×

মুক্তচিন্তা

চেস্টার বাউলেস : পাকিস্তানকে অস্ত্র জোগানের পেছন-কাহিনী

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২১, ১২:৫১ এএম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে যেসব বিদেশির সহায়তার কথা বিভিন্ন দলিল-দস্তবেজে উঠে এসেছে তাদের মধ্যে স্বল্প-উচ্চারিত একটি নাম হচ্ছে চেস্টার বাউলেস। ১৯৬৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত তিনি ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন এবং ভারতের সীমান্তে দুপ্রান্তের প্রতিবেশী পাকিস্তানের পশ্চিমাংশ এবং পূর্বাংশ সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। অবহিত থেকে পেশাদার কূটনীতিকদের অনেকের মতো ‘তাতে আমার কি’ বলে মুখ ঘুরিয়ে রাখেননি। নিজ দেশের সরকারের ভ্রান্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলা আমাদের মতো দেশগুলোতে দেশদ্রোহ বলে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এটা যদি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে সত্যি হতো তাহলে চেস্টার বাউলেস রাষ্ট্রদ্রোহীর কাতারে পড়তেন। তিনি সেইসব মার্কিনির অন্যতম যারা সুনির্দিষ্টভাবে জেনে শুনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনসহ গোটা পৃথিবীকে জানিয়েছেন যে আমেরিকান অস্ত্রে পাকিস্তানের পূর্বাংশ পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের হত্যা করা হচ্ছে। তিনি আমেরিকার পাকিস্তান নীতির কঠোর সমালোচক ছিলেন। ১৯৭১-এর জুনে যখন পাকিস্তানের সমুদ্রগামী কার্গোতে নিউইয়র্ক ডকইয়ার্ড থেকে সামরিক সরঞ্জাম বোঝাই করা হচ্ছে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্তকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত তার আত্মজীবনী ‘প্রমিজেস টু কিপ : মাই ইয়ার্স ইন পাবলিক লাইফ’ এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন। একাত্তরে তিনি একাধিকবার নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের পক্ষে এবং ভারতে অবস্থানরত ১ লাখ শরণার্থীর পক্ষে কলম ধরেছেন। স্মর্তব্য ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ৭০ বছর বয়সি একজন এক্টিভিস্ট। চেস্টার ব্লিস বাউলেসের জন্ম ৫ এপ্রিল ১৯০১ যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের স্প্রিঙ্গফিল্ড শহরে। তার পিতামহ স্যামুয়েল বাউলেস ছিলেন একজন রিপাবলিকান মুখপাত্র এবং স্প্রিঙ্গফিল্ড রিপাবলিকান পত্রিকার সম্পাদক। পিতামহ রাজনৈতিকভাবে তার পিতাকে ‘প্রভাবিত ও সম্মত’ রিপাবলিকান হিসেবে দীক্ষিত করতে পারেননি। তার পিতামাতা দুজনই ডেমোক্র্যাটিক মতাদর্শ গ্রহণ করেন এবং সক্রিয় সমর্থন জানান, তারা সিভিল রাইট মুভমেন্টে শরিক হন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেফিল্ড সায়েন্টিফিক স্কুল থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক, সংবাদপত্রেই কর্মজীবনের শুরু, তারপর বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। তারপর তিনি অপর একজন বেন্টন অ্যান্ড বাউলেস নামের বিজ্ঞাপনী সংস্থা গঠন করে যা ১৯৩০-এর দশকে মহামন্দার পরবর্তী বছরগুলোতে মাল্টিমিলিয়ন ডলার মূল্যের কোম্পানিতে পরিণত হয়। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য আসার পর তিনি ব্যবসা ছেড়ে দেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় শারীরিক অসুস্থতার জন্য সশস্ত্র বাহিনীতে প্রত্যাখ্যাত হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের পরিচালক হন। ১৯৫১-১৯৫৩ এই দুবছর প্রেসিডেন্ট ট্রুমানের শাসনামলে ভারত ও নেপালের রাষ্ট্রদূত হন। তিনি তখন থেকেই আমেরিকার ভারতনীতির দুর্বলতা নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সঙ্গে তার সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্টেট ডিপার্টমেন্ট সন্দেহের চোখে দেখত। ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলে তিনি পুনরায় ১৯৬৩ সালে ভারতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন এবং ২১ এপ্রিল ১৯৬৯ পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। এর আগে ১৯৫৯-১৯৬১ পর্যন্ত তিনি কানেক্টিকাট থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য ছিলেন। তবে রাজনীতি তাকে ধরে রাখতে পারেনি। ভারতে থাকা অবস্থায় তার পার্কিনসন রোগ ধরা পড়ে এবং প্রায় ২২ বছর পর ২৫ মে ১৯৮৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পার্কিনসন নিয়েও তিনি সক্রিয় ছিলেন। স্মৃতিকথাসহ তার গ্রন্থসংখ্যা ৮টি। তার প্রত্যাশা ছিল বিপুলসংখ্যক মানুষের দেশ ভারত একটি মানবিক বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হবে কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। তার দ্য প্রমিজেম টু কিপ : মাই ইয়ার্স ইন পাবলিক লাইফ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এপিসোড অনূদিত হলো। ৮৫ বছর বয়সে ২৫ মে ১৯৮৬ চেস্টার বাউলেস কানেক্টিকাটে মৃত্যুবরণ করেন। জন কেনেথ গলব্রেইথ বলেছেন, জাগ্রত বিবেক এবং সাহস দুটো দুর্লভ গুণেই তিনি ছিলেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র সহায়তা সাম্প্রতিক বিবৃতিসমূহ থেকে বোঝা যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার এবং জাতিসংঘ দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় ধরনের যুদ্ধের বাস্তব এবং ক্রমবর্ধমান আশঙ্কা জেগে উঠতে শুরু করেছে। আমরা অন্তত আশা করতে পারি বেশি দেরি হয়ে যাবার আগে যুদ্ধ ঠেকাতে গঠনমূলক কিছু কাজের উদ্যোগ নেয়া হবে, যদিও এখন পর্যন্ত তার কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়ে উঠেনি। ২৫ মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের পূর্ব পাকিস্তানি স্বদেশিদের নির্মমভাবে নিপীড়ন করে যাচ্ছে, দল বেঁধে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বন্যার মতো ভারতে আসা আতঙ্কিত অভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এই শরণার্থীদের লালন করা ভারতের জন্য কেবল অতিকায় অর্থনৈতিক বোঝা হয়ে থাকছে না এটা অস্থিতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। এই মুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলাদের মধ্যে লড়াই বৃদ্ধি পাচ্ছে, উত্তেজনা বাড়ছে, চরমপন্থিদের লোকদেখানো কর্মকাণ্ডের কথাও শোনা যাচ্ছে। যদি পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য এবং সীমান্তবর্তী ভারতীয় সৈন্যরা সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যায় তাহলে যুদ্ধ পশ্চিম রণাঙ্গনে পাঞ্জাব ও কাশ্মিরেও ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান হুমকি দিয়েছেন তাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হলে ‘তারা একা নন’; সে ক্ষেত্রে তারা প্রত্যাশা করেন চীন যুদ্ধে তাদের পাশে দাঁড়াবে, অন্যদিকে সম্প্রতি সামরিক ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি বলে দিচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। ব্রিটেন খোলামেলাভাবে পাকিস্তানের গণহত্যার নীতির নিন্দা করেছে, বলেছে এটি নৈতিকতা এবং মানবিকতা লঙ্ঘন। আর পাকিস্তানে অস্ত্রের সরবরাহ বন্ধ করতে অস্বীকার করে ভারতের কাছে তার অবস্থান সর্বকালে সর্বনিম্নে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি যে এই সরবরাহ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক পাকিস্তানকে কথা শোনাবার সুযোগ করে দেবে- পুঁথিগতভাবে এবং বাস্তবে তা হাস্যকর। আর মঞ্চে পর্দার আড়ালে বসে থাকা জাতিসংঘ এ পর্যন্ত কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কুড়ি বছর ধরে (চেস্টার বাউলেসের রচনাটি ১৯৭১ সালে প্রকাশিত) যুক্তরাষ্ট্রের একটার পর একটা ভুল হিসাব এই বিস্ফোরন্মুখ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রথম মারাত্মক ভুলটি করেছে ১৯৫৪ সালে যখন পাকিস্তান আমাদের ‘অনুগত মিত্র’ হবার অর্থহীন প্রতিশ্রুতি দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আধুনিক এবং সম্প্রসারিত করতে সম্মত হয়। এ ধরনের আয়োজনের কারণ ব্যাখ্যা করে (যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার পররাষ্ট্র সচিব) জন ফস্টার ডুলেস জোর দিয়ে বলেন এর লক্ষ্য মধ্যপ্রাচ্য এবং চীন হয়ে অকমিউনিস্ট দেশগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্প্রসারণ ঠেকানো। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সমর্থন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের সঙ্গে লড়াই করার কোনো ইচ্ছেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের ছিল না। বাস্তবিকই পাকিস্তান যে ধরনের সামরিক সাহায্য চেয়েছে এবং পেয়েছে তা গিরিখাত ডিঙ্গিয়ে সোভিয়েত কিংবা চীনা আক্রমণ প্রতিরোধের নয়। আমাদের ট্যাঙ্ক ও মোটরচালিত গোলন্দাজ অস্ত্র এবং ফাইটার উড়োজাহাজ কেবল মাত্র ভারতের পাঞ্জাবের সমতলে যুদ্ধ করার উপযোগী ছিল এবং ১৯৬৫ সালে তারা ঠিক এ কাজটাই করেছে। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই এবং আমিও তাদের একজন, যুক্তরাষ্ট্রের এই কর্মসূচির ঘোরতর বিরোধিতাকারী ছিলাম। একটি আধুনিক বৈরী ও যুদ্ধংদেহী পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারতের সামরিক ব্যয় যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করতে চাপ প্রয়োগ করবে। ১৯৫৪ সালে এই ব্যয় ছিল ভারতের মোট জাতীয় উৎপাদনের ২ শতাংশেরও কম। পাকিস্তানকে আমাদের সামরিক সহায়তার কারণে উভয় দেশই তাদের উন্নয়ন কর্মসূচি ছাঁটাই করে সামরিক দৌড়ের প্রস্তুতি নিতে থাকবে- অথচ উন্নয়নের জন্য তাদের এই তহবিলের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশি। অধিকন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা যে ১৩ কোটি জঙ্গি মুসলমান যুক্তরাষ্ট্রের ইশারা পেয়ে কমিউনিস্টদের গুলি করতে ছুটে আসবে- তা ছিল সম্পূর্ণ অবাস্তব। সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠেকাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে যুক্তরাষ্ট্রের ৮০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় অনেকটা আমেরিকার বিরুদ্ধে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের মেক্সিকোকে অস্ত্র সাহায্য দেবার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমর সহায়তার পুরোটাই যে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছে শরণার্থীরাই সেই সাক্ষ্য বহন করছে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানকে সমরসাজে সাজানোর সিদ্ধান্তটি দুর্ভাগ্যবশত আমাদের ভুল হিসেবের সিরিজে কেবল মাত্র প্রথম ভুল, ভুল করা তারপর থেমে থাকেনি। ভ্রান্ত পথে সৃষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি যুক্তি খণ্ডন করা হয়েছে, কিন্তু পাকিস্তানকে সামরিকীকরণের প্রবক্তারা দ্রুত নতুন যুক্তি দাঁড় করিয়ে দিতেন। কিন্তু এটা যখন স্পষ্ট হয়ে গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের বিরোধিতা করে যুদ্ধে নামার ইচ্ছে পাকিস্তানের নেই তখন পাকিস্তানের জন্য আমাদের অস্ত্র জাহাজ বোঝাই নতুন যৌক্তিকীকরণ হাজির করা হলো। পাকিস্তানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার কারণ হিসেবে যে পরিকল্পনার কথা বলা হলো তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের পেশোয়ার সামরিক ঘাঁটি থেকে ইউ-২ স্পাই উড়োজাহাজ সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর দিয়ে যেতে পারে সে সুযোগ নিশ্চিত রাখা। আনুষ্ঠানিকভাবে সভার রেকর্ডে না এনে কংগ্রেসের বৈঠকে এবং গণমাধ্যমকে বলা হলো যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য এই স্থাপনার সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। ১৯৬৫-এর আগস্টে (প্রকৃত যুদ্ধকাল ৬ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর) যখন পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেল পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ স্থগিত করা হলো। ১৯৬৭-এর এপ্রিলে আমাদের সরকারের ভেতর তীব্র ও তিক্ত বিতর্কের মধ্য দিয়ে পেশোয়ার ঘাঁটি রাখার যৌক্তিকতা দেখিয়ে পাকিস্তানের জন্য সামরিক সহায়তা প্রদান করা আবার শুরু হলো। এক বছরের মধ্যেই পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রকে পেশোয়ার ঘাঁটি ছেড়ে দিতে বাধ্য করল। কেউ হয়তো ভাবতে পারেন ইতোমধ্যেই দেউলিয়া প্রমাণিত একটি নীতিকে শেষ করে দেবার জন্য পাকিস্তানের এই প্রত্যাখ্যানই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু অস্ত্র সহায়তার সমর্থকরা জাদুকরের মতো টুপির ভেতর থেকে আর একটা খরগোশ বের করল। তারা বলল, আমরা যদি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত না রাখি তা হলে এ কাজটা চীন করতে শুরু করবে। মাদক বিক্রেতাও তার হেরোইন বিক্রির জন্য একই ধরনের যুক্তি ব্যবহার করতে পারে। ১৯৭০-এর অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র আবার পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সন্ধির বিষয়টি উত্থাপন করল এবং পাকিস্তানকে তাদের কাছ থেকে এক স্কোয়াড্রন বি-৫৭ বোমারু বিমান কেনার অনুমতি দিল (ভারতীয় শহরে বোমাবর্ষণের জন্য এগুলো হবে সবচেয়ে কার্যকরী বোমারু বিমান)। পাকিস্তানকে আরো কিনতে দিল একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাঁজোয়া যান (যা উত্তর ভারতের সমতলে সৈন্য পরিবহনের জন্য খুব ভালোভাবে ব্যবহার করা যাবে)। আর এই বছর (১৯৭১) বেশ সম্পদশালী হয়ে উঠা পশ্চিম পাকিস্তান তাদের আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহারের আরেকটি ভালো মওকা পেয়ে গেল। তাদেরই দেশের একটি অংশে দেশবাসীর একমাত্র অপরাধ ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে পাকিস্তান ইউনিয়নেই অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের জন্য ভোট দিয়েছিল। দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের বিজয়ীদের গুঁড়িয়ে দিতে এই অস্ত্র ব্যবহার করল। স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং পেন্টাগন যখন কংগ্রেস সংবাদ মাধ্যম এবং জনগণকে নিশ্চয়তা দিল রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ রাখবে, আবারো প্রত্যাশা জেগেছিল যে শেষ পর্যন্ত এ বিষয়টির একটি সুরাহা হলো। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরই সজাগ সংবাদপত্র জানিয়ে দিল যে পাকিস্তানি জাহাজে আরো আমেরিকান অস্ত্র বোঝাই করা হচ্ছে এবং নীরবে সেসব জাহাজ আমেরিকান বন্দর ছেড়ে যাচ্ছে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও পেন্টাগন থেকে ভারতীয় পররাষ্ট্র কেবল আশ^স্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন যে পাকিস্তানকে সব ধরনের সামরিক সহায়তা বন্ধ রাখা হয়েছে, মনে করা হলো দুর্ভাগ্যক্রমে কোনো আমলাতান্ত্রিক বিপত্তির কারণেই জাহাজে অস্ত্র তুলে দেবার ব্যাপারটি ঘটেছে যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালার কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু শিগগিরই স্পষ্ট হয়ে উঠল, এটাই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি আর সিদ্ধান্ত এসেছে সরাসরি হোয়াইট হাউস থেকে। এখন আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে এই চালানের যৌক্তিকীকরণের আরো একটি কারণ বের করার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি; আর তা হচ্ছে চীনে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সফর নির্ধারণ করতে পাকিস্তান হেনরি কিসিঞ্জারকে যে সাহায্য করেছে এটা তারই মূল্য। যেহেতু কিসিঞ্জারের পিকিংকে পাবার আরো অনেক পথ ছিল সেসব এড়িয়ে পাকিস্তানকে ব্যবহার করাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরো বেশি স্খলন ও অপ্রয়োজনীয় চর্চা বলেই মনে হয়েছে।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App