×

জাতীয়

রাজনীতিতে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি, স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২১, ১০:১৩ পিএম

রাজনীতিতে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি, স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য

রাজনীতিতে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি, স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া

সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-দপ্তর সম্পাদক, মিষ্টি চৌধুরী।

রাজনীতিতে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি, স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া

মিষ্টি চৌধুরী

ছোটবেলা থেকেই রাজনীতি করার প্রবল ইচ্ছে পুষে রাখতেন মনের ভেতর। হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর মস্তিষ্কে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব। কিন্তু তার পায়ে পায়ে যে কাকর বিছানো। বাধা যে পদে পদে। উপহাস, বঞ্চনা, নির্যাতনই যেন নিয়তি। অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পর লৈঙ্গিক স্বীকৃতি। তবে স্বীকৃতি পেলেও সাধারণ জনগণের চোখে এখনো যেন ‘মঙ্গল গ্রহের’ কোনো প্রাণী। সব গন্তব্যেই যেন মস্ত বড় তালা। সব ইচ্ছে, সাধ-আহ্লাদের সমাধি শেষে শুধুই বেঁচে থাকার আকুতি। তবুও কেউ কেউ ডিঙ্গোতে চায় বৃত্ত। শেকল ভেঙে ছুঁতে চায় আলো। সাহস আর ইচ্ছেশক্তির ডানায় ভর করে পাড়ি দিতে চায় আকাশপানে।

তেমনি একজন মিষ্টি চৌধুরী। তৃতীয় লিঙ্গের পরিচয়ে বেড়ে ওঠা মিষ্টির পথচলাও আর বাকি আট-দশজন হিজড়ার মতোই ছিল। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা সত্ত্বেও সুযোগের অভাবে শুধু মাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে নিজস্ব জনগোষ্ঠীর পেশাই বেছে নিতে হয় তাকে। তবুও রাজনীতি করার ইচ্ছেটাকে কবর দিতে পারেননি। দীর্ঘদিনের লালিত বাসনাকে বাস্তবে রূপ দিতে একদিন দ্বারস্থ হন সাভার আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা দৌলার। রাজনীতির হাতেখড়ি তার হাতেই। ধীরে ধীরে ঢাকা-১৯ আসনের সংসদ সদস্য, দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাভার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম রাজীবের সংস্পর্শে আসেন। এই তিনজনের সাহচর্যে রাজনৈতিক মাঠে পদচারণা শুরু। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাভার শাখায় সহ-দপ্তর সম্পাদক পদ লাভ। রাজনীতিতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। বিষয়টি নিজের জন্য, নিজ কমিউনিটির জন্য অত্যন্ত আনন্দের, গর্বের হিসেবেই দেখছেন মিষ্টি চৌধুরী। তবে তার এই উত্তরণের পথ এত সহজ ছিল না। হাজারো সামাজিক প্রতিকূলতা পার হতে হয়েছে তাকে।

[caption id="attachment_289386" align="aligncenter" width="687"] মিষ্টি চৌধুরী[/caption]

গত বুধবার রাজধানীর মালীবাগে ভোরের কাগজ কার্যালয়ে বসে প্রতিকূল জীবন এবং ভবিষ্যতে আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নের কথা জানালেন মিষ্টি চৌধুরী। বললেন, নিজ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন, প্রতিবন্দিদের উন্নয়নসহ সব মানুষের জন্য কাজ করতে চান। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এলাকার মানুষ চাইলে ভবিষ্যতে আরও বড় দায়িত্ব নিতে চান তিনি।

তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হওয়ায় বাধা বিঘ্ন ছিল পদে পদে। বয়স বাড়ার সঙ্গেসঙ্গে ধীরে ধীরে যখন বুঝতে পারলেন, আট-দশটা সাধারণ মানুষের মতো নয়, একটু ভিন্ন তখন থেকেই যন্ত্রণা শুরু। ক্লাসে বন্ধুরা, শিক্ষকরা টিজ করতেন। অন্যদের সঙ্গে এক বেঞ্চে বসার সুযোগ ছিল না তার। সবচেয়ে পেছনে একটি বেঞ্চে একা বসেই ক্লাস করতে হতো তাকে। উপহাস ছিল নিত্যনৈমিত্তিক সঙ্গী। বললেন, একমাত্র মা আমাকে বুঝতেন। আগলে রাখতে চাইতেন। এখন যেমন তাকে আগলে রাখি আমি।

ধীরে ধীরে যন্ত্রণা সহ্য করে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। হাজারো মন খারাপ, নিত্য উপহাস, মানসিক যন্ত্রণার মাঝে সাহস আর আত্মবিশ্বাসই হয়ে ওঠে সঙ্গী। সাহসই শিখিয়েছে লড়াই করে বেঁচে থাকতে। আর আত্মবিশ্বাস তাকে তুলে এনেছে দিনরাত্রির শারীরিক-মানসিক প্রতিকূলতা থেকে।

