×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতি ও যুবসমাজের বিকৃতি এড়িয়ে সুস্থ জীবন চাইলেও স্বস্তির বার্তা নেই!

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২১, ১২:১২ এএম

মহামারি করোনার দীর্ঘ মেয়াদি গৃহবাস কিংবা অস্বাভাবিক জীবনযাপনের ফলে মানুষের মধ্যে ক্রমে হতাশাই ঘনীভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ের নানা ঘটনা ও উপপ্লব দেখে আমাদের মনে এমন ধারণাই জন্মে। ঘনীভূত হতাশা কখনো কখনো মানসিক বিকৃতিকেও প্রকট করে তুলছে দিন দিন। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেই এই বিকৃতি যেন জেঁকে বসেছে ইতোমধ্যে। আমরা আমাদের সব কর্মকাণ্ডে সেই বিকৃতির প্রতিচ্ছবিই মূর্ত করে তুলি। আমাদের চারদিকে তাকালে সেই বিকৃতির প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। কণ্ঠস্বরেও শুনতে পাই বিকৃতির প্রতিধ্বনি। রাজনীতি, শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসায়, শিক্ষা এমনকি সামাজিক জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গে বিকৃতির নিরন্তর অনুরণন ঝংকৃত হয়ে ওঠেÑ এর থেকে যেন মুক্তিও নেই! বিকৃতির এই বিস্তৃত শৃঙ্খল-জাল আমাদের জীবনকে চারদিক থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে! করোনার করাল গ্রাসের জন্য নাকি অন্য কোনো আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক প্রপঞ্চের জন্য তা বলা কঠিন হলেও এর সঙ্গে আমাদের স্বভাবদোষও যে দায়ী সে কথাও মেনে নেয়া ভালোÑ মেনে নিতে হবে। এক. বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিএনপির নেতৃবৃন্দ সম্প্রতি যে ভাষায় বক্তৃতা, বিবৃতি এবং আন্দোলনের ডাক দেয়া শুরু করেছেন তাতে সুস্থ রাজনীতিচর্চার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচার এবং বেপরোয়া অগণতান্ত্রিক আচরণে আপাদমস্তক আচ্ছন্ন বিএনপির নেতারা বর্তমান সরকার উৎখাতের জন্য যেসব সুনীতিসুলভ বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন তা যে কেবল মিথ্যাচারই নয়Ñ হাস্যকরও বটে। তারা কী করে তাদের দুঃশাসনের সময়কালের কথা ভুলে যান, কেন যে তারা নিজেদেরই সৃষ্ট ইতিহাস ভুলে যান সাধারণের কাছে তাই-ই বিস্ময়ের বিষয়! বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে আওয়ামী লীগের নাম-নিশানা ও অস্তিত্ব মুছে ফেলার জন্য হেন অপচেষ্টা ছিল না, যা বিএনপি করেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে শুরু করে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে বিএনপির দুরভিসন্ধিমূলক অপরাজনীতিরই পরিচয় প্রকট হয়ে ওঠে। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পাঁয়তারায় নানাভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠার মধ্যেও দলটির প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের বাক-বিকৃতির প্রকাশ ঘটেছে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে হঠাৎ করে সরকার বিদ্বেষী জ্বালাময়ী বক্তৃতায় মাঠ গরম ও সরকারের পতন ঘটানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন তাও দেখা গেল। তাদের এসব আয়োজন এবং সরকার পতনের লক্ষ্যে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণে কর্মীদের তৈরি থাকার নির্দেশের মধ্যে সুস্থতার চেয়ে অসুস্থ কথাবার্তাই আমরা বেশি শুনলাম। বিগত ১২ বছর ধরে দেশের সাধারণ মানুষের গণপ্রত্যাশার কথা বলে বিএনপি একদিনের জন্যও কোনোরূপ সফল কর্মসূচি তথা আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেনি। তবে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রের ভেতর দানা বেঁধে ওঠা বিভিন্ন আন্দোলনের ভেতর অনুপ্রবেশ করে সেখান থেকে ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় তৎপর ছিল তা দেখা