×

মুক্তচিন্তা

একুশ-বাইশের বাজেট

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২১, ১২:২৭ এএম

একুশ-বাইশের বাজেট

বাংলাভাষায় সংখ্যা নিয়ে বেশকিছু ব্যঙ্গবাক্য আছে, যেমন- নয়ছয় করা, যা বায়ান্ন তাই তিপ্পান্ন, নিরানব্বইয়ের ধাক্কা ইত্যাদি। একুশ-বাইশ সে পর্যায়েরই পরিস্থিতি পরিচয় জ্ঞাপক দুটি সংখ্যা শব্দ। রবীন্দ্রনাথ জেনে শুনে যে বিশ পান করেছিলেন তা নাকি জীবননাশক বিষ ছিল না, ছিল ‘বিশ’ বা টোয়েন্টি নামের তরল পানীয়। রবি বাবুর এহেন অভ্যাসসংক্রান্ত আসল তথ্য যেমন মেলে না বাংলাদেশের ২০২১-২২ বাজেট বছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের আকার, প্রতিশ্রুতি, প্রত্যাশা ও প্রত্যয়, বাস্তবায়নে করণীয়, স্মরণীয় অনেক কিছুই এখনো যেন ভাব কল্পনাবিহারী। আর সেই বাজেটের ভালো মন্দ বিচার বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তেমনি দেখা যায় বড্ড যেন একদেশদর্শিতার দৃষ্টিভঙ্গি আচ্ছন্ন। করোনাকে হুকুমের আসামি বানিয়ে, করোনা মোকাবিলাকে আর্জিভুক্ত করে জীবন ও জীবিকার স্লোগান এনে জাতীয় বাজেটের জাত-বিচার চলছে। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট হচ্ছে- সরকারের ধারাবাহিকতায়, বাজেট ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে থেকে প্রণীত বাজেট গতানুগতিক না হয়ে উপায় নেই। ‘বাক্সের বাইরে’ এসে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন প্রস্তাব করার মতো স্পেস কোনো অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের জন্য ছিল না। যারা বাজেটের নির্মোহ মূল্যায়ন করেন তাদেরও যদি এ বাজেট প্রণয়ন করতে বলা হতো, তারা ব্যতিক্রমী কোনো কিছু উপস্থাপন করতে পারতেন বলে মনে হয় না। বলা বাহুল্য, বাজেটের ভালো-মন্দ প্রভাব প্রক্রিয়া উভয়ই কম-বেশি আছে। সুতরাং বাংজেটের সমালোচনা গ্রহণ করা উচিত, অন্ধভাবে নিজেদের ডিফেন্ড করার পথ খুঁজতে গিয়ে অন্যদের প্রতিপক্ষ সাব্যস্ত করে তাদের কূট আক্রমণ করে বাজেট পর্যালোচনাকে পাশ কাটানো সবার জন্য ক্ষতিকর। শুধু ভালো দিক কিংবা শুধু মন্দ বা সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরাটাও তো গতানুগতিক হয়ে যায়। সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় ঘটানোর অনেক প্রয়াস, অর্থনীতিতে বিদ্যমান বশংবদ সমস্যাগুলো স্পর্শ করার, প্রতিবিধান প্রতিকারের পথ পন্থা বাতলানোর, নির্দেশনা যে বাজেটে আদৌ নেই তা তো নয়। আবার শুভঙ্করের আশ্রয় নিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা কিংবা কোটারি স্বার্থ উদ্ধারের উপায় উপলক্ষের উপস্থিতি যে এ বাজেটে নেই, সে কথাও বলা যাবে না। ভালোকে ভালো বলতেই হবে আর মন্দকে মন্দ তো বটেই, কীভাবে মন্দকে মোকাবিলা করা যাবে তার গঠনমূলক পরামর্শ দেয়াটাও সবার দায়িত্ব। বাজেট পর্যালোচনাকে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কের বিষয়ে পরিণত হতে না দিয়ে এটিকে কীভাবে জাতীয় উন্নয়ন অভিমুখী করা যায় সেদিকে সবারই স্বচ্ছ দৃষ্টি ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা দরকার। জাতীয় অর্থনীতি সবার, কারো কারো নয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক হোক দৃষ্টিভঙ্গি, বিচ্যুতিমূলক নয়। ২০২১-২২ বাজেট বছরের বাজেটকে বড় বাজেট বলা হচ্ছে। সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে ইতিহাসের বৃহৎ বাজেট। বাজেট যেহেতু ইনক্রিমেন্টাল বাজেটের আকার (বার্ষিক ১৫-১৭ বা তার বেশি প্রবৃদ্ধিতে) করা হয় সেহেতু প্রতি বছরেই বাজেট ইতিহাসের বড় বাজেট হবেই। তবে যেহেতু বাজেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না