×

মুক্তচিন্তা

ভ্যাকসিনে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ও অন্যান্য প্রসঙ্গে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২১, ১২:২১ এএম

বাংলাদেশের প্রায় চতুর্দিকে ভৌগোলিক সীমান্তের অধিকাংশই ভারতের সঙ্গে। করোনায় ভারতের পর্যুদস্ত অবস্থার প্রভাব সীমানা পেরিয়ে আমাদের জনজীবনকেও সংকটাপন্ন করে তুলতে পারে। তাই এই মুহূর্তে ভাইরাস নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা আবশ্যক। ইতোমধ্যেই সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের ‘পজিটিভ’ রোগী শনাক্তের খবর প্রতিদিন পাচ্ছি। জানি না এর কী পরিচয় প্রকাশ পায়। এত কিছুর পরও আমাদের মধ্যে এখনো তেমন সচেতনতা নেই! সরকারি-বেসরকারি প্রচার মাধ্যম এমনকি বিভিন্ন মোবাইল-অপারেটর মানুষকে সচেতন করার প্রয়াসে নিরন্তর কাজ করছে। সরকারের বিরুদ্ধে সবাই অভিযোগ দাঁড় করান- জনসচেতনতা সৃষ্টিতে সরকার ব্যর্থ। এমন কোনো গণমাধ্যম নেই, যেখানে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চলছে। এ দেশের প্রায় ১২ কোটি মানুষ মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় প্রতিনিয়ত মোবাইল-অপারেটর থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ‘জিঙ্গেল’ শুনছেন। দিনে একবার মাত্র নয়- একাধিকবার। তাই মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী এই ১২ কোটি মানুষের সচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিশ্চয়ই অসঙ্গত নয়। ফোনে রিং করা মাত্র সবাই স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ শুনছেন ঠিকই, কিন্তু সচেতনতার পরিচয় দিচ্ছেন না কেউই! আমরা শোনেও শুনি না, দেখেও দেখি না- অন্ধের মতো জীবনযাপন করি। কিন্তু ‘অন্ধ হলেই কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’ প্রলয় বন্ধ থাকে না। উপরন্তু যাবতীয় ধ্বংস ও প্রলয়কে আমরাই যেন আগ্রহের সঙ্গে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসি ঘরের ভেতর। আপনজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিই করোনার ভাইরাস। জেনেশুনেই আমরা এ কাজ করছি অহরহ। ঠিক সেই গানের মতোই- ‘আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান, প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ!’ জেনেশুনে বিষ পান করলে, দেখেও না দেখার ভান করলে, শোনেও না শোনার ভান করলে কোনো সরকার, কোনো প্রচার মাধ্যম এমনকি শত শত মোবাইল-অপারেটর থেকে স্বয়ংক্রিয় সচেতনতামূলক পরামর্শ দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়লেও আমরা যদি পৌরাণিক যুগের সেই কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমের ঘোরে অচেতন থাকি তবে কে আমাদের নিজেদেরই সৃষ্ট দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ করবে! এছাড়া মহল্লায় মহল্লায় মসজিদ থেকে মাইকে আজানের পর বলা হয় ঘরে নামাজ পড়তে, তবু সবাই মসজিদে ছুটে যায়। সীমিতসংখ্যক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি নিয়েও উপচেপড়া যাত্রী ছাড়া কোনো গাড়ি ছাড়তে চায় না চালকরা! দোকানপাট, হাটবাজার, হোটেল-রেস্টুরেন্টেও ‘সীমিত আকারের’ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের প্রতিযোগিতা দেখতে হয় আমাদের। এমতাবস্থায় ভৌগোলিকভাবে চতুর্দিক-বেষ্টিত ভারত থেকে যদি করোনাশত্রুর সংক্রমণ-আক্রমণ শুরু হয়, তবে ব্যাপক ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশের মানুষের ভাগ্যে কী ঘটবে তা স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদেরও অনুমানের বাইরে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বিগত ১৫ মাসের দুঃসহ অভিজ্ঞতায়ও বুঝতে পারেনি স্বাস্থ্যসেবা খাতের সক্ষমতা এবং করোনা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সংকটের কথাও। এর চেয়ে আশ্চর্যের কিছু হয়! ‘গরিবের করোনা হয় না, পরিশ্রম করলে করোনা হয় না, মাদ্রাসায় করোনা হয় না, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে করোনা হয় না’- ইত্যাকার নানারূপ অবৈজ্ঞানিক প্রপাগান্ডা ও সমাজজীবনে নৈমিত্তিকতায় রূপ নেয়া মিথ্যা ‘মিথে’র মধ্যেই বেশি মানুষের বসবাস। তাদের ‘কনফিডেন্ট’ দেখে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরাও বিস্ময় প্রকাশ করেন! আমাদের ভরসা ও বসবাস যদি অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা ও ধ্যান-ধারণারই অনুগামী থাকে, তবে ‘সচেতনতা’ সৃষ্টির জন্য কে কাকে দায়ী করব? সরকার, নাকি বিভিন্ন রকমের প্রচার মাধ্যমকে? ইচ্ছাকৃত ‘অসচেতন’ থাকায় আমরা প্রত্যেকেই সমান দায়ীÑ নিজ নিজ অবহেলা, উদাসীনতা এবং গোঁয়ার্তুমির জন্য? সীমান্তবর্তী অনেকগুলো জেলার সংক্রমণ হার শতকরা পঞ্চাশের কাছাকাছি। এই সংক্রমণ হার যদি দেশের ভেতরকার অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সে সংকট আমাদের স্বাস্থ্য বিভাগ কীভাবে সামাল দেবে সে চিন্তার প্রতিফলন সাধারণ মানুষের চলাচলের মধ্যে বিন্দুমাত্র দেখা যায় না, আশ্চর্য! এপ্রিলের মাঝামাঝি যখন দৈনিক মৃত্যু ১০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল এবং শনাক্তের হার শতকরা ২৩ পেরিয়েছিল তখন আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের হিমশিম এবং সংক্রমিত রোগী ও রোগীর স্বজনদের আহাজারি, আর্তনাদ ও বেদনাক্লিষ্ট মুখচ্ছবি দেখে বিমর্ষ হয়েছি, আতঙ্কিতও হয়েছি। বৃহস্পতিবারও আমরা জেনেছি পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক মৃত্যু ১২৩। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের সীমান্ত, যোগাযোগ ও যাতায়াত ঐতিহ্যগত ও অনস্বীকার্য। কোনো নিয়মের বেড়াজালেই তা আটকে রাখা অসম্ভব। সেখানকার প্রভাব আমাদের জনজীবনকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করে। কেবল মহামারিই নয়- সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অনুভব-অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। সুতরাং সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার প্রতি উদাসীনতা পরিহার করে মহামারির কবল থেকে নিজেকে, স্বজনকে এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রকে সুরক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে প্রতিটি নাগরিককেই। বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠীর মতো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে কোথাও কোথাও বিক্ষোভের সূচনা করেছে। পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রগুলো যেখানে সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা আছে সেখানে শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে দুই দিন কোভিড পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশে সংক্রমিত রোগীর কোভিড পরীক্ষা করাতেই হিমশিম খেতে হয়। যাও কোনোভাবে পরীক্ষা করা যায় তার ফলাফল প্রাপ্তির বিড়ম্বনায় সুস্থ ব্যক্তিরও অসুস্থ হওয়ার উপক্রম হতে হয়! তাই আমরা স্বাস্থ্য বিভাগের সক্ষমতার কথা বারবার নানা প্রসঙ্গে সব শ্রেণিপেশার জনগোষ্ঠীকে মনে করিয়ে দিই। এ কথা সত্য যে, বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে বিগত ১৫ মাসে যে ক্ষতিসাধিত হয়েছে তার কিছুটা হলেও শিল্পমালিকরা বিকল্প উপায়ে পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে সেটি সম্ভব হয়নি। অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা হয়েছে, কিছু কিছু শিক্ষার্থী অ্যান্ড্রয়েড ফোন কেনার আর্থিক সহযোগিতাও পেয়েছেন। কিন্তু তাতে সুফল আসেনি। কারণ নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক পাওয়া সোনার হরিণের মতোই দুঃস্বপ্ন! সুতরাং শিক্ষাক্ষেত্রের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া কঠিন। কিন্তু তাই বলে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রদান সম্পন্ন না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তখন