গেছে। এসবের মধ্যে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের সমাবেশ, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলন এবং কোটাবিরোধী আন্দোলন অন্যতম। সাম্প্রতিক সময়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে ঘিরে সৃষ্ট বিক্ষোভে তারা হেফাজতে ইসলামের ঘাড়ে পা রেখে সরকার পতনের উসকানি দিয়েছেন। কিন্তু তাদের সে প্রতীক্ষা ও পরিণতি হয়েছিল চৈত্রের চাতক পাখির মতোই। দিন দিন দলটি নানা কর্মকাণ্ডে নিজেদের ব্যর্থ প্রমাণ ছাড়া আর কিছু করতে পেরেছে বলে সর্বসাধারণের স্মৃতিতেই নেই! সাবেক হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ অন্যরা গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে যেসব তথ্য দিয়েছেন তাতে ধর্মীয় পোশাকের আড়ালে তারা যে চরম বিকৃত জীবনাচারে অভ্যস্ত ছিলেন তাও বেরিয়ে এসেছে। এসব তথ্য সাধারণের মনোজগতে পীড়াদায়ক অনুভূতির সঞ্চার ঘটিয়েছে। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বহুসংখ্যক মাদ্রাসায় অগণিত এতিম শিশুর ধর্ষণের ঘটনার মধ্য দিয়েও স্থানীয় ও সামাজিকভাবে নেতৃত্ব দানকারী এই মোল্লাগোষ্ঠীর বিকৃত আচরণ মানুষকে ব্যথিত করে তুলেছে। এরূপ ঘটনার সংখ্যানুপাতও আমাদেরকে শঙ্কিত করেছে। দুই. সম্প্রতি যুবসমাজের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া মানসিক বিকৃতির ঘটনায়ও আমরা শঙ্কিত। খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপকর্মে সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়াও নেশা জাতীয় নতুন নতুন মাদকের প্রতি তাদের আকর্ষণ জাতির জন্য ভয়াবহ বার্তা দেয়। যুবসমাজের ভেতরমহলে চোখ মেলে তাকালে হয়তো দেখতে পাব নানা রকম নামিদামি ব্র্যান্ডের মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে তাদের যৌবরাজ্য! প্রায়ই আমরা বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশি অভিযানে উদ্ধারকৃত যে বিপুল পরিমাণ মাদকের তথ্য পাই তাতেও আশঙ্কিত না হয়ে পারি না। এই যুবসমাজ যদি অশিক্ষিত ও অক্ষর জ্ঞানহীন হতো তাহলে আমাদের আফসোস হয়তো কম হতো। দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এলিট শ্রেণির যুবকদের মধ্যে মরণনেশার নানা মাদকের ব্যবহার আমাদের ভাবিয়ে তোলে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের (সবাই নন) মধ্যে বিভিন্ন রকমের মাদকের রমরমা অবস্থার কথা আমরা আগে স্বাভাবিক অবস্থায়ও শুনেছি। শুধু প্রাইভেট নয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও মাদক-ছোবলের বাইরে আছে এমনটি মনে করার কারণ নেই। তবে এক্ষেত্রে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র ভিন্নতর। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আর্থিক সঙ্গতিই যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাদকাসক্তির মূল কারণ তা আর উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। নাগরিক ধনাঢ্য পরিবার থেকে আসা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নানা পন্থায় ‘সফিস্টিকেটেড’ বিদেশি মাদকের আমদানিতে সিদ্ধহস্ত! কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের অপঘাত মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুলিশি অভিযানে নানা ধরনের মাদক সম্পর্কে ‘থলের বেড়াল’ বেরিয়ে আসছে। জানা যাচ্ছে বিচিত্র নামের বিদেশি মাদকের নাম। তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এসবের আমদানি ও বিতরণ হচ্ছে বিচিত্র পন্থায়। সম্প্রতি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকের প্রতি বিকৃত আসক্তির ধারাবাহিক ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় যুবসমাজকে নিয়ে আমাদের যে উচ্চাশা ছিল তার মর্মমূলে অনবরত তীব্র কুঠারাঘাত পড়ে চলেছে! যুব