×

রাজনীতি

হেফাজত নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেই ভিন্ন মত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২১, ০৮:৪৭ এএম

সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্পর্ক কী- তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-পর্যালোচনা। এ নিয়ে একাধিক মত আছে ক্ষমতাসীন দলটির মধ্যে। একটি অংশ চায়, হেফাজতে পছন্দমতো নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা। আরেকটি পক্ষ মনে করে, সংগঠনটির কোনো অংশকেই আর আস্থায় না নিয়ে ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী এই সংগঠনগুলোকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া উচিত। কিন্তু কৌশলগত কারণে এ ইস্যুতে সরকারের অবস্থান নিয়ে ক্ষমতাসীন দলটির কোনো নেতাই প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না। আলাপকালে ব্যক্তিগত মতামত জানিয়েছেন কেউ কেউ। তবে এ ইস্যুতে চূড়ান্তভাবে দলীয় ও সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্তেই আস্থা তাদের।

ক্ষমতাসীন দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই মুহূর্তে হেফাজতের সঙ্গে দুটি লক্ষ্য সামনে রেখে সম্পর্ক গড়তে চলেছে আওয়ামী লীগ। প্রথমটি হচ্ছে আগামীতে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনে তাদের কর্মীদের সমর্থনের পাশাপাশি সরকারের সব সিদ্ধান্তে ঐকমত্য। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিষ্কণ্টকভাবে জয় পেতে হেফাজতের সমর্থন পাওয়া। তবে হেফাজত যদি কথা না শোনে বিদ্যমান কঠোর অবস্থানেই অনড় থাকবে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী আ.লীগ।

হেফাজত ইস্যুতে সরকার ও আওয়ামী লীগে যে দুটি পক্ষ রয়েছে। হেফাজতে পছন্দমতো নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় যুক্তি হচ্ছে, এই লক্ষ্য হাসিল হলে সংগঠনটি ভবিষ্যতে আর সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারবে না। সংগঠনটির প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীসহ তার অনুসারীদের দিয়ে একটি কমিটি করতে পারলে এই লক্ষ্য সফল হবে। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীসহ ২০ দলীয় জোটের ইসলামী দলগুলোও আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না।

আরেকটি পক্ষের চাওয়া, আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী বা বাবুনগরী- কোনো পক্ষকেই আস্থায় না নেয়া। এই পক্ষের নেতারা মনে করেন, এরা সবাই এক ও অভিন্ন। তাদের বেশির ভাগ নেতাই ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। নানা ইস্যুতে সরকারকে চাপে রাখার কৌশল নেবে। কাজেই তাদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান কঠোর অবস্থানে থাকাটাই দল ও সরকারের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। এই পক্ষটি চায় ধর্মের অপব্যাখ্যাকারী এই গোষ্ঠীগুলোকে একেবারেই নিশ্চিহ্ন করতে।

আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ভোরের কাগজকে জানান, সরকার কিংবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পর্ক হয়েছে, এটা সঠিক নয়। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে এ দেশের সব মানুষের প্রতিনিধি। তার দৃষ্টিতে সবাই সমান। সমাজের একটি অংশ এগিয়ে যাবে, আরেকটি অংশ পিছিয়ে থাকবে- এটি তিনি মানতে পারেননি। সে জন্যই কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতি দিয়েছেন। এর ফলে কওমি মাদ্রাসায় যেসব ছাত্র পড়াশোনা করছেন তারাও একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেন। এটা দোষের কিছু নয়। এখানে যদি কেউ মনে করে সরকার হেফাজতের সঙ্গে আপস করেছে, তাহলে সেটা সঠিক নয়।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, হেফাজতের ব্যাপারে সরকারের বিশেষ কোনো এজেন্ডা নেই। তবে দেশে যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত ছিল, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত ছিল- তাদের দমনে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনিপন্থায় কাজ করছে। এখানে সরকারের কঠোর বা নমনীয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। ধর্মের অপব্যবহার করে যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড করবে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর থাকবে।

ক্ষমতাসীন দলটির বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত হেফাজতের নেতারা রিমান্ডে যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকার পতনের যে ছক হেফাজত নেতারা করেছিল, পাশাপাশি নতুন সরকার গঠনের যে ছক- সেসব তথ্যও সরকার ও দলের হাইকমান্ড গভীরভাবে আমলে নিয়েছে। সেগুলো বিশ্লেষণও করা হচ্ছে। তবে ২০১৩ সালের মতোই এবারো সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে নাশকতাসহ তাদের পরিকল্পনার জন্য বিএনপি ও জামায়াতকেই দায়ী করেছেন হেফাজত নেতারা। সরকারের সঙ্গে আপস-সমঝোতা করেই সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে তারা তাদের কর্মকাণ্ড চালাতে চায়। সরকারের একজন মন্ত্রীর সঙ্গে দুই দফা সাক্ষাতে এমন মনোভাব ব্যক্ত করেছেন তারা। কিন্তু সরকার তাদের এই কথার ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। তাই সরকারের আস্থা ফেরাতে একপ্রকার কঠিন চাপে থাকা হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী গ্রেপ্তার ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাদ দিয়ে গত সোমবার নতুন কমিটি গঠন করেছেন। কিন্তু তাতেও সরকার তাদের ওপর আস্থাশীল হতে পারছে না। অন্যদিকে সংগঠনটির প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানী ও তার অনুসারীরা বর্তমান কমিটিকে বিএনপি-জামায়াতঘেঁষা ও শাহ আহমদ শফীর আদর্শচ্যুত উল্লেখ করে হেফাজতের নতুন কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। খুব শিগগিরই এই অংশটি নতুন কমিটি ঘোষণা করবে বলেও জানা গেছে। এই অংশটি সরকারঘেঁষা বলে প্রচার রয়েছে। এই অংশটিকে দিয়েই অপর অংশটিকে চাপে রাখবে সরকার।