সেহেতু স্বাভাবিক বাজেটকেও অস্বাভাবিক বা বড় বলা বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বাজেট বাস্তবায়নের কতগুলো বিষয় আছে। এটা বড় বাজেট নয়, আমাদের দেশে ট্যাক্স জিডিপির যে মাত্রা তা এবার আরো দুঃখজনকভাবে মাত্র ৭ শতাংশ। আমাদের পাশের দেশ ভারতে এটা ২০ শতাংশের ওপরে। অর্থাৎ আমাদের দেশে টাকা আছে, কিন্তু সেই টাকা থেকে ট্যাক্স আদায় হয় না। সে কারণে খরচ করা যাচ্ছে না। এ কারণে জিডিপির আকারের দিক থেকে বাজেটকে বড় বলা যায় না। বাজেট বাস্তবায়ন হবে না এ কারণে যে, যদি ট্যাক্স আদায় না হয়, তাহলে বিভিন্ন খাতের যে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে সেটা কীভাবে ব্যয় হবে। দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। ব্যাংক কমিশন গঠনের কথা, সংস্কারের কথা আর এখন বলা হচ্ছে না, এ বাজেটে তো তা নেই। ব্যাংকিং খাতটিই দেশের অর্থনীতির বড় খাত এবং রেভিনিউ আর্নিংয়ের অন্যতম উৎস। তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই অচল অর্থনীতিকে সচল হওয়ার, একমাত্র করোনার মতিগতির ওপর ভরসা করা হচ্ছে। অর্থনীতি সচল করতে না পারলে জীবন-জীবিকা বলি বা রেভিনিউ আর্নিং বলি কিছুই তো হবে না। অর্থনীতিকে ডিম আগে না মুরগি আগের অবস্থায় রেখে দিয়ে উত্তরণের পথ খোঁজা সমীচীন হবে না। বরাবরের মতো এবারের বাজেটেও সবার প্রত্যাশা যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বা আয়বৈষম্য নিরসনের জন্য বাজেটে বিশেষ কিছু বিষয় থাকবে বা কিছু করা হবে। সেটা করা হয়নি বরং বৈষম্যকে, বৈষ্যম্যের উপায় উপলক্ষকে স্বীকার করে নেয়ার, স্বীকৃতি দেয়ার পদক্ষেপকে এখনো ধোঁয়াশার মধ্যে রাখা হয়েছে। কালো টাকা সাদাকরণের সীমাহীন সময় দান এবং কালো টাকা সাদাকরণে ব্যর্থদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো কড়া (জিরো টলারেন্স গোত্রীয়) ঘোষণা নেই। কালো টাকা সাদা হওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। অতীত অভিজ্ঞতা বলে যে এর আগেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ কয়েকবার দেয়া হয়েছিল এবং চলতি বাজেটবর্ষে বিতর্কিত সুযোগ দেয় হয়েছিল, তথাপি তেমন সাড়া সে অর্থে পড়েনি। এর একটি কারণ বোধ হয় এই যে কালো টাকা নিয়ে বাংলাদেশে চলতে কোনো অসুবিধা হয় না। সরকার তাদের ওপর কোনো অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে না। এ কারণে ১০ শতাংশ সুদ দিয়েও তারা কালো টাকা সাদা করতে চায় না। এদের ওপর চাপ দিতে না পারলে বা কালো টাকা বাজেয়াপ্ত না করলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। বৈষম্য মাপার পরিমাপক গিনিসহক বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫, যা উচ্চ বৈষম্য নির্দেশ করে। এটাকে কমিয়ে আনাই যে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা (শোষণমুক্ত, বৈষম্যবিহীন অর্থনৈতিক মুক্তি) সেটা শুধু উপলব্ধির উপলব্ধিতে আনার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ব্যাংকিং খাতের অসুস্থতা দূর করার জন্য, আস্থা বাড়ানোর মতো পুষ্টিকর প্রস্তাবনা এখনো প্রত্যাশিত থেকে গেল। নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ভালো বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। নতুন সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ইঙ্গিত আছে। বৈষম্যমূলক অর্থনীতিতে যারা অত্যন্ত দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, বৈষম্যের কারণে যারা ভুক্তভোগী, তাদের কষ্ট হয়তো কিছুটা লাঘব হবে। কিন্তু শুধু বয়স্ক সুবিধাবঞ্চিত, দুস্থ সাহায্য প্রাপকদের সংখ্যা ও ভাতা বাড়ানো হলেই তো জীবন ও জীবিকার বাজেট অর্থবহ হবে না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কিছুটা বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সেখানে বাস্তবায়ন সমস্যা আছে, সুফল প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা আছে, সেসব দূর করার পদক্ষেপ ও কর্মকৌশল ঘাঁটতি আছে। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন বা প্রয়োগে জোর না দিলে মানবসম্পদ উন্নয়নই ব্যাহত হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ, সেটা যেন সুন্দর ও সুচারুভাবে দেখভাল করা হয়। তাদের ঋণ দিয়ে পরিশীলিতভাবে পরিচালিত করা হয়। তাহলে এটি সফল খাত হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং বর্তমান বাজেটের একটি ভালো দিক বা সাফল্য বলে বিবেচিত হবে। সাব-কন্ট্রাক্ট বা উৎসাহ দেয়া বৈষম্য কমানোর একটি ভালো উপায়। জাপানে সব সময় বড় কোম্পানিগুলো ছোট ছোট কাজগুলো কন্ট্রাক্ট দিয়ে করিয়ে থাকে। তারা নিজেরা করে না। বাংলাদেশে বড় কোম্পানিগুলোও মুড়ি ভাজে, ছোট প্রতিষ্ঠান তো ভাজেই। এতে ছোট প্রতিষ্ঠান কিছু করতে পারছে না। এ ধরনের খাতে সাফল্য পেতে হলে সরকারের তরফ থেকে সহায়তা দেয়া হলে, কিছু ছাড় দিলে এসএমই খাত দাঁড়াতে পারবে। গুরুত্বপূর্ণ কৃষি খাতে সাবসিডি দেয়া হচ্ছে সারের মাধ্যমে। এটা ক্ষুদ্র কৃষক এবং ধনী কৃষক সবার জন্য প্রযোজ্য হচ্ছে। কিন্তু কৃষি খাতে যারা দরিদ্র্য কৃষক, যারা দুই বিঘা, তিন বিঘা ধান চাষ করে, তাদের খুব দুরবস্থা। তারা ধান চাষ করে, ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচও তুলতে পারছে না। এটা এমনিতেই অত্যন্ত দুঃসংবাদ। সে জন্য শুধু কৃষকদের একটা সীমারেখা করা যেতে পারে, দুই বিঘা পর্যন্ত যারা জমি চাষ করে, তাদের জন্য কিছু নগদ অনুদান দেয়া যেতে পারে। বহুল আলোচিত ২০১২ সালের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইনটি বাস্তবায়নের ঘোষণা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, হচ্ছে। ব্যক্তিশ্রেণি ও করহার অপরিবর্তিত রেখেই, করপোরেট করহার কমিয়ে অনলাইন অটোমোশন ব্যতিরেকেই ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বহু পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ভ্যাট আইনে টার্নওভার করের সীমাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এটি ভালো উদ্যোগ। এতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা একটু স্বস্তি পাবেন। ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হলো, এ দেশের বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন নেই। অথচ এসব প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দেয়ার যোগ্য। তাদের কাছ থেকে কীভাবে ভ্যাট আদায় করা হবে, সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন থাকলেও হিসাব রাখা হয় আলাদা খাতায়। অনেকে গ্রাহককে ভ্যাটের রসিদ দেন না। এতে বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ফাঁকি হয়। এনবিআর পেরে উঠছে না। এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপশি, রাষ্ট্রীয় সেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে করদাতাকে আস্থায় আনা, মধ্যবর্তী পর্যায়ে কর ও ভ্যাটের অর্থ সিস্টেম লসে লাপাত্তা যাতে না হয়, তার প্রতিরোধ প্রতিবিধান কিন্তু করোনা প্রতিরোধের চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : কলাম লেখক, সাবেক সচিব ও চেয়ারম্যান- এনবিআর। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App