×

মুক্তচিন্তা

মানুষে করোনা : ইলিশে তাড়না

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২১, ১২:১২ এএম

না সাবজেক্ট, না অবজেক্ট। এরপরও আচমকা ইলিশ হয়ে গেল সাবজেক্ট। বাজেট, করোনা মহামারি, করোনার নানা ভেরিয়েন্ট, লকডাউন, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ইত্যাদি গরম ইস্যুর মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় মাছটি ইলিশ নিয়ে তুমুল আলোচনা। জম্পেশ এ আলোচনা ও ট্রলের উপলক্ষ মূলত ইলিশ নিয়ে নয়, মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় শিমুলিয়া ঘাটের কাছে নবনির্মিত রেস্তোরাঁ ‘প্রজেক্ট হিলসা’র কারণে। ব্যতিক্রমী স্থাপনার কারণে অল্পদিনেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটির ব্যাপক প্রচার, আলোচনা, সমালোচনা। অনেকে ছবি-ভিডিও দেখে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে যাচ্ছেন ইলিশ মাছের আদলে তৈরি রেস্তোরাঁটিতে। গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন অনেকে। আর দ্বিতীয়বার যাওয়ার নাম নিচ্ছেন না। বিশেষ করে রেস্তোরাঁটিতে খাবারের দামে চলে পকেট কাটা। খাবার বিলের সঙ্গে সরকারি করের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি যুক্ত করছে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের বাইরে আরো ১০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ। ৪০ হাজার বর্গফুট আয়তনের রেস্তোরাঁটিতে ইলিশ মাছের ২৪ ধরনের রেসিপিসহ মোট ৩০০ ধরনের খাবার পাওয়া যায়। সেখানে প্রতিটি খাবারের দামই আশপাশের অন্যান্য রেস্তোরাঁ থেকে দ্বিগুণ বা আরো বেশি। প্রতি পিস বেগুনভাজির দাম ৫০ টাকা। যা শিমুলিয়া ঘাটের অন্যান্য রেস্তোরাঁয় ১৫-২০ টাকা। প্রতি বাটি ডালের দাম ১০০ টাকা। অন্য রেস্তোরাঁয় ডাল পাওয়া যায় ৫০-৭০ টাকা বাটি। আর প্রতি পিস ইলিশ মাছের দাম নেয়া হয়েছে ১ হাজার ৮০০ টাকা। যেখানে অন্য রেস্তোরাঁয় এক কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের প্রতি পিস ইলিশের দাম নেয়া হয় ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। অর্ডারের পর খাবার পরিবেশনে বিলম্ব এবং মূল আকর্ষণ ইলিশ মাছের মানও প্রশ্নবিদ্ধ। কর্তৃপক্ষের দাবি, রেস্তোরাঁর পরিবেশ আর মানের তুলনায় দাম তেমন নয়। মাছের রাজা ইলিশ নানা সময়েই সাবজেক্ট হয়েছে বাংলাদেশে। ভারতেও। পুবালি বাতাস ও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ইলিশের প্রজনন বেশি হয়। সেই সময়েই সমুদ্রের তলদেশ থেকে ইলিশ উপরে উঠে এসে মোহ?না দিয়ে নদীর মিঠা পানিতে ঢোকে। সেখানে ডিম পেড়ে আবার ফিরে যায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আলাদা ইতিহাস ও ঐতিহ্য, সেইসঙ্গে স্বীকৃত পণ্য আছে। সে হিসেবে চাঁদপুর জেলা ব্যাপকভাবে সমাদৃত ইলিশ উৎপাদনের জন্য। এজন্য এই জেলাকে ‘ইলিশের বাড়ি’ বলা হয়ে থাকে। ইলিশ বিচরণ করে লোনা পানিতে, কিন্তু ডিম পাড়ার সময় তারা মিঠা পানির মোহনায় আসে। চাঁদপুরের পদ্মা নদীতে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাঙ্কটন আছে, যেটা মা ইলিশের প্রধান খাবার। এই প্ল্যাঙ্কটন আর অন্য কোনো জেলায় নেই। পানির মান আর খাবার থাকায় মা ইলিশ এখানে ডিম ছাড়তে আসে। সেই বিবেচনায় চাঁদপুরই ইলিশের বাড়ি। ইলিশের মোট উৎপাদনের হিসাব কষে বরগুনা জেলাও এই দাবিদার। তবে বাড়ি নয়, তারা হতে চায় ‘ইলিশের জেলা’। কারণ বরগুনা জেলার ৬টি উপজেলায় ইলিশ উৎপাদন ও ধরার অবস্থান চাঁদপুরের চেয়ে কয়েক ধাপ বেশি। জাতীয় মাছ ইলিশকে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করার পেছনে বরগুনা সবচেয়ে বেশি ভূমিকার রেখেছে বলেও দাবি স্থানীয়দের। ইলিশ উৎপাদনের হিসাবে বরিশাল বিভাগের ভোলা জেলার স্থান শীর্ষে। তারা ইলিশ বাড়ি বা ইলিশ জেলা কোনোটাই দাবি করছে না। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা। ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ইলিশের প্রায় ৮৫ শতাংশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। ইলিশকে ইলশা-হিলশা নামেও ডাকা হয়। এটির বৈজ্ঞানিক নাম টেনুয়ালোসা ইলিশা। পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা, আসামসহ ভারতেও ইলিশের ব্যাপক কদর। ক্ষেত্রবিশেষে বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। ২০১৭-এ বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ভারতের আসামের ভাষায় ‘ইলিশ’ শব্দটি রয়েছে। তেলেগু ভাষায় ইলিশকে তেলগু এবং পোলাসা দুটি নামই পাওয়া যায়। ওড়িয়া ভাষায় ইলিশি। গুজরাটে ইলিশ মাছ মোদেন (স্ত্রী) বা পালভা (পুরুষ) নামে পরিচিত। আর পাকিস্তানের সিন্ধ ভাষায় বলা হয় পাল্লু মাছি। বাংলাদেশের পদ্মা (গঙ্গার কিছু অংশ), মেঘনা (ব্রহ্মপুত্রের কিছু অংশ) এবং গোদাবরী নদীতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যায়। এর মাঝে পদ্মার ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে ভালো বলে ধরা হয়। ভারতের রূপনারায়ণ নদী, গঙ্গা, গোদাবরী নদীর ইলিশ তাদের সুস্বাদু ডিমের জন্য বিখ্যাত। ইলিশ মাছ সাগর থেকেও ধরা হয় কিন্তু সাগরের ইলিশের স্বাদ নদীর মাছের মতো নয়। দক্ষিণ পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশেও এই মাছ পাওয়া যায়। সেখানে মাছটি পাল্লা নামে পরিচিত। বর্তমানে সিন্ধু নদীর জলস্তর নেমে যাওয়ার কারণে পাল্লা বা ইলিশ আর দেখা যায় না। বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় এবার নদীতে ইলিশ ধরা পড়ছে নেহায়েত কম। আগের মতো ইলিশ না পাওয়ায় হতাশ জেলে থেকে শুরু করে ইলিশ মোকামের ব্যবসায়ী-আড়তদার সবাই। হঠাৎ ইলিশের এমন ‘হারিয়ে যাওয়ায়’ বিস্মিত জেলেরা। ইলিশের এমন ক্রাইসিস গণমাধ্যমে তