×

ফিচার

কেন অটোনমি চাই?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২১, ০৮:৫৪ এএম

পরাধীন ব্রিটিশ ভারত থেকে পাকিস্তানের কালো অধ্যায় পেরিয়ে জন্ম হয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের। এই মহান অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো নানা ঘটনা, যার কারিগর হিসেবে কেউ আখ্যায়িত হয়েছেন নায়কের অভিধায়; কেউবা আবির্ভূত হয়েছেন খলনায়কের চরিত্রে। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে সেসব ঘটনা ও তার নায়ক-খলনায়কদের কার কি ভূমিকা, তাই নিয়েই অধ্যাপক আবু সাইয়িদের গ্রন্থ ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’। সম্প্রতি ভোরের কাগজ প্রকাশন থেকে বের হয়েছে বইটি। এ বই থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিদিন কিছু অংশ তুলে ধরা হচ্ছে ভোরের কাগজের পাঠকদের জন্য।

‘সংখ্যা সাম্য’ প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি ‘পূর্ববঙ্গের কেন অটোনমি চাই’ নামক একটি পুস্তিকা রচনা করেন। এ যেন ৬ দফার ছায়ালিপি।

কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্টে ভাঙন দেখা দেয়। কঠিন সংগ্রামের পথ ছেড়ে আপোষের পথ প্রসারিত হল। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গভর্ণর গোলাম মোহাম্মদের সঙ্গে হাত মেলালেন। জাতীয় ঐক্যের নামে এই ‘সংখ্যা সাম্য’ প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৫ সালে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। এই সময় তিনি ‘পূর্ববঙ্গের কেন অটোনমি চাই’ নামক একটি পুস্তিকা রচনা করেন। মনে হয় এ যেন ৬ দফার ছায়ালিপি। পুস্তিকায় বলা হয় : ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মৌলিক প্যাটার্নের পটভূমিতে ভূগোলের দিক দিয়ে পূর্ববঙ্গের অটোনমির দাবিকে স্বীকার না করে উপায় নেই। পাকিস্তান একটি অখণ্ড ভৌগোলিক অঞ্চল নয়। এই রাষ্ট্রের দুটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল বিমান পথে ১,০০০ এবং জলপথে ৩,০০০ মাইল ব্যবধানে অবস্থিত, কানাডা ও বৃটেনের মধ্যে যে ব্যবধান পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবধান তার চেয়েও বেশি।’

‘বাস্তব ক্ষেত্রে করাচী সরকারের কাছে পূর্ববঙ্গের জনগণের কণ্ঠস্বর পৌঁছে না। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই অঞ্চলের বক্তব্যেরও কোনো গুরুত্ব নেই। ১,৪০০ মাইল দূরে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের ক্ষেত্রে তাই অবিচার হতে বাধ্য। পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং তার ফলে দুই ভূখণ্ডের জনসাধারণের পক্ষে পরস্পরকে জানা এবং পরস্পরের সমস্যা অনুধাবন করাও সম্ভব নয়।’ ‘অর্থনীতির দিক দিয়েও পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবি অতি যুক্তিসঙ্গত। কারণ, পরস্পরের মধ্যে পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের অর্থনীতির ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে পৃথক। যোগাযোগের অভাব, উৎপাদন ব্যবস্থার ভিন্ন প্রকৃতি এবং মূল্যমানের বিরাট পার্থক্যের ফলে এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের পারস্পর্য রক্ষা করাও সম্ভব নয়।’

‘পাকিস্তানের ফেডারেল রাজধানী ও পূর্ববঙ্গের মধ্যে ১৪০০ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড অবস্থিত। জলপথে এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। বিমান ও স্থল পথে পরস্পরের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করার অত্যন্ত কঠিন, ব্যয় সাধ্য। খাদ্য শস্য এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় ও নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ববঙ্গের তুলনায় অনেক কম। প্রায় সমস্ত জিনিসই প্রথমে করাচিতে আমদানি করা হয় এবং তারপরে আবার রপ্তানি করা হয় পূর্ববঙ্গে। তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের রপ্তানিকারিরা যে শুধু অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে তাই নয়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাল রপ্তানি করার জন্য অতিরিক্ত দাম ধার্য করে। সে জন্য বৈদেশিক জিনিসপত্র পূর্ববঙ্গের বাজারে অত্যন্ত চড়াদামে বিক্রি হয়।