মানসের এই বিকৃত আসক্তিও কি করোনাকালীন গৃহবাসের হতশ্বাস নাকি তরুণদের স্বভাবের দোষ, মানসিকতা ও মানবিকতার বিকৃতি? তিন. এক বছর তিন মাস পেরিয়ে গেল আমাদের গৃহবন্দি জীবনযাপনের, কর্মহীন জীবনযাপনের, ভীতি মিশ্রিত আশঙ্কিত জীবনযাপনের। শঙ্কা আমাদের জীবন থেকে বিদূরিত হচ্ছে না কোনো ক্রমেই। আবার করোনা মহামারির চলমান দুর্যোগ থেকে প্রকৃত অর্থেই আমরা কায়মনে নিষ্কৃতি চাই কি না তা নিয়েও বিস্তর সন্দেহ মনের ভেতর দানা বাঁধে। আমাদের নিজেদেরই লালিত স্বভাবদোষ অনেক সময় শঙ্কা-আশঙ্কা ও সন্দেহ আমাদের আরো বাড়িয়ে তোলে। আমরাও নানাভাবে নিজেরাই নিজেদের স্বভাবের দোষে ভয়, ভীতি ও আতঙ্কে আমন্ত্রণ জানিয়ে দুর্ভোগ বাড়িয়ে চলি, চলছিও নিরন্তর! ঈদ বলি, শপিং বলি সর্বত্রই আমরা নিয়ন্ত্রণহীন। ‘নাড়ির টানে’ বাড়ি যাওয়ার জন্য আমরাই পাগলপারা হয়ে ছুটেছি। সংক্রমণের কথা, পরিণতির কথা বিন্দুমাত্র ভাবিনি। আমরা যখন ভারত থেকে দেশে ফিরেছি তখনো স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোয়ারেন্টাইন করিনি, করোনাক্রান্ত হয়েও যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণের বদলে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছি! এভাবেই বাংলাদেশ ভূখণ্ড ঘিরে থাকা ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করেছে করোনা ভাইরাসের ভারতীয় তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলার অনেক অঞ্চল করোনার প্রকোপে যখন দিশাহারা ও লকডাউনে আবদ্ধ, সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা আবারো যখন ক্রমবর্ধমান হারে ঊর্ধ্বমুখী তখনো আমরা আমাদের স্বভাবের গলায় লাগাম পরাতে পারছি না! আমরা যেন পঙ্গপালের মতো মৃত্যুর দিকেই ধাবমান হয়ে উঠেছি! আর ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছি চারদিক। ফলাফল হিসেবে শুনলাম, আন্তর্জাতিক একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে শনাক্ত করেছে! অর্থাৎ আশঙ্কার খবরই সর্বত্রÑ স্বস্তির কোনো বার্তাই নেই! ঈদের পর থেকে পুনরায় মৃত্যু ও সংক্রমণ হার ঊর্ধ্বমুখী তার ওপর ভ্যাকসিন প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা আমাদের অনেককে তিলমাত্রও বিচলিত করছে না! কোনো এক অজানা আলোর উদ্দেশ্যে আমরা পতঙ্গের মতো ছুটছি, জানি সেখানেই মৃত্যুÑ তবু থামছি না। অনিশ্চিত জীবন ও নিশ্চিত মৃত্যুর দিকেই আমাদের কী দারুণ এক অভিযাত্রা! আমাদের এই খানিকটা বিকৃত স্বভাবের দোষেই আজ সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে নতুনরূপে আতঙ্ক সৃষ্টি হচ্ছে! অন্যদিকে ভ্যাকসিন স্বল্পতা নিয়েও আমরা গভীর দুশ্চিন্তায় মগ্ন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হতশ্বাস উচ্চারণে শুনতে পাইÑ ‘অনেক দেশ ভ্যাকসিন দেবে বলে, কিন্তু তারা কোনো দিন-তারিখ বলে না।’ এটি যে এক ধরনের অসহায় উক্তি তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেয়া প্রায় ১৪ লাখের মতো মানুষ দ্বিতীয় ডোজের জন্য অপেক্ষা করছেন। দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে তাদের অপেক্ষার পরিণতিই বা কী সে সম্বন্ধেও কেউ কিছু বলতে পারছেন না। এই মানুষগুলোর অস্বস্তি দূর করার মতো স্বস্তির সংবাদ এখনো নিশ্চিত হয়নি। কী ভীষণ এক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে আমাদের জীবনযাপন চলছে! কিন্তু আমরা তো মুক্তি চাই। করোনার অবসানসহ রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসুক আমাদের জীবনে। সব মানুষের শুভ, সুস্থির ও মানবিক চিন্তায় আমাদের বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলো সহজ হয়ে উঠুক। মুক্তি ও স্বস্তির বার্তায় ভরে উঠুক আমাদের সব ধরনের গণমাধ্যম। আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App