×

মুক্তচিন্তা

হারিয়ে যাচ্ছে রূপলাল হাউস

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২১, ১২:১০ এএম

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার মধ্যে রূপলাল হাউস অন্যতম। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে এই রূপলাল হাউস। এই হাউসটির বেশিরভাগ অংশই দীর্ঘকাল ধরে বেদখল হয়ে রয়েছে। হাউসটি পুরান ঢাকার শ্যামবাজারের পাশে উনবিংশ শতকে নির্মিত একটি ভবন। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পারে ফরাশগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত।  কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে ইতিহাস। হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে এই বাড়িখানাও। কথিত আছে, এককালে ব্রিটিশরা ঢাকা এলে রূপলাল হাউসে রুম ভাড়া নিয়ে থাকত। তৎকালীন আমলে রুম ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। ঢাকার নবাব আর রূপলাল বাবুদের মধ্যে একটা ঠাণ্ডা যুদ্ধ সব সময় লেগে থাকত। সে সময় ঢাকা শহরে নাচঘর বা বলরুম ছিল শুধু আহসান মঞ্জিল আর রূপলাল হাউসে। ১৮৮৮ সালে কোনো এক সময় লর্ড ডাফরিন ঢাকায় এলো। তার সম্মানে নাচ গানের আসর বসবে এই নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে ঢাকার নবাব আর রূপলাল বাবুরা। সে সময় অনেক বেশি ভোটে বিজয়ী হয় রূপলাল হাউস। পান মসলার আড়তের ভিড়ে হারিয়ে গেছে তার পুরান আধিপত্য। দেবোত্তর সম্পত্তি এখন জামাল বাবুদের দখলে। সে আরেক ইতিহাস। রূপলাল হাউস যে আমাদের ঐতিহ্য ছিল সে কথাও হয়তো কিছুদিন পর মানুষ মনে রাখবে না। এই ভবনটি ৯১ দশমিক ৪৪ মিটার দীর্ঘ একটি দ্বিতল ভবন। দ্বিতল এই ভবনের স্থাপত্যশৈলী অভিনব। এটি জমিদার ও বণিকদের তৈরি। যাকে ইউনিক বলেছেন স্থাপত্যবিদরা। এর পেছন ভাগে বুড়িগঙ্গা নদী প্রবহমান। ভবনটি নির্মাণ করেন হিন্দু ব্যবসায়ী ভ্রাতৃদ্বয় রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। এটি বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর পারে ফরাসগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত। রূপলাল ঢাকার বিখ্যাত আর্মেনীয় জমিদার আরাতুনের কাছ থেকে বাড়িটি কিনে পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। এর নির্মাণকাল উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক। মার্টিন অ্যান্ড কোং কোম্পানির একজন স্থপতি এর নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। দ্বিতল এই ভবনের স্থাপত্যশৈলী অভিনব। এটি দুটি অসম অংশে বিভক্ত, যার প্রতিটিতে কিছুটা ভিন্ন স্থাপত্যশৈলী দেখা যায়। রূপলাল হাউসে দ্বিতীয় তলায় দুটি অংশে বিভিন্ন আয়তনের মোট ৫০টিরও বেশি কক্ষ রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে কয়েকটি প্রশস্ত দরবার কক্ষ। ভবনের পশ্চিমাংশে দোতলায় অবস্থিত নাচঘরটি আকর্ষণীয়ভাবে তৈরি। এর মেঝে ছিল কাষ্ঠনির্মিত। পুরো বাড়িজুড়ে উত্তর-দক্ষিণ পাশে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দা দুটি ইট-নির্মিত ‘সেমি-কোরিনথীয়’ স্তম্ভ বা সমায়ত ইটের স্তম্ভের ওপর সংস্থাপিত। নদীর দিকে সম্মুখভাগে ভবনের চূড়াতে একটি বড় ঘড়ি ছিল, যা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ার পর আর ঠিক করা হয়নি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগকালে রূপলালের উত্তরাধিকাররা ঢাকা ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। খাতা-কলমে রূপলাল হাউস এখনো টিকে আছে। এটিকে জামাল হাউস নামেই বেশিরভাগ লোক চিনে। সাম্প্রতিককালে রূপলাল হাউস মসলা ও সবজি ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গিয়েছিল। সরকারিভাবে এই স্থাপনাটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণার পর আজ পর্যন্ত ভবনটি সংরক্ষণে আনতে পারিনি সরকার। চতুষ্কোণ বাড়িখ্যাত রূপলাল হাউসকে ঘিরে শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।  দিন দিন দেয়াল থেকে চুন-সুড়কির আবরণ খসে পড়ছে। ভবনের অনেকটা অংশ ভেঙেও গিয়েছে। দেয়ালে গজিয়েছে বটগাছ। ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলো ভেঙে গেছে। এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়ও সেখানে বসবাস করছে বেশ কিছু পরিবার। কিন্তু ভবনটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ কোথাও চোখে পড়েনি। ভবনের নিচে গড়ে উঠেছে মসলার বাজার। দেখা গেছে, এই ভবনটিতে ৫০টির অধিক কক্ষ রয়েছে এবং কয়েকটি প্রশস্ত দরবার কক্ষ রয়েছে। এক সময় রূপলাল হাউস মসলা ও সবজি ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। বাড়িটি এখন ধ্বংসের মুখোমুখি এবং সব কক্ষসহ এর প্রাঙ্গণ বেদখল। ভেতরে যেতে বাধা দেয় অনেকেই। তারা ক্যামেরা দেখলে ভয় পান। ছবি তুলতে গেলে করেন নানা ধরনের প্রশ্ন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া স্বাভাবিক-রূপলাল হাউসে আসিনি। পুরানা ঢাকার বিস্মৃতির অন্তরালে ঢাকা পড়া কোনো জায়গায় আসিনি, আসিনি এক সময়ের পুরান ঢাকার জৌলুসপূর্ণ কোনো বাড়িতে। এসেছি, কোনো এক মসলার আড়তে। এই হলো রূপলার হাউসের বর্তমান পরিণতি। প্রাচীন এ নিদর্শনগুলো রক্ষা করার জন্য একটি বড় ধরনের বিনিয়োগ সরকারকেই করতে হবে। পৃথিবীর অনেক দেশে সংরক্ষিত ঐতিহ্যবাহী এলাকা আছে। আমাদের দেশেও আছে। এতে করে আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি বিদেশি অনেক পর্যটককে আকর্ষণ করা সম্ভব। মেহেরাবুল ইসলাম সৌদিপ শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App