×

জাতীয়

পৌরসভায়ও আমলাতন্ত্রের হাত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২১, ০৮:৩৩ এএম

পৌরসভায়ও আমলাতন্ত্রের হাত

পৌরসভা

পৌরসভায়ও আমলাতন্ত্রের হাত

পৌরসভা

আইন ও অধ্যাদেশ এবং সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের আমলকে ঢাল বানিয়ে দেশের পৌরসভাগুলোও আমলাদের অধীনে চলে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অন্তত ১০টি পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে আমলাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোও তাদের হস্তগত হবে। আইনের ধারা থাকায় মেয়ররা এটি নিয়ে প্রতিবাদ করলেও ধোপে টিকছে না।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একক সিদ্ধান্ত না নিয়ে উভয়পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে পৌরসভাগুলো উপকৃত হবে। একই সঙ্গে পৌরসভার আয় বাড়ানো এবং খরচের স্বচ্ছতায় সরকারের নজর দেয়া উচিত।

পৌরসভাগুলোতে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন জেলা প্রশাসনে কর্মরত সহকারী কমিশনার বা সিনিয়র সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ১৯৭৭ সালের অধ্যাদেশ ও ২০০৯ সালের পৌরসভাসংক্রান্ত আইনে বলা আছে, পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেবে সরকার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কাউকে পদায়ন করা হয়নি। প্রায় তিন যুগ পর পৌরসভাগুলোর এই পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে পদায়ন করা শুরু হয়েছে। এরপরই এর যৌক্তিকতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিশেষ করে পৌরসভার মেয়রদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আগামীকাল সোমবার দুপুরে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ও মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. হেলালুদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন পৌরসভার মেয়রদের সংগঠন মিউনিসিপ্যাল এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ম্যাব) নেতারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাঠ প্রশাসনে এমনিতেই সমন্বয়কের অভাব রয়েছে। নানা কারণে দ্বন্দ্বও লেগেই থাকে। কারণ মাঠ প্রশাসনে এখন সর্বোচ্চ পদ বিচার বিভাগের অধীনে। বিচার বিভাগের অধীনে জেলা ও দায়রা জজ হচ্ছেন সচিব পদমর্যাদার। এর ফলে জেলা পর্যায়ে জেলা ও দায়রা জজ সমন্বয় সভাডাকলে সেখানে জেলা প্রশাসক গরহাজির থাকেন। আবার জেলা প্রশাসকের সমন্বয় সভায়ও উল্টো চিত্র দেখা যায়। সেখানে পুলিশ সুপার না থেকে প্রতিনিধি পাঠিয়ে দেন। অপরদিকে নির্বাহী বিভাগের অধীনে মাঠ প্রশাসনে সর্বোচ্চ পদ হচ্ছে বিভাগীয় কমিশনার, তিনি অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হচ্ছেন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। জেলা প্রশাসক হচ্ছেন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। আবার জেলা প্রশাসকের অফিসেই স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক পদে আরেকজন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা কর্মরত। জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাও উপসচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার। অন্যদিকে সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তারাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে কর্মরত। উপজেলা পরিষদ পুনরুজ্জীবিত করার পর থেকেই চেয়ারম্যানের সঙ্গে ইউএনওর রেষারেষি লেগেই রয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে পৌরসভায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়ার ফলে সেখানেও একই রকম দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়েই পৌরসভাগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা পদায়ন হচ্ছে। যে পৌরসভাগুলো বাকি আছে সেগুলোতে যত দ্রুত সম্ভব নিয়োগ শেষ করার জন্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছেন তিনি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগের মাধ্যমে পৌরসভাগুলো আমলাদের হাতে চলে যাচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমলারা কি নিজের ইচ্ছায় এখানে যাচ্ছেন? আমিই প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে তাদের নিয়োগ দিয়ে পাঠাচ্ছি। এই সিদ্ধান্তে মেয়রদের অসন্তোষের কথা জানালে তিনি বলেন, পৌরসভাগুলোতে উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র টাকা দিচ্ছে। সেই টাকায় যথার্থ উন্নয়ন হয় কিনা তা রাষ্ট্র তার কর্মকর্তার মাধ্যমে দেখতে পারে না? তার মতে, শুধু পৌরসভায়ই আইন কার্যকর হচ্ছে না, সামনে ইউনিয়ন পরিষদের বিদ্যমান আইনকে সংশোধন করে আরো কঠোর করা হচ্ছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পৌরসভা শাখা) সায়লা ফারজানা ভোরের কাগজকে বলেন, পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যকে পদায়ন করার ঘটনা এবারই প্রথম নয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের আমলে পৌরসভায় এ ধরনের নিয়োগ শুরু হয়েছিল। তখন হয়তো সক্ষমতা ছিল। এরপর এই ধারা বন্ধ হয়ে যায়। এখন আইন হওয়ার পর সরকার আবার প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে পদায়ন শুরু করেছে। তিনি বলেন, তাদের পৌরসভায় পদায়ন করলেও বেতন-ভাতা সরকারই দেবে। এর ফলে এ বিষয়ে পৌরসভাগুলোর চিন্তা করার দরকার নেই। দীর্ঘদিন পর কেন এমনটি করা হচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অব্যবস্থাপনার কারণে পৌরসভাগুলো সুশৃঙ্খলভাবে চলছে না। পৌরসভার উন্নয়নে সরকার কাড়ি কাড়ি টাকা দিলেও এর সুফল জনগণ পাচ্ছে না। এসব কাজের স্বচ্ছতার জন্যই সরকার পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে পদায়ন শুরু করেছে। এখানে মেয়ররা আপত্তি জানালেও কিছুই করার নেই। কারণ আইন মানতে হবে, আর আইনেই বলা আছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাকে পদায়ন করা যাবে।

