×

জাতীয়

বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা কী?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২১, ০৮:৩৬ এএম

* ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনোদৈহিক বিকাশ * ক্ষতির পরিমাণ জানানোর নির্দেশ মন্ত্রণালয়ের

বৈশ্বিক মহামারি করোনায় ১৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই সময়ে কার্যত গৃহবন্দি শিক্ষাকে সচল রাখতে সরকার অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, টেলিভিশনে ক্লাসের কথা বললেও কোনোটিই ফলপ্রসূ হয়নি। যান্ত্রিক এই শিক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পরিচিত না থাকায় সমস্যা আরো বেড়েছে।

সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে। আর কি হতে পারে বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা? এ নিয়ে চলছে আলোচনা ও হিসাব নিকাশ। কিন্তু বিকল্পও বের করতে পারছে না শিক্ষা প্রশাসন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি শিক্ষকদের মধ্যেও এক ধরনের বৈকল্য বা অনীহা দেখা দিচ্ছে। একই সঙ্গে দেখভালের অভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাঠামোর অবস্থাও বেহাল। সব মিলিয়ে শিক্ষার এমন অনিশ্চিত যাত্রা অব্যাহত থাকলে শিক্ষার্থীরা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াসহ তাদের মনোদৈহিক বিকাশ ব্যাহত হবে।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, এ পরিস্থিতিতে শিক্ষার বিকল্প ভাবা ছাড়া উপায় নেই। যদিও শিক্ষার বিকল্প শুধু শিক্ষাই। কিন্তু করোনায় শিক্ষার্থীরা শারীরিকভাবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারছে না। এর ফলে শিক্ষাব্যবস্থার ‘চেইন’ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে। আর ঠিক এই জায়গাতেই সরকারকে উদ্যোগী হয়ে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য দুটোকেই একেবারে সমান্তরালভাবে সমন্বয় করতে হবে। কারণ স্বাস্থ্যঝুঁকি ও শিক্ষা ঝুঁকি দুটোই একে অন্যের সমস্যা সৃষ্টি করে। এই দুই ঝুঁকির মুখে থেকে শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে পড়েছে। কেউ কেউ আবার অপরাধ কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ছে।

জানতে চাইলে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষার বিকল্প শিক্ষাই। অন্য কোনো কিছু শিক্ষার বিকল্প হয় না। এটা ঠিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ক্লাস, টেলিভিশন ক্লাস হয়েছে। কিন্তু এটা কখনোই শিক্ষার পরিপূর্ণ বিকল্প বা সম্পূরক বিকল্প হতে পারেনি। সব মিলিয়ে বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা মানসিক চাপে পড়েছে। শ্রেণিকক্ষে এখন সবাইকে আনাও একটা চ্যালেঞ্জ মনে করছেন তিনি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, শতভাগ সফল না হলেও অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট ক্লাস ও টেলিভিশন ক্লাসের মাধ্যমে আমরা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সংযুক্ত রাখতে চেয়েছি। হয়তো এই পদ্ধতি সর্বজনীন হয়নি। কিন্তু ঘরে ঘরে শিক্ষা আছে এটা আমরা বলতে পারি। দীর্ঘবন্ধে নানা উপায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকের যোগাযোগ যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় সেই চেষ্টা করেছি। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধে শিক্ষায় কী কী ক্ষতি হয়েছে তা জানাতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে (মাউশি) নির্দেশ দিয়েছি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দীর্ঘ বন্ধে সরকার অনলাইন ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, টেলিভিশনে ক্লাসের কথা বললেও তার সুফল শহরকেন্দ্রিক কিছু শিক্ষার্থী পেয়েছে। বিশেষ করে অনলাইন ক্লাসে শহরের বিশেষ একটা শ্রেণির সন্তানরা অংশ নিয়েছে। গ্রাম, চরাঞ্চল, পাহাড়, হাওর এলাকার সন্তানসহ কম অবস্থাসম্পন্ন মানুষের সন্তানরা অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। এর ফলে গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলেছেন, অনলাইন ক্লাস অনেকটা ‘ওয়ানওয়ে’ রাস্তার মতো। বিশেষ করে শিশু-কিশোররা এই শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে একেবারেই অপরিচিত। এর ফলে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের মধ্যে যে পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকে তা অনলাইনে ক্লাসে গড়ে উঠে না। যান্ত্রিক এই শিক্ষা পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা অনভ্যস্ত শিশু-কিশোররা পড়াশোনায় খুব একটা মনোযোগী নয়।

অন্যদিকে, অ্যাসাইনমেন্ট ক্লাসও খুব একটা সুফল দিচ্ছে না। শিক্ষা প্রশাসনের নির্দেশে অ্যাসাইনমেন্ট হলেও তা দায়সারা। উপরের ক্লাসের শিক্ষার্থীরা ‘ওপেন বুক’ পরীক্ষার মতো অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিলেও নিচের ক্লাসের পড়ুয়ারা এটার সঙ্গে একেবারেই খাপ খাওয়াতে পারছে না। নিচু ক্লাসের শিক্ষার্থীরা জানেই না, কীভাবে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে জমা দিতে হয়।