২০১০ সালে নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা হেফাজতে ইসলাম জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধেও সরব ছিল। ২০১৩ সালের ৫ মে ১৩ দফা দাবি নিয়ে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান করে সংগঠনটি। সারাদেশ থেকে সেদিন নিরীহ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ঢাকায় জড়ো করেছিল তারা। সেদিন তারা ঢাকায় তাণ্ডব ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। একপর্যায়ে সমাবেশ থেকে সরকার পতনের হুমকি দেয়। সরকার শক্ত অবস্থান নিয়ে রাতে অভিযান চালিয়ে তা পণ্ড করে দেয়। ওই সময়ই হেফাজতের তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে সরকারের একটি অংশের যোগাযোগ তৈরি হয়। দীর্ঘ সময় এ সুসম্পর্ক ছিল। ২০১৭ সালে হেফাজতের দাবি মেনে সরকার পাঠ্যবইয়ে কিছু বিষয় সংশোধন করে। ওই বছরই গণভবনে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির স্বীকৃতির ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীসহ সংগঠনটির নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পরে তা জাতীয় সংসদে পাস করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শোকরানা মাহফিলের আয়োজন করে হেফাজতে ইসলাম। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি ছিলেন। মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমি জননী’ উপাধি দেয়া হয়।

শাপলা চত্বরের ঘটনায় ৫৩টি মামলা দায়ের করে পুলিশ। অনেককেই গ্রেপ্তারও করা হয় তখন। কিন্তু দীর্ঘ ৮ বছরেও সেগুলোর কোনো চার্জশিট হয়নি। ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরে শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর সংগঠনটির কর্তৃত্ব চলে যায় বিএনপি-জামায়াতঘেঁষা জুনায়েদ বাবুনগরীর হাতে। ২০ দলীয় জোটের বেশির ভাগ শরিক ইসলামী দলের নেতা এই কমিটির শীর্ষ নেতৃত্বে আসে। এই কমিটি থেকে বাদ পড়েন শফীর অনুসারীরা। এরপর থেকেই সরকারের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় হেফাজতের। তা কিছুটা দৃশ্যমান হয় ধোলাইপাড়ে নির্মিত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। প্রথমে হেফাজত নেতা মামুনুল হক এবং পরে জুনায়েদ বাবুনগরীর বক্তব্যে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এরপর নড়েচড়ে বসে সরকার। তখন আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির সুরাহাও হয়। কিন্তু বড় সংকট তৈরি হয় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকায় আসার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে। ২৬, ২৭ ও ২৮ মার্চ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারকে ভাবমূর্তি সংকটে ফেলে। সরকার বিষয়টি একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি। এই পরিস্থিতিতেই এপ্রিলের শুরুতে নারায়ণগঞ্জের একটি রিসোর্টে নারীসহ আটক হন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক। যিনি ২০ দলের শরিক খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতা। এরপর পরিস্থিতি উত্তপ্তের চেষ্টা করে তার অনুসারীরা। সরকারও হার্ডলাইনে যায়। ২০১৩ সালের মামলা সচল করে একে একে গ্রেপ্তার করা হয় মামুনুল হকসহ হেফাজতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে।

হেফাজতের বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থান নেয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েন সংগঠনের নেতারা। বাবুনগরীর বিরুদ্ধেও পুরনো মামলা সচল করা হয়, যুক্ত হয় আরো কয়েকটি মামলা। জব্দ করা হয় তার ব্যাংক ও সম্পদের হিসাব। বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্যও বেরিয়ে আসা শুরু হয়। সরকারের এই মনোভাব বুঝতে পেরে হেফাজতের মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদীর নেতৃত্বে কয়েকজন নেতা সরকারের সঙ্গে সমঝোতার দেনদরবার শুরু করেন। তারা দুই দফায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও তার বাসায় সাক্ষাৎ করেন। ভুলত্রুটি স্বীকার করে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার পথ খুঁজছেন তারা। কিন্তু সরকার তার অবস্থান থেকে নড়বে না বলে আভাস মেলে।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনার পর আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে হেফাজত তাদের ভুল স্বীকার করেছে। তারা তখন সে দিনের সহিংসতার জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দোষ দিয়েছিলেন। তারা বলেন, এই নাশকতা সৃষ্টি করেছে বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা। মাদ্রাসার ছাত্ররা নাশকতায় ছিল না। সেই সঙ্গে তারা ভবিষ্যতে সহিংসতার পথে না হাঁটার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ফলে সরকার তাদের সুযোগ দিয়েছিল। কওমি মাদ্রাসার সনদের স্বীকৃতি দিয়ে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসার উদ্যোগ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু আহমদ শফীকে নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে পুনরায় উগ্রবাদী কর্মকাণ্ড শুরু করা হয়। সহিংসতার সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের নির্মূল করার দায়িত্ব সরকারের। এখন সেটাই করা হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App