একাধিক পৌরসভার দায়িত্বশীলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত দুটি কারণে পৌরসভায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগের বিরোধিতা করছেন তারা। এর মধ্যে একটি হচ্ছে- দেশের বহু পৌরসভায় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন নেই। বেতন না পেয়ে তারা অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। অন্যদিকে পৌরসভায় যারা নিয়োগ পেয়েছেন তারা সবাই স্থানীয়। এখন সেখানে বাইরে থেকে একজন লোক যাবেন এবং সবার কাছে কাজের জবাবদিহিতা চাইবেন তা তারা মেনে নিতে পারছেন না। এছাড়া এখন পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাজ করেন সচিব। কিন্তু প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার যোগদানের পর সচিবের খবরদারিও অনেকটা কমে যাবে।

পৌরসভার মেয়রদের সংগঠন মিউনিসিপ্যাল এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ম্যাব) কার্যকরী সভাপতি ও সাভার পৌরসভার মেয়র হাজি আবদুল গণি ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগ নিয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা চলছে। আগামীকাল সোমবার সকালে সংগঠনের একটি বৈঠক ডাকা হয়েছে। বৈঠকে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা ওই দিন দুপুরেই মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে দেখা করব। তাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দেব।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পৌর মেয়র বলেছেন, তাদের আশঙ্কা এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজের স্বাধীনতা ও পরিবেশ ব্যাহত হতে পারে। তাদের আক্ষেপ, হঠাৎ এমন একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারের তরফ থেকে তাদের মতামতও নেয়া হয়নি। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, আমি তাদের মতামত নিতে যাব কেন? আইন মেনে পৌরসভায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

ম্যাবের সভাপতি ও নীলফামারী পৌরসভার মেয়র দেওয়ান কামাল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার বেতন ও পৌরসভার অন্য কর্মচারীদের বেতন যদি আলাদাভাবে হয় তাহলে অনেক সমস্যা হতে পারে। কাল মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর বিস্তারিত বলতে পারব।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, পৌরসভার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটি না করে যদি পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলরদের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হতো তাহলে আরো ফলপ্রসূ হতো। কারণ সক্ষমতা বাড়াতে হয় ভেতর থেকেই। কিন্তু সরকার যদি এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সেটি সম্ভব। এছাড়া বাইরে থেকে লোক এনে দিলেই হবে না, পৌরসভাগুলো চায় কিনা তাও দেখতে হবে। তিনি এক্ষেত্রে উপজেলা পর্যায়ে চেয়ারম্যানসহ জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রশাসনের দ্বন্দ্বের বিষয় উল্লেখ করে বলেন, আমাদের দেশে যেটা দেখা যায় যে এখন উপজেলাগুলোতে উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা চেয়ারম্যানদের ঠিক মানতে চান না। আবার সরকার ইউএনওদের কথা শোনে, চেয়ারম্যানদের কথা শোনে না। ঠিক একই জিনিস পৌরসভাতেও হবে বলে আমার আশঙ্কা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজের চাপ ও আর্থিক সচ্ছলতা বিবেচনায় ধাপে ধাপে দেশের ১৯৪টি ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। ইতোমধ্যে গত ১ জুন মেহেরপুর ও কক্সবাজার পৌরসভায় সহকারী কমিশনার পদের দুই কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন-২০০৯ এ বলা হয়েছে, সরকার নির্ধারিত শর্তে পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেবে। পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তার অধীনে থাকবেন। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনসহ দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনেই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App