ফের ফিলিস্তিন নিয়ে কথা

আগের সংবাদ

বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা ভাবনা ছাড়া উপায় নেই

পরের সংবাদ

‘করোনাকাহিনি’ ইতিহাস নয় ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ

প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২১ , ১২:১৩ পূর্বাহ্ণ আপডেট: জুন ১০, ২০২১ , ১১:৫৮ অপরাহ্ণ

ড. মীজানুর রহমান

‘করোনাকাহিনি’ গ্রন্থের ভূমিকায় লেখক শ্যামল দত্ত লিখেছেন, ‘… গুরুগম্ভীর বিশ্লেষণ নয়, গণমাধ্যমের সাদামাটা চোখে দেখার চেষ্টা করেছি।’ সেই হিসেবে ‘করোনাকাহিনি’ কোনো ইতিহাস নয়, বরং ঐতিহাসিক কাঁচামালের পর্যায়ে পড়ে। পরবর্তীতে যখন করোনার ইতিহাস লেখা হবে, এ নিয়ে সাহিত্য বা শিল্প সৃষ্টি হবে, এই তথ্যগুলো কথা বলবে। কেবলমাত্র তথ্য দিয়ে ইতিহাস বা সাহিত্য রচনা হয় না। ‘তথ্য হচ্ছে বস্তার মতো এরমধ্যে কিছু পুরে না দিলে দাঁড়াবে না’ (‘হোয়াট ইজ হিস্ট্রি’, ই.এইচ কার; ১৯৬১)। মহামারি নিয়ে লেখা আলবেয়ার কামুর বিখ্যাত The Flague উপন্যাসের কথা এসেছে শ্যামলের ‘করোনাকাহিনি’তে। এই উপন্যাসের গল্প একজন ডাক্তার আর ইঁদুরের মধ্যেই থেমে থাকেনি। মূলত যুদ্ধ, দখল, অবরোধ, আপস, কালোবাজারি, ষড়যন্ত্র, মহামারি, মৃত্যু কামুর এই উপন্যাসে বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়েছে। শ্যামলের ‘করোনাকাহিনি’ গ্রন্থের ১৬টি অধ্যায় ও কেবলমাত্র করোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। ‘করোনাকাহিনি’ গ্রন্থের লেখক মিথ্যা, গুজব (ইনফোমোডিক, পৃষ্ঠা-১৬), লোভ, চুরি-বাটপারি (শাহেদ-সাবরিনা, পৃষ্ঠা-৫৮), দখল, বিচ্যুতি (পৃষ্ঠা-২১), অব্যবস্থাপনা, ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব (পৃষ্ঠা-৩৮), শোষণ, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ইত্যাদির প্রামাণিক দলিল উপস্থাপন করেছেন করোনাকাহিনি গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোতে।

১৯৮৮ সালে ‘অগ্নিবর্ণ সাতটি ঘোড়া’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সৃজনশীলতার জগতে আবির্ভূত হন শ্যামল দত্ত। তবে ওখানে থিতু হননি। বহু গ্রন্থের সম্পাদক এবং একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকা সম্পাদককে ইতিহাস লেখার ব্যাকরণে ফেলে তাকে কোনোভাবেই ইতিহাসবিদ বলা যাবে না। ইতিহাসের প্রথম প্রয়োজন অজ্ঞতা, যে অজ্ঞতা সরল ও স্পষ্ট করে, ব্যাখ্যা ও বর্জন করে। (‘এ প্রিফেস টু এমিনেন্ট ভিক্টোরিয়ানস’; Lytton Strachey, ১৯১৮)। যদিও শ্যামল তার সাদামাটা চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন বলে বইটির ভূমিকায় দাবি করেছেন ‘করোনাকাহিনি’ বইটি পড়ে শ্যামলকে অতটা সাদামাটা মনে হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই শ্যামল বিশ্বাস নয়, সন্দেহ দিয়ে শুরু করেছেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন সূত্রের পরস্পরবিরোধী তথ্য উপস্থাপনের মধ্যে। অনেক কিছু তিনি গোড়া থেকেই শুরু করেছেন। বিপুলসংখ্যক ভ্রান্ত ধারণা স্বীকৃতি লাভ করে আছে মনে রেখেই সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য গোড়া থেকেই শুরু করতে পরামর্শ দিয়েছেন ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (‘Discourse on Method’; Renee Deckard,1637)। শ্যামল সমস্যা চিহ্নিত করেছেন এবং সমাধানের সুপারিশ করেছেন। তবে ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইন্ডাক্টিভ পদ্ধতিতে কোনো তত্ত্ব দাঁড় করাননি (‘দ্য প্রিন্স’; নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি, ১৫১৩)। বরং অনেকটা ‘ইউটোপিয়ান’ ধাঁচে শ্যামলের সমাধানগুলো মানুষের প্রাত্যহিক সামাজিক সমস্যার সমাধান করে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়াস বলেই মনে হয়েছে (‘ইউটোপিয়া’; স্যার টমাস মুর, ১৫১৫)।

