ধ্রুব এষ
‘তুমি আমার বই নিয়া কিছু লিখবা না?’
তার বই। কবিতার বই।
দুই বাচ্চার বাপ সে কবি। ছেলে ত্রিস্তান। মেয়ে ত্রিনিতা।
তাতে আমার কী?
অনেক কিছু। সে কবি আমার অনুজপ্রতীম।
প্রকাশনা সংস্থা আছে ‘বৈভব’। তারা প্রকাশ করেছে বইটি। ডিসেম্বর ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে। ৯৬ পৃষ্ঠা, ৬ ফর্মার বই। কবিতা আছে ৭৮টি। তার বই বলে আমি পড়েছি। একটা অক্ষরও বাদ দেই নাই। লিখি কী এখন? কেন লিখব?
‘আমি কি উচ্চ মাধ্যমিক কবিতা বোর্ডের চেয়ারম্যান, ব্যাটা? সার্টিফিকেট দিব তুই কবি?’
‘দিলা।’
‘কী? আমি কবিতা বুঝি না রে বাবা। তোর কবিতা পড়ছি, ভালো লাগছে। ‘প্লাগিয়ারিজম’ ভালো কবিতা, ‘পুনরায় কীর্তিমান শহর’ ভালো কবিতা, ‘সাঁঝবাতির ঘরে’ ভালো কবিতা, ‘বুবু’-।’
‘সব কবিতা তুমি পড়ছো!’
‘না, পড়ি নাই। আমি কবিতা পড়ি না, দেখি। তোর সব কবিতা দেখছি।’
‘হইল।’
‘হইল মানে?’
‘তুমি আমার কবিতা দেখছো, এই কথাই তোমার মতো করে লিখে দাও।’
‘তুই মুজিব ইরমের কবিতা পড়ছিস?’
‘মুজিব ইরম। হ, পড়ছি। তার কবিতা তোমার পছন্দ?’
‘পছন্দ মানে? আট বছর আগের একদিন আমি তারে কবিতায় নোবেল পুরস্কার দিছি, ব্যাটা।’
‘ওয়াও! তোমার এই কথাটা ফেসবুকে দেই?’
‘না। ফেসবুক আমার এলাকা না। তুই ফেসবুক নিয়া কবিতা লিখিস নাই?’
‘লিখতে কও?’
‘কবি না বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট রাইটার তুই? ফেসবুকের বিজ্ঞাপন বানাবি?’
‘তাও তো কথা।’
‘হ্যাঁ। অদ্ভুত কিছু লাইন তুই লিখছিস।-আয়শার পোষা তুলি বাঘের লাফে শীতের রৌদ্র সকাল মাত করে রাখে। আগুন দিছি মিয়ারা, দল বেধে আগুন দিছি গায়।-দেখা যায়। ডিটেইল। ‘ত্রয়ী’ মার্কা কবিতা লেখার রাইট তোর আছে। কিন্তু এসব কেন লিখবি? ‘জীবনানন্দ দাশ’ কবিতার শেষ চারটা শব্দ আমার ভালো লাগে নাই। অপ্রয়োজনীয় আর অতিরিক্ত সরল বোঝাপড়া মনে হইছে।’
‘বাদ দিয়া দেব নে।’
‘তা কেন করবি? তোর কবিতা তোর। ‘সমারূঢ়’ পড়ছিস? এর তার কথা শুনে কাটাকুটি করতে গেলে দেখবি নিজের একটা শব্দও থাকবে না কবিতায়।’
‘ঠিক কইছো।’
‘তুমি বদমাইশ অন্তর্বাসের সেলাই হইতে চাও? কোন অন্তর্বাস? ব্রা না প্যান্টির?’
‘কবিতার লাইন তো, বুঝছো না?’
‘তা বুঝছি। বুঝতে বুঝতে তিনকাল গিয়া এককালে ঠেকল। কিছু বুঝলাম কি না বুঝতে পারলাম না। এখন তুই একটু চুপ করে থাক আমি একটু চুপ করে থাকি।’
সম্মত হলো সে। আমরা দুই পদের দুজন মানুষ মৌনী হয়ে থাকলাম। মৌনব্রত। ছেলে ত্রিস্তানকে নিয়ে একটা কবিতা আছে তার বইটায়। মেয়ে ত্রিনিতি তখনও হয় নাই বলে ত্রিনিতিকে নিয়ে সে কোনো কবিতা লিখে নাই। বাজে কাজ করেছে। বইয়ের নাম ‘দূরত্বের এপাশ ওপাশ’। দূরত্বের এপাশে কি ছেলে ত্রিস্তান? ওপাশে মেয়ে ত্রিনিতি? পাগলা। সে কী মনে করেছে? আমি কবিতার সমঝদার পাঠক? ছন্দ মাত্রা কিছু বুঝি না, ধরি না, আমি একটা কবিতার বইয়ের ভালোমন্দ শনাক্ত করি কীভাবে? আমি শুধু দৃশ্যটা দেখি, মুদ্রিত কালো হরফ যে দৃশ্য নির্মাণ করে। হরফ দিয়ে দৃশ্য বানান কবিরা। জীবনানন্দ দাশের বেরালকে এজন্য বেড়াল বানিয়ে ফেললে মুশকিল। হরফের অন্তর্গত দৃশ্যে গড়বড় হয়ে যায়। কবির সময়কালের এবং কবির নিজস্ব বানান-রীতির হানি আমি এজন্য সমর্থন করি না। কবিতা স্তোত্র। পবিত্র শ্লোক। একবার লেখা হয়ে গেলে চিরকালীন, কবি যে যে ভাবে লিখলেন। যে শব্দ যে অক্ষর বসিয়ে লিখলেন। তবে সব কবি কি পাঠকের কবি? এবং সব পাঠক কি কবির পাঠক?
