×

মুক্তচিন্তা

‘অধিক ফলন-কম দাম’ সংকট থেকে মুক্তির পথ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২১, ১২:৫১ এএম

‘অধিক ফলন-কম দাম’ সংকট থেকে মুক্তির পথ

২০১৭ সালের হাওর বিপর্যয়ের পর চার বছর ধরে হাওরে অধিক মাত্রায় ফসল হয়েছে। বলা যায়, ১০ বছরের মধ্যে গোলা-শুকনো ধান মাড়াই করে কৃষক নির্বিবাদে এমন ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। কৃষকের তাতে খুব আনন্দ, নতুন পরিকল্পনায় আগামীর গৃহস্থি চিন্তায় বিভোর। কিন্তু না আলামত পাওয়া যাচ্ছে ক’দিন পরই ঘরে ঘরে হা-হুতাশ শুরু হবে। কেননা প্রথম বাজারেই নতুন ধানের দাম উঠেছিল প্রায় ১২০০ টাকা, এক সপ্তাহের ব্যবধানেই ৭০০-৮০০ টাকায় নেমে এসেছে। বাকি সময়ে কত নিচে নামবে কৃষক কেন কেউ তা জানে না। গত ২০১৮-১৯ সালে প্রচুর ফলন হয়েছিল এবং পরিমিত শুকনো ধান কৃষক সাড়ে ৪০০ থেকে শুরু করে শেষ বর্ষায় সাড়ে ৭০০-৮০০ টাকা মণ পর্যন্ত বিক্রি করতে পেরেছে। ভাটির হাওরে প্রতি মণ ধান ফলাতে যে কোনোভাবে হিসাব করলেও খরচ পড়ে সাড়ে ৯০০-১০০০ টাকা। জমির ভাড়া এবং কৃষক ও তার পরিবারবর্গের পারিশ্রমিক হিসাবে ধরলে ১২০০ টাকা উৎপাদন ব্যয় হয় তাতে কোনো ভুল নেই। অথচ এ বছরগুলোতে কৃষককে মণপ্রতি সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা লোকসান দিতে হয়েছে। অতীতেও এভাবে লোকসান দিতে দিতেই বড় কৃষক মাঝারি হয়েছে, মাঝারি কৃষক প্রান্তিক হয়ে ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়েছে। সরকার ক্রয়কেন্দ্রে মণপ্রতি ১০৪০ টাকা দাম নির্ধারণ করে দিলেও সব কৃষক ধান বিক্রি করার সুযোগ পাননি। জেলায় ৩ লাখ ৬৬ হাজার কৃষক থাকতেও লটারি করে মাত্র ১২০০ জন নির্ধারণ করে তাদের আধ-টন মানে সাড়ে ১৩ মণ ধান কিনেছে। আজীবন হাওরে ধানের ফলন একটু ভালো হলেই দাম কমে যায়, ফসলে একটু চোট খেলেই একটু দাম বাড়ে, যুগের পর যুগ চলে আসা এই দৃশ্যই হাওর এলাকার কৃষকের বিধিলিপি। কৃষকের আর এক নির্যাতনের নাম ‘ডান্ডি’র মার। সারাদেশেই ফড়িয়া-কয়ালরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কৃষকের ধান কিনে আসল দামে মোকামে বিক্রি করলেও শতকরা ২৫-৩০ মণ ধান লাভ থাকে। শতকরা ৫ মণ ধান বেশি নিলেও গৃহস্থ স্বেচ্ছায় ঘাটতি হিসেবে মেনে নেয়। কিন্তু না কৃষকের সামনেই ‘কাঠের ডান্ডি’র ফাঁকে সরকারের তদারকির অন্তরালে কয়াল-ফড়িয়ারা পুকুর-চুরি করে। এটার নাম সিস্টেম লস নয় নিরেট চুরি, কিন্তু দেখার কেউ নেই। অন্য ক’টি বিষয় মিলকারখানার মালিক তার উৎপাদিত পণ্যের দাম নির্ধারণ করে বাজারজাত করতে পারে। রাষ্ট্র বা সরকার তা সাদরে মেনে নিয়ে ক্রেতাকে ছবক দিতে পারে। তাহলে কৃষক কেন তার উৎপাদিত পণ্যের পর্তা অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করতে পারে না!! তার দেশের সরকার, তার ভোটে নির্বাচিত সরকার কেন তা যৌথভাবে নির্ধারিত দামকে সমর্থন করে না, কেন তা বিশ্বাস করে না। এক কেয়ার বা এক হাল জমি চাষ করতে তার পরিবারশুদ্ধ সবাইকে নিয়ে কতটুকু খরচ টানতে হয়, নিরেট জমি চাষে তার কতটুকু ব্যয় হয়, তার উৎপাদিত ধান কত মণ হয় এটা তো একমাত্র কৃষকই জানেন। আর এই উৎপাদন অনুপাতে এক মণ ধান কত বেচলে তার আগামী বছরের সংসার খরচ-গৃহস্থি খরচ সংকুলান করতে পারবে সে হিসাব, সিদ্ধান্ত নেয়া তো তার মৌলিক অধিকার। কিন্তু না, সে তা পারে না। আসি ২০২০ সালের কথায়- অণুজীব করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কায় গত বছর ব্যবসায়ী মহল ভবিষ্যতের লাভের চিন্তায় ধানের দাম বাড়িয়ে ধান কিনেছে। এরও মূলে হলো করোনার কারণে সরকার কোনো দেশে চালের এলসি করতে পারেনি। ফলে চাতাল মালিকরা সরকারি গোডাউন রেট ছাড়িয়ে সাড়ে ১২০০-১৩০০ টাকা পর্যন্ত দামে ধান কিনেছে। ফলে সরকারি ক্রয়কেন্দ্র তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ তো দূরের কথা, ১২-১৩ শতাংশেরও কাছাকাছি যেতে পারেনি। তাহলে কি পাওয়া গেল- দেশীয় কৃষকের মূল শত্রু এলসির মাধ্যমে বিদেশি চাল আমদানি!! আমাদের বাংলাদেশ কৃষক সমিতি, স্থানীয় ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলন’, ‘হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদে’র প্রতি সাধারণ কৃষকের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে। তাদের ধারণা, আমাদের সভা-সেমিনারের ফলেই ধানের দাম বেড়েছে। আর যাই হোক, তাতে অনেক ক্ষুদ্র কৃষক জোত-বন্ধকী কিছু জমি কিনতে পেরেছে। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো ২০২১ইং, ১৪২৮ বাংলায় যদি এ দাম না পায় মহাপরীক্ষায় পড়ে যাব। ফসল কাটার প্রথম বাজারেই প্রায় গত বছরের শেষ দাম ১২০০ টাকা দিয়ে দর শুরু হয়েছিল। আস্তে আস্তে তা নিচের দিকে নেমে আসছে। কৃষি সম্প্রসারণ অফিস এবারো বাম্পার ফলন ১২ লাখ টন আশা করছে। অপরপক্ষে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে জানা গেছে, গোডাউন রেট কিছু বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও ধান কেনার সময়সীমা এখনো জানা যায়নি। যেসব এলাকায় ধান কেনা হবে সেখানে প্রচার শুরুর কথা বলা হয়েছে। তা যদি আরো দু’মাস দেরি হয় গরিব কৃষকের ধান তো মহাজনের ঠেলায় ঋণ পরিশোধে বিক্রি করতেই বাধ্য হবে। সুতরাং এবারো বিদেশি এলসি করার পাঁয়তারা চলছে কিনা, দিন গেলে বুঝা যাবে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পেরে গত আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কী করলে সরকারি গুদামে কৃষক ধান দেবে পরামর্শ চেয়ে জেলা প্রশাসন, জেলা খাদ্যগুদাম, সাংবাদিকরা কথা বলেছিলেন। আমরা কিছু শর্ত মানার শর্তে কথা বলেছি, তা নিচে আলোচনা করছি। সবার থেকে ক্রয় করা হয়তো এখনই সম্ভব হচ্ছে না। তবু প্রত্যেক কৃষকের ধান কিনতে হবে, লটারির মাধ্যমে তালিকা নির্ধারণ করে কৃষককে হাস্যাস্পদ করা যাবে না। কৃষকের জন্য লাভজনক দাম বজায় রেখে চাল আমদানির বিদেশি এলসির অনুমোদন আস্তে আস্তে কমাতে হবে। এক ফসলি এলাকায় উৎপাদিত ধানের অর্ধেক সরকারকেই নির্ধারিত সঠিক দামে কিনতে হবে। খাদ্য গুদামে ধান বিক্রি করবে, সেসব কৃষককে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ, সরকারি যে কোনো প্রণোদনায় অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্থানীয় কৃষকের দাবি পর্যাপ্ত পরিবহন সুবিধা নেই সুতরাং ইউপি মেম্বার-চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে বন্ডসই নিয়ে ১ এপ্রিল থেকে কৃষকের চাহিদামতো ধানের অর্ধেক দাম ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পরিশোধ করতে হবে। তাতে কৃষকের শূন্য হাতে ধান কাটার শুরুর সময় অধিক সুদে ঋণ করতে হবে না। পরে পানি ভাসলে ক্রয়কেন্দ্র মণপ্রতি ৩০-৪০ টাকা খরচ কাটিয়ে ফড়িয়া দিয়ে কৃষকের বাড়ি বাড়ি থেকে ধান সংগ্রহ করবে। অতি দ্রুত পর্যায়ক্রমে হাওরের গোপাটগুলো পাকা করে মূল সড়কে যুক্ত করতে হবে। ফলে ক্ষেত থেকে ধান পরিবহন সহজ হবে ও বৃষ্টি-বাদলের বছরে অটো-রাইস মিলে ভেজা ধান মিলিং করার সুবিধা হবে। ধানের দামের সঙ্গে চাল ক্রেতা, চাল বিক্রেতা, মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকস্বার্থ, ক্ষেতমজুরস্বার্থ, সরকারের ও বাজারের স্থিতিশীলতা ইত্যাদি বিষয়গুলো জড়িত। যেহেতু সবচেয়ে নিচে আছেন ক্ষেতমজুর ও কৃষক এবং তারাই যেহেতু কঠোরতম পরিশ্রম করে ফসলটা ফলান সেহেতু তাদের প্রাপ্য লাভজনক দামের স্বার্থকে রক্ষা করে ধাপে ধাপে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত গ্রহণযোগ্য ‘জাতীয় কৃষি পণ্য দাম নীতি’ প্রণয়ন করতে হবে।

চিত্তরঞ্জন তালুকদার : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App