চট্টগ্রাম আমাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী। সবচেয়ে ধনী লোকদের বাস। অনেকের স্ত্রী-সন্তানরা এখন ঢাকা বা টরন্টোতে থাকলেও, ব্যবসা করে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে যতটা মাজার আছে ততটা ভেন্টিলেটর এখনো নেই। করোনার শুরুতে চট্টগ্রামে আইসিইউ বেড সংখ্যা দশটিরও কম ছিল। শ্যামল দত্ত চট্টগ্রামে ২০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পীরের টাকায় চলে বলে মৌখিক তথ্য জোগাড় করেছেন। পীরের এবং মাজারের ওপর চট্টগ্রামবাসী এতই আস্থাশীল ছিলেন যে, তাদের কখনো হাসপাতালে যাওয়া লাগতে পারে ভাবেননি। তা না হলে চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোর এই অবস্থা হবে কেন? (পৃষ্ঠা-৬৭)।

করোনাকালে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনাগুলোর নির্মোহ উপস্থাপন করেছেন শ্যামল দত্ত। বিভিন্ন উদ্যোগের প্রশংসা করলেও এগুলোর অপ্রতুলতা, সার্বজনীনতা ও সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো সাহসের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সর্বশেষ প্রবন্ধে শ্যামল সবাইকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। করোনা থেকে একা একা বাঁচা যাবে না। করোনা ধনী-গরিব চেনে না, ধর্ম বুঝে না, বর্ডার মানে না। ভারত বিপদে পড়ে টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ভারতকে মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী দেশ আক্রান্ত হলে বা আক্রান্ত থেকে গেলে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির মতোই ব্যর্থ হবে তাদের করোনা মুক্তির প্রচেষ্টা। বরং নরেন্দ্র মোদিকে তার পুরনো বক্তব্য ‘পরশি পহেলি’ বক্তব্যে ফিরে আসতে হবে। ‘করোনাকাহিনি’ পুস্তকটির প্রত্যেক অধ্যায়ের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও বিশ্লেষণমূলক বিবরণী লিখেছেন অধ্যাপক ড. মিল্টন বিশ্বাস, তার ‘করোনাকাহিনি-অতিমারির প্রবাহমান সময় চিত্রণ’ শীর্ষক পুস্তক সমালোচনা প্রবন্ধে (ভোরের কাগজ, ৪ জুন, ২০২১)। সম্পাদনার পাশাপাশি শ্যামল দত্তের কাছ থেকে আমরা আরো বেশি মৌলিক প্রবন্ধ প্রত্যাশা করছি। আর এই বইটি শ্যামল দত্তকে একজন মৌলিক প্রবন্ধকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে, এটা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।

 

করোনাকাহিনি

শ্যামল দত্ত

প্রথম প্রকাশ ২০২১

ভোরের কাগজ প্রকাশন

মূল্য : ২০০

প্রচ্ছদ : রজত

পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রধান কার্যালয় ও ভোরের কাগজ প্রকাশন অনলাইন থেকেও সংগ্রহ করতে পারেন।

মন্তব্য করুন

খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, ভোরের কাগজ লাইভ এর দায়ভার নেবে না।

জনপ্রিয়