‘তোর বই বিক্রি কেমন হইছে?’
‘এক-দেড়শো কপি গেছে মেলায়।’
‘তাইলে তো এক-দেড়শো মানুষ তোরে কবি হিসাবে স্বীকৃতি দিছে। টাকা দিয়া তোর বই কিনছে। প্রতিক্রিয়া দিছে তারা?’
‘হ। ফেসবুকে দুই একজন কমেন্ট করছে ভালোই।’
‘কেউ তোর প্রেমে পড়ে নাই?’
‘কবে?’
‘দূরত্বের এপাশ ওপাশ পড়ে?’
‘কইতে পারি না।’
‘তোর এই বইতে অবশ্য প্রেমের কবিতা কম। তুই কি আর কবিতার বই ছাপবি?’
‘কইতে পারি না।’
‘গল্প লিখ তুই।’
‘কী কও তুমি!’
‘হ্যাঁ। গল্প আছে তোর কিছু কবিতায়। ‘বাজারের শরীর ও মাংস’ গল্প। ‘হেমন্তের মা ও কন্যারা’ গল্প। লিরিক্যাল গদ্য। ‘বুবু’ যেমন, উৎকৃষ্ট গল্প।’
‘ভালো কইছো। কিন্তু গল্প, আমি পারব না।’
‘গল্প লেখার দরকার নাই। তুই তোর মতো করেই লেখ। গল্পও লেখা। কবিতাও লেখা। কিছু একটা লেখা হইলেই হইল।’
‘আইচ্ছা দাদা, শোনো- এই যে এতক্ষণ তুমি যা বললা এসবই লিখে দাও না।’
‘চুপ!’
‘কী হইছে দাদা?’
‘এই চুপ!’
চুপ গেল সে।
আমি একটা সিগারেট ধরালাম।
সে বলল, ‘উইড?’
‘চুপ!’
উইড। উইড কী রে? উইড কী? উইড? আগাছা? এই জিনিস কি আগাছা নাকি? মান্যিগণ্যি করে বলতি, দিতাম। পোলাপান। এর খুব ভালো একটা বাংলা নাম আছে বাবা। জয়া।
গত বইমেলার প্রস্তুতি পর্বে এক কবি আর আমি বন্ধু হয়েছি। পোয়েট লোরেট। বুকপকেটে ঘ্রাণ নিয়ে সে আসে। ছেউড়িয়ার ঘ্রাণ, সামান্যপাড়ার ঘ্রাণ। এই সামান্যপাড়ার কথাই কি গানে? পাবে সামান্যে কি তার দেখা? পোয়েট লোরেট সামান্যপাড়ার সন্তান। তার সঙ্গ স্বস্তির। ১১ দিন আগে সর্বশেষ এসেছিল সে। ঝকঝকে একটা চাপাতি রেখে গেছে।
‘এটা রাখেন।’
‘কী করব?’
‘সব্জি কাটবেন।’
সব্জি এখনও কাটা হয় নাই। অনুজপ্রতীম কবি কি সবজি? সে জানে আমার মাথায় কিছু দোষ আছে। মাঝেমধ্যে কিছু উল্টোপাল্টা করি। বিব্রত হই যদিও পরে।
‘ধর।’
‘ওহ্! আমি জানতাম তুমি আমারে দিবা।’
‘টান দে ব্যাটা! ধোঁয়া উড়ে যাবে।’
টান দিল সে।
আমি উঠলাম। কফি বানালাম।
‘কফি খা।’
‘গ্রেইট। দাদা তোমার তুলনা হয় না। এইটা আবার কী নিয়া আসছ?’
‘চাপাতি। চিনিস না?’
‘চিনুম না? এই জিনিস দিয়া কী করবা তুমি?’
