×

মুক্তচিন্তা

করোনার উৎস আবিষ্কারে উত্তপ্ত আমেরিকা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২১, ১২:১১ এএম

করোনার উৎস আবিষ্কারে উত্তপ্ত আমেরিকা
প্রায় চার মিলিয়ন প্রাণহানির জন্য দায়ী যে ভাইরাস, তার উৎস আবিষ্কারের দাবিতে এবার উত্তপ্ত হয়েছে আমেরিকা। বস্তুত নভেল করোনাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীজুড়ে যতটা সমালোচনা আর জটিল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সম্ভবত অতীতে আর কোনো ভাইরাসকে ঘিরে তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি কখনো। এর কারণ, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এর দ্বারা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উত্তপ্ত বিতর্কের গভীর মূলে, কোভিড-১৯ একদিকে যেমন বিশ্বরাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে, তেমনি ভাইরাসের রহস্যময় জেনেটিক ইনস্ট্রাকশন ভাবিয়ে তুলেছে বিশ্বের বিজ্ঞানসমাজকে। ভাইরোলজিস্টরা একে নিয়ে গবেষণার মাত্রা যত বাড়িয়েছেন, ততই হতবাক হয়েছেন বিস্ময়ে। কেননা তারা প্রমাণ পেয়েছেন, কোভিড ১৯-এর স্মার্ট ভাইরাস প্রকৃতিজাত নয়। বন্য পশু থেকেও তা মানবদেহে সঞ্চারিত হয়নি। হয়েছে সরাসরি মানুষ থেকে মানুষে। একেবারে অকস্মাৎ ঝড়ের বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে মানবসমাজকে তা বিমূঢ় করে দিয়েছে। কোভিড করোনার উৎস সম্পর্কে শুরুতেই কিছুটা ইঙ্গিত মিলেছিল। কারণ এমন কিছু ঘটনার প্রমাণ মিলেছিল, যাতে অনেকেরই বিশ্বাস হয়েছিল, ‘উহান ল্যাবই’ মহামারি করোনার প্রকৃত জন্মঘর। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০-এর গোড়ায় একে ‘চায়না ভাইরাস’ বলে সম্বোধন করায়, চীনের সঙ্গে বিমান যোগাযোগ বন্ধ করায় তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছিল এখানকার বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংস্থা থেকে। এদের প্রত্যেকের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমগুলো (সোশ্যাল মিডিয়াসহ)। আকাশছোঁয়া তীব্র ধিক্কারে প্রেসিডেন্টকে তারা তুলোধুনো করেছিল। বিশেষত ২০২০-এর জাতীয় নির্বাচন সামনে থাকায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে ভাইরাস নিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি আর মিথ্যা সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল, যাতে জনসমাজ বিরামহীন আতঙ্কে সবকিছু গুলিয়ে ফেলে প্রকৃত বাস্তবতা থেকে দূরে থাকে। যাতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ প্রতিপদে বিধ্বস্ত হয়। বিস্তারিত গবেষণা না থাকার কারণে বিশ্বের ২৭ জন খ্যাতিমান বিজ্ঞানীও একে মানুষের তৈরি বলে মানতে চাননি। সাপ্তাহিক মেডিকেল জার্নাল The Lancet-এর বিশেষ বিবৃতিতে ১৯ ফেব্রুয়ারি চীনের বিজ্ঞানসমাজ এবং চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে তারা জানিয়েছিলেন- We stand together to strongly condemn conspiracy theories suggesting that Covid-19 does not have a natural origin. কোভিড করোনা প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, উহান ল্যাবরেটরি তার জন্মদাতা, এই মন্তব্যকে তখন ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ (conspiracy theory) আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছিল, এমন ভাবনা অনুমানমাত্র। যারা জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন, বিদেশিদের সম্পর্কে ভীতির কারণ থেকে এসব মনগড়া থিওরি তারাই তৈরি করেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী, সর্বজনগ্রাহ্য সাপ্তাহিক মেডিকেল জার্নাল, The Lancet-এর বিবৃতি সাড়া জাগিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার অভিজাত শিক্ষিত মানুষের মনে। তারা প্রবল প্রভাব ছড়িয়েছিলেন রাজনীতি আর সমাজজীবনে। বলা চলে, ২০২০-এর করোনা মহামারি শক্তিশালী ব্যক্তিসত্তা নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতেই। সে প্রভাব আজো উল্লেখযোগ্য এ দেশের রাজনৈতিক দর্শনে। কিছুটা হয়তো সমাজ ভাবনাতেও। যদিও আপাতত করোনার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের মনে ধীরে ধীরে হাজারো প্রশ্নের ভিড় বাড়িয়ে চলেছে। যা হোক, করোনার উৎস আবিষ্কারে ফের উত্তপ্ত হয়েছে আমেরিকা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সময়ে যে তদন্ত জোরকদমে