পরিস্থিতি নাজুক হলে তা মোকাবিলার মতো দক্ষতা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই নেই। এ কথা যেমন বাস্তব, তার চেয়েও রূঢ় বাস্তব হলো সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর ত্রুটিপূর্ণ ও ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনা! আবাসিক হলগুলো যে কাঠামোগত প্রশাসন থাকার কথা, তা কাগজে থাকলেও বাস্তবে নিষ্ক্রিয়। ভ্যাকসিন প্রদান সম্পন্ন করার আগে আবাসিক হল খোলা অনেকটাই ‘সাপের মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে খেলা’ করার মতো ঘটনা হবে। ইতোমধ্যে হল না খুলে সশরীরে পরীক্ষা গ্রহণের ঘোষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রাজধানী কেন্দ্রিক হওয়ায় তাদের পক্ষে এটি সম্ভব হলেও অন্যান্য বিভাগীয় কিংবা জেলা শহরে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কঠিন- সেসব ক্ষেত্রে আবাসিক হল খোলা ছাড়া পরীক্ষা গ্রহণ শিক্ষার্থীদের চরম ভোগান্তির মধ্যে ফেলবে। উপরন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন ঘোষণায় অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর যে ‘প্রচণ্ড চাপ’ সৃষ্টি হলো তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষার্থীদের ‘টার্গেট’ করে দ্রুত ভ্যাকসিন প্রদানই এই মুহূর্তের বাস্তবতা। যেহেতু একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা এখনো তৈরি হয়নি তাই দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে ইতোপূর্বেকার মতো অনিশ্চয়তা সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে চাই না। প্রাপ্ত ভ্যাকসিনের অর্ধেক পরিমাণের জনগোষ্ঠীকে নিবন্ধনের মাধ্যমে ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনের আওতায় আনায় সুপরিকল্পিত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সে পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। সব শিক্ষার্থীকে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো খোলার যে ঘোষণা ছিল তা কেবল কাগজে-কলমে রাখলে চলবে না। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিশেষ টাস্কফোর্স’ গঠনের মাধ্যমে ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের তালিকা সংগ্রহ করেছে। কিন্তু দেশব্যাপী বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী শিক্ষার্থীদের কীভাবে এবং কত দ্রুত ভ্যাকসিন প্রয়োগের আওতায় আনবেন তা এখনো অস্পষ্ট। কিন্তু এ কথা বাস্তবসম্মত উপলব্ধির বিষয় যে, ‘টার্গেট গ্রুপ’ হিসেবে পাবলিকসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের ‘অগ্রাধিকার’ বিবেচনার বিকল্প নেই। সুতরাং শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রদান সম্পর্কে ‘সুসংহত’ পরিকল্পনাটি কোভিড মোকাবিলায় জাতীয় পরামর্শক কমিটি ‘অগ্রাধিকার’ ভিত্তিতে সবার সম্মুখে দ্রুত স্পষ্ট করবেন আশা করি। জুন, জুলাই ও আগস্টে পর্যায়ক্রমে যে ৫০ লাখ করে ভ্যাকসিন আসবে তা সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং সংখ্যানুপাত বিবেচনায় অন্যান্য পেশাজীবীসহ শিক্ষার্থীদের টিকাদান সম্পন্ন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রথম ডোজ সম্পন্ন করে দ্বিতীয় ডোজের জন্য যেন পরবর্তী সময়ে আহাজারি, আর্তনাদ, বিক্ষোভ, মিছিল করতে না হয়। ব্যবসায়ীদের মতো শিক্ষার্থীরা এখন পর্যন্ত তেমন কোনো আন্দোলন না করলেও তাদের ভেতর যে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা আছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা তা অবশ্যই উপলব্ধিপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন।আমাদের সামনে যে কঠিন সময় আসছে তা সাধারণের সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট মহলের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।

আহমেদ আমিনুল ইসলাম : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App