য সিআইএর অবিরাম তৎপরতা। জর্ডানের বাদশাসহ আশপাশের সব মুসলিম শাসক ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিভাজন এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনও পপুলার ফ্রন্টকে আঘাত করেছে। ওদিকে জর্জ হাবাশের নিজের স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়ছিল; শেষ দিকে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন ক্যান্সারে। কিন্তু তার মনে কোনো অসুখ ছিল না। শিক্ষায় ও পেশায় এই চিকিৎসক লড়াইয়ের ময়দান থেকে কখনো সরে যাননি। তিনি জানতেন ইসরায়েলকে তোয়াজ করলে কুলাবে না, মধ্যস্থতাকারীদের ওপর ভরসা করাটা হবে আত্মঘাতী; লড়াইটা করতে হবে নিজেদেরকেই, আর সেটা হবে সর্বাত্মক। ‘দুই রাষ্ট্রের’ নীতি শেষ পর্যন্ত ‘এক রাষ্ট্রের’ নীতিতেই পরিণত হওয়ার অভিসন্ধিতে রয়েছে। আর সেটি হবে ইসরায়েলের ইহুদিবাদী রাষ্ট্র; সেখানে ফিলিস্তিনিদের থাকতে হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবেই। পপুলার ফ্রন্টকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে; ইয়াসির আরাফাতের আপসপন্থিরাও শেষ পর্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাদের জায়গাতে এসেছে হামাস ও ইসলামী জিহাদ; নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়কে যারা প্রধান করে তুলছে চায়। লড়ছে এখন তারাই। পশ্চিমারা হামাসকে বলে সন্ত্রাসবাদী, কিন্তু তারা এইটুকু জেনে নিশ্চিত আছে যে, হামাস আর যাই করুক একেবারে গোড়া ধরে টান দেবে না, সমাজ বিপ্লব ঘটাবে না। মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চালাবার অভিপ্রায় বা ক্ষমতা কোনোটাই তাদের নেই। সমাজতন্ত্রী পপুলার ফ্রন্টকে সরিয়ে দেয়ার ফলে সুবিধা হয়েছে সব পক্ষেরই; ইসরায়েলের, পশ্চিমা বিশ্বের এবং ফিলিস্তিনের মৌলবাদীদেরও। পপুলার ফ্রন্টের নেতৃত্বে পরিচালিত হলে ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রাম ভিন্ন রূপ নিত। ইসরায়েল বড়াই করে যে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে তারাই একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে একটি কমিউনিস্ট পার্টি আছে। পপুলার ফ্রন্ট শক্তিশালী হলে কে জানে ইসরায়েলের কমিউনিস্টরাও হয়তো বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত হতো।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App