রাজনীতিতে আসা কমিউনিটির জন্য কতটা ইতিবাচক- এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, একশভাগ ইতিবাচক। মন থেকে আনন্দ অনুভব করি। এই প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কেউ রাজনীতিতে। আমাকে দেখে অনেকেই রাজনীতিতে অনুপ্রাণিত হবে। আমরা অবহেলিত জনগোষ্ঠী। আমাদের কোনো স্বীকৃতি ছিল না। সবাই ভাবতো, আমাদের দ্বারা কিছুই হবে না। আমি এখন যখন সাভার আওয়ামী লীগের কমিটিতে সহ-দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পেলাম, তখন আমাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। তারা এখন বলতে পারবে, আমরাও পারি। আমাদের তৃতীয় লিঙ্গের এক বোন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কমিটিতে রয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এটি তাদের উদ্ধুব্ধ করবে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে যেতে চাই।

তবে রাজনীতির অমসৃণ পথে তার লড়াইটা সাধারণের চেয়ে ভিন্ন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রাজনীতির কি বুঝবে, এমন প্রশ্নবাণে নিত্য জর্জরিত হতে হতো তাকে। তবে রাজনীতিতে আসতে সাভারের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, সাধারণ জনগণের কাছ থেকে সহযেগিতা- প্রথমত ছিল না। এখন পাচ্ছি। প্রথম দিকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক লাঞ্ছনা পেয়েছি। এখনো অনেকেই বলে, কেন রাজনীতি করতে হবে? দিনরাত উপহাসের শিকার হয়েছি। বাধা বিপত্তি বলে শেষ করা যাবে না। প্রতিটি কাজেই বাধা। আমি যখন নির্বাচনে নৌকার পক্ষে ভোট চাইতাম, তখন সাধারণ জনগণের প্রশ্ন- হিজড়ার আবার রাজনীতি করার সখ হইছে? এরপরও আমি সরে আসিনি। মানুষ তো অনেক কথাই বলবে। কান দেইনি। আমি প্রধানমন্ত্রীকে ভালোবাসি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করি। আমাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তবে ডা. এনাম, হাসিনা দৌলা এবং মঞ্জুরুল আলম রাজীব আমাকে সবসময় উৎসাহ দেন।

অন্যান্য তৃতীয় লিঙ্গের মতোই একসময় ঘর ছাড়তে হয় তাকে, আর ওই অর্থে ঘরে ফেরা হয়নি। আশ্রয় হয় আশুলিয়ায় এক গুরুমার কাছে। প্রথমদিকে লোকজন চুল ধরে টেনে পরীক্ষা করতো নকল কি না? তার একমাত্র বোনের মৃতদেহ তাকে দেখতে দেয়া হয়নি। বোনের দুটি সন্তান আছে। তাদেরকে কাছে আসতে দেওয়া হয় না। যদি তার ছোঁয়ায় ওরাও তার মতো হয়ে যায়! স্মৃতিগুলো দগদগে ঘায়ের মতো প্রতিমহুর্তে বিদ্ধ করে তাকে। বললেন, ২০০০ সালের ঘটনা। আমার একমাত্র বড় বোনের বিয়ে। আমাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে অন্য এক বাড়িতে। আমার কথা জানতে পারলে বোনের বিয়ে হবে না। হলেও তার সংসারে অশান্তি হবে। জানার পর বোনের সংসারে সমস্যা হয়েছে। বোনের বর বলেছেন, আমি বাড়ি থাকলে কোনোদিন বোনকে বাড়ি আসতে দেবে না। এলাকার মানুষ, পাড়া প্রতিবেশিরা দিনরাত কথা শোনাতে ভুল করতেন না।

নিজ জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন নিয়ে চিন্তাভাবনা তার। নির্ভরশীল গোষ্ঠী নয়, বরং আত্মনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন গোষ্ঠী হিসেবেই হিজড়াদের দেখতে চান। তৃতীয় লিঙ্গে পেশার আয় থেকেই অন্যদের সহযোগিতা করেন। কোভিডে সহায়তা করেছেন। বন্যায় করেছেন। বললেন, আমরাও মানুষ। আমরাও সুযোগ চাই। তৃতীয় লিঙ্গের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করতে চাই। সম্মানের সঙ্গে বাঁচুক। আত্মনির্ভরশীল হয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচুক। রাস্তাঘাটে চাঁদা চেয়ে মানুষকে হয়রানি করা উচিত নয়। কিছু সংগঠন তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে দেখিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছে কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর কোনো উন্নয়ন হয়নি। এজন্য পুনর্বাসন ও স্থায়ী সমাধান জরুরি।

রাজনীতি নিয়ে অনেক পথ পাড়ি দিতে চান মিষ্টি। হতে চান জনপ্রতিনিধি। কাজ করতে চান নিজ কমিউিনিটির অধিকার বঞ্চিত মানুষদের জন্য। সারা দেশের মানুষকে দেখাতে চান, সুযোগ দিলে হিজড়ারাও পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। ভোটাধিকার দিয়েছেন। তার কাছে চাওয়া, তিনি যেন আগামী সংসদ নির্বাচনে যোগ্যতার ভিত্তিতে তৃতীয় লিঙ্গের একজন প্রতিনিধিকে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য করেন।

https://www.youtube.com/watch?v=78Ah0YPglCA

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App