টেলিভিশন ক্লাসের কথা বলা হলেও এটি একটি গৎবাঁধা ক্লাসে পরিণত হয়েছে। অথচ বিভিন্ন ‘অ্যানিমেশন’ ব্যবহার করে টেলিভিশন ক্লাসকে আরো আকর্ষণীয় করা যেত। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা এখানে দায়সারা কাজ সারছেন। প্রথমদিকে টেলিভিশন ক্লাসের প্রতি কিছুটা আগ্রহ থাকলেও শিক্ষার্থীরা এখন এটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

জানতে চাইলে সিলেটের বালাগঞ্জ সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক অবিনাশ আচার্য ভোরের কাগজকে বলেন, দীর্ঘ ১৪ মাসেরও বেশি সময় ধরে ঘরে থাকায় শিক্ষার্থীদের মনোবৈকল্য দেখা দিয়েছে। অনলাইন ক্লাসের নামে অনেকেই মোবাইল নির্ভর হওয়ায় পাঠের চেয়ে পাঠবহির্ভূত ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে বেশি আগ্রহী হচ্ছে। এতে কিশোর অপরাধ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে শিক্ষার বিকল্প বের করতে এবং শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।

এজন্য দুটি প্রস্তাবনা দিয়ে তিনি বলেন, করোনা আরো একটু নিয়ন্ত্রণে আসলেই সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে এবং প্রতিদিন অন্তত ২০ জন করে শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষে এনে পাঠদান করাতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধীরে ধীরে ইতিবাচক বার্তা পৌঁছে যাবে। আর যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে আরো দেরি হয় তাহলে প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঁচজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি গ্রুপ করে দেয়া যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা দেয়া-নেয়ার একটি বোঝাপড়া গড়ে উঠবে।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কলেজ অধ্যাপক জানান, শিক্ষার্থীদের মনোবল ভাঙার জন্য শিক্ষা প্রশাসনও খানিকটা দায়ী। তারমতে, করোনার সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে না আসলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যাবে না- এমন ঘোষণা একবারেই দেয়া যেত। কিন্তু ধাপে ধাপে এই ঘোষণা দেয়ার কারণেও শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে মুখ ফিরিয়ে আছে। তার মতে, প্রতি সপ্তাহেই শিক্ষার্থীরা জানছে আগামী সপ্তাহে স্কুল খুলবে। স্কুল খুললেই পড়াশোনা শুরু হবে। কিন্তু যেদিন স্কুল খুলবে তার দুদিন আগেই আবার ঘোষণা দেয়া হচ্ছে, স্কুল খুলবে না। এর ফলে স্কুল খুললে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পড়াশোনার যে আকাক্সক্ষা তৈরি হয় স্কুল বন্ধের ঘোষণা শুনে সেই আকাক্সক্ষার ‘কবর’ রচিত হয়। এতেও কিন্তু শিক্ষার্থীরা মনোবল হারিয়ে ফেলে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনাকালে শিক্ষার বিকল্প তৈরি করতে না পারায় উচ্চশিক্ষায়ও বড় ধরনের সেশনজট তৈরি হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ে পর্যায়ে যে সেশনজট শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল গত দেড় বছরে তা আবার বেড়েছে। এছাড়াও ২০২০ সালে যারা উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিল তারা উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়ায় কথা। কিন্তু এক বছরে শুধু এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া আর কোনো সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা হয়নি। ঠিক এই জায়গাতেই অনেকে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, চিকিৎসা শিক্ষায় এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা নেয়া গেলেও সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া যায়নি কেন? দীর্ঘদিন পরীক্ষা না নেয়ায় উঠতি বয়সি তরুণ-তরুণীদের অনেকেই মূলধারায় বাইরে চলে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর ভোরের কাগজকে বলেছেন, করোনার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমরা ভর্তি পরীক্ষা নিতে পারিনি। তবে এটা ঠিক, আমরা হয়তো সাহস দেখাতে পারতাম। কিন্তু তাতে হয়তো শিক্ষার্থী এবং বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দুপক্ষই একে অন্যের সমালোচনা করত। তবে করোনা নিয়ন্ত্রণে আসলে আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।

এদিকে, সম্প্রতি শিক্ষা নিয়ে কাজ করা এনজিওদের মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান একটি সেমিনারে বলেছিল, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বহু শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়েছে। বাল্যবিবাহের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে মাতৃমৃত্যুর হার। অথচ করোনার আগে সবকটি সূচকেই সরকার উন্নতি করেছিল। বিশ্বের প্রশংসাও পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এখন এই সবকটি সূচকই তলানিতে। এ জন্য ম্যাপিং করে করোনা যেখানে কম সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষককে বাঁচানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

গণসাক্ষরতা অভিযানের এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আমরা শিক্ষা নিয়ে কোনো অসাম্য তৈরি করতে পারি না। যেখানে করোনা কম সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলাম আর যেখানে বেশি সেখানে বন্ধ রাখলাম। তাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে অসাম্য তৈরি হবে তা নিরসন কে করবে?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App