‘রাজনীতির দিক দিয়েও পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবি অনস্বীকার্য, বর্তমান যুগে সবদেশেই সরকারি কাজকর্ম জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রেখে পরিচালিত করা হয়। ৩,০০০ মাইল দূরে থেকে পূর্ববঙ্গে জনসাধারণের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সামান্য যোগাযোগ রাখাও সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে অধিকতর দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণ করে তাই রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরে এই রাষ্ট্রে সমস্ত কাজ কর্ম ইউনিটারী বা ঐকিক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তার ফলে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে কতখানি ঐক্য স্থাপন করা হয়েছে? জোর জুলুম করে পিস্তল দেখিয়ে কোনো দেশে ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব নয়।’

‘পূর্ববঙ্গের ইতিহাস এক শোষণের ইতিহাস। এই অঞ্চলের জনসাধারণের আয় থেকে এবং বৈদেশিক সাহায্য থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নমূলক কাজে। এই অর্থ থেকে পূর্ববঙ্গের ভাগ্যে সামান্য অংশও জোটেনি।

পাকিস্তান গঠনের পরে এই রাষ্ট্রের সমস্ত সামরিক সংগঠন স্থাপিত হয়েছে পশ্চিম অঞ্চলে। মিলিটারী কলেজ, প্রি-ক্যাডেট স্কুল এবং অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী সবই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে ও করাচিতে। এরূপ কাজে অথবা এরূপ সংগঠন তৈরির ব্যাপারে পূর্ববঙ্গ সামান্য অংশও পায়নি। প্রতিবছর কেন্দ্রীয় সরকার ৬০-৭০ কোটি টাকা পূর্ববঙ্গ থেকে সংগ্রহ করে কিন্তু তার প্রায় সবই ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এরূপ এবং অন্যান্য শোষণের ফলে পূর্ববঙ্গের সর্ব শ্রেণির জনজীবন আজ এক শোচনীয় দারিদ্র্যের সম্মুখিন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ভূখণ্ড দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভূখণ্ড হওয়ায় পূর্ববঙ্গের পুঁজি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়ে এই পূর্ব ভূখন্ডের অর্থনীতিকে আজ এক চরম দুর্বিপাকের দিকে ঠেলে দিয়েছে।’ ‘পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের মধ্যে ব্যবসা, বাণিজ্য ও আমদানির ক্ষেত্রে এমন পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে যে, তার ফলে পূর্ববঙ্গের জনজীবন গুরুতরভাবে বিপন্ন হচ্ছে। পূর্ব বাংলা বহুবার এই অভিযোগ করেছে যে, ব্যবসা বাণিজ্যের লাইসেন্স এবং বৈদেশিক আমদানির সুযোগ পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের এমন পক্ষপাতিত্বের সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে যে তার ফলে আমদানির প্রায় অধিকাংশই যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে। এরূপ পক্ষপাতিত্বের জন্য পূর্ববঙ্গের বাজারে জিনিসপত্রের শুধু দুষ্প্রাপ্যতা নয়, অগ্নিমূল্যও বটে। বর্তমানে পূর্ববঙ্গকে সমস্ত বৈদেশিক জিনিসপত্র আমদানি করতে হয় করাচি থেকে এবং তার ফলে প্রত্যেক জিনিসের জন্য পূর্ববঙ্গকে ৫০ শতাংশ বেশি দাম দিতে হয়। এভাবেও পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ববঙ্গের পুঁজি নিয়মিতভাবে শোষণ করে নিচ্ছে।’

‘কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ কর্মে কীভাবে পূর্ববঙ্গকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কুক্ষিগত কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত কর্মচারীদের আঞ্চলিক বণ্টনের তথ্যে তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।’ এটা ছিল ঐ সময়ের প্রেক্ষিতে এক দুঃসাহসিক কার্যপত্র। পরবর্তীকালে ৬ দফায় এর সংহত প্রতিরূপ প্রতিফলিত।

আগামিকাল প্রকাশিত হবে ‘সভামঞ্চ ভাংচুর এবং অতঃপর’ ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’- বইটি পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রকাশনে (ভোরের কাগজ কার্যালয়, ৭০ শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা)। এ ছাড়া সংগ্রহ করা যাবে bhorerkagojprokashan.com থেকেও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App