‘তোর কবিতা এবং তোরে ব্যবচ্ছেদ করব।’
‘অ।’
‘ডোমের কাজ। বই আলোচনা। ব্যবচ্ছেদ করতে হয় নির্বিবেক ডোমের মতো।’
‘ডোমরে তুমি নির্বিবেক বললা?’
‘সজ্ঞানে তারা শব ব্যবচ্ছেদ করে না। ধেনো গিলে নেয়। অ্যালকোহলের কোটিন পড়ে বিবেকে। তাতে তাদের কিছু যায় আসে না।’
‘ভালো কইছো।’
কফির মগে চুমুক দিল সে।
‘ফার্স্ট ক্লাস। তুমি দাদা বেইলি রোডে একটা কফির দোকান দিতে পারো। ফাটাফাটি চলব।’
‘আচ্ছা, দোকান দিলে তোরে অ্যাসিট্যান্ট রাখব। এখন শোন, কবিতার সঙ্গে কবিকেও ব্যবচ্ছেদ করেন আলোচক। আমি তোরে ব্যবচ্ছেদ করে দেখি?’
‘দেখো।’
‘সজ্ঞানে বলতেছিস? তোর বইয়ের ৬৮ পৃষ্ঠায় কোন কবিতাটা আছে বল তো?’
‘কোন কবিতা? মনে নাই।’
‘পুনরায় কীর্তিমান শহর। শান্ত মাটি গায়ে অলিগলির আমাদের মফস্বল শহর/কীভাবে যে রক্তে-বিপ্লবে-ভালোবেসে বড় হয়ে উঠল-।’
‘তোমার মনে আছে!’
‘তোর মনে নাই সেই মফসল শহর? বাদ দে। ‘দৃশ্যনির্মাণ’ মনে আছে ৩০ পৃষ্ঠার? বই নে। ‘দৃশ্যনির্মাণ’ আবৃত্তি কর।’
‘তুমি তো আবৃত্তি পছন্দ করো না।’
‘দরকারে করি। তুই ‘দৃশ্যনির্মাণ’ আবৃত্তি করবি, আমি তোরে ব্যবচ্ছেদ করব।’
কফির মগ রেখে বই নিল সে। পাতা ওল্টাল।
‘পড়ি শোনো-
বিনয়ের বাড়ির পাশ দিয়ে রেলগাড়িটি বহু বছর
প্রতীতি শব্দের দৃশ্য আঁকছে
আমরা কেউ কেউ বা অনেকেই এমন চলচ্চিত্র করব বলে-।’
আমি কোপ দিলাম।
কবির গলায় কবির চাপাতির কোপ।
তার মগের কফি রক্তলাল হলো।
ব্যবচ্ছেদ সম্পন্ন।
বই লিখেছে ‘দূরত্বের এপাশ ওপাশ’। সে কবি শতাব্দী জাহিদ। দূরত্বের এপাশে এখন তার মুণ্ডু, ওপাশে ধড়। ‘দৃশ্যনির্মাণ’ কবিতার পরের লাইনটা আবৃত্তি করতে পারে নাই সে।
-মাথা নত করে থাকি।
মাথা নত করার সময় পায় নাই।
তার হাত থেকে পড়ে গেছে বইটা। পৃষ্ঠা খোলা। ৩০-৩১ না, ৪৬-৪৭ পৃষ্ঠা। এই দুই পৃষ্ঠায় সে ‘বিছানার পদাবলি’ লিখেছে।
বিছানায় শরীররা শুয়ে থাকে চুলের
মতো
ধুলোর
মতো
ভাঁজের
মতো
রক্ত পড়েছে কবিতার কিছু অক্ষরে। ঝাঁ ঝাঁ লাল রং। বার্নট সায়ানা হয়ে যাবে শুকিয়ে। খয়েরি রং। পৃথিবীর সব কাব্যগ্রন্থেই কাব্যকারের রক্তের চিরস্থায়ী শুকনো দাগ থেকে যায়। খয়েরি রঙের।
‘তুই কি আপসেট?’
‘না দাদা।’
‘ডিসঅ্যাপয়েন্টেড?’
‘আরে না-!’
‘না কেন? কাটা মুণ্ডু তুই আর কবিতা লিখবি?’
‘লিখুম তো। পরের বইয়ের নামও ঠিক করে রাখছি।’
‘বইও ছাপবি! অবশ্য শ’ দেড়েক পাঠক তোর আছে। বইয়ের নাম কী ঠিক করে রাখছিস?’
‘তোমার কবিতা।’
বলে তার কাটা ধড় এবং মুণ্ডু উড়ে গেল।
রক্তাক্ত ‘দূরত্বের এপাশ-ওপাশ’ পড়ে থাকল শুধু
চুলের
মতো
ধুলোর
মতো
ভাঁজের
মতো।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।