শুরু হয়েছিল, সেই কাজ এবার নতুন পথে শুরু হতে যাচ্ছে। নতুন পথে এজন্যই, বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যসব বিষয়ের মতো ভাইরাসের তদন্ত ফলাফলকেও বাতিল করেছে পুরোপুরি। এবার তার নতুন প্রশাসনে নতুনভাবে নতুন তদন্তকাজ চলবে। বলা বাহুল্য, প্রেসিডেন্ট ওবামার আমল থেকে রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে যে বিভাজন পর্বের শুরু হয়েছিল, ২০১৬-এর নির্বাচন পরবর্তী থেকে তার উত্তাল প্রকাশ ক্রমে বাড়ছেই। তবে এ প্রশ্নও উঠেছে, ট্রাম্পের এগিয়ে থাকা তদন্তের কাজকে কেন সম্পূর্ণ বাতিল করল নতুন প্রশাসন? প্রেসিডেন্ট বাইডেনই বা হঠাৎ কেন এর জন্মরহস্য উদ্ধার করতে আগ্রহী হয়েছেন? গোড়া থেকেই ডেমোক্র্যাটদের অনেকে চাননি, নভেল করোনার জন্মরহস্য জনসম্মুখে উন্মোচিত হোক। তাতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগে থেকে চীন-আমেরিকার রাজনীতিতে যে হিসাব-নিকাশের শুরু, একে একে তাদের অনেক ঘটনাই হয়তো সামনে এসে পড়বে। বলা চলে, নিজস্ব এজেন্ডা সামনে রেখে কেবল যে মূলধারার গণমাধ্যমের বায়াসড সাংবাদিকরাই রাজনৈতিক ক্যাডারের মতো কয়েক বছর ধরে জগৎকে মিথ্যা সংবাদ শুনিয়েছেন, তাই নয়। সুপার পাওয়ার আমেরিকার ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি, তাবড় তাবড় বিজ্ঞানী, রাষ্ট্রের শক্তিশালী মানুষগুলোও ধাপে ধাপে রাজনীতি আর গণনীতি নিয়ে অনেক খেলা খেলেছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যে করোনা রহস্য উদ্ধারের কাজ সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে চলতে পারেনি তার কারণ, স্টেট ডিপার্টমেন্টের অনেক কর্তাব্যক্তিরই এতে ঘোরতর আপত্তি ছিল। তদন্তকারীরা কাজ করতে গিয়ে বারবার তাই বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। ২০২১-এর জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে কয়েকটি সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে অন্তত সে রকমই জানা যাচ্ছে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের চারজন প্রাক্তন কর্মী সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, উহান ল্যাব থেকে কোভিড ১৯-এর ভাইরাস বেরিয়ে আসার বিষয়ে তাদের তদন্ত করতে বারণ করা হয়েছিল। State Department investigators say they were repeatedly advised not to open a Pandoras box. কারণ তাতে অনেক অপ্রিয় বিষয় বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। কিন্তু যে ভাইরাসের কারণে জগৎজুড়ে মহামারি, অস্থিরতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা এবং সামাজিক জীবনে বিপর্যয়ের ঘটনা বয়ে গেছে, তাকে নির্মূল করতে না পারলে ভবিষ্যতে আবার সে যে প্রলয়রূপে ধরা দেবে না, তার নিশ্চয়তা কী? অতএব ট্রাম্পের রিপাবলিকান দলের নেতারা একরোখা হয়ে জানিয়েছেন, কোভিড-১৯ রহস্য উদ্ধারের শেষ না দেখে তারা ছাড়বেন না। প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পিওর মন্তব্যÑ জো বাইডেনকে এর জন্য চীনকে অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে! কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন চীনের কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি অবলম্বন করবেন কি? এ দেশের বিগ মিডিয়া, বিগ টেক এবং বিগ ব্যাংক, প্রত্যেকেরই চীনের সঙ্গে গোপন আঁতাতের সম্পর্ক রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার বাইরে নন। তবে National Institute of Health-এর ডিরেক্টর ডক্টর ফাউচির হাজার হাজার ইমেইলের বিষয়বস্তু হঠাৎ ফাঁস হওয়ায় অপ্রস্তুত কেবল ফাউচি নন, অপ্রস্তুত হয়েছে বাইডেন প্রশাসনও। বাইডেনের চিফ মেডিকেল এডভাইজার ডক্টর ফাউচির যে আলোচনা ‘উহান ল্যাবের’ গবেষকদের সঙ্গে হয়েছে, তাতে প্রেসিডেন্টকে এবার তদন্তের পথে না গিয়ে উপায় নেই। না হলে রিপাবলিকান দলই হয়তো আসল সত্য তুলে ধরতে সক্রিয় হবে এবার। কিন্তু সত্য উদঘাটনের কাজ তাতে সফল হবে, এমন বিশ্বাস সাধারণ মানুষের নেই। তাদের বরং মন্তব্যÑ বাইডেনের ইনভেস্টিগেশন হবে তারই মতো নখদন্তহীন! চীন যেমন ডেমোক্র্যাট দলকে নিয়ে খেলেছে, তেমনি ফাউচিকে নিয়েও খেলছে এখন! কে জানে তার ইমেইলগুলো কমিউনিস্ট সরকারই ফাঁস করে দিয়েছে কিনা! যাতে নভেল করোনার রহস্য চিরকালের মতো অন্ধকারেই থেকে যায়! দীপিকা ঘোষ : কথাসাহিত্যিক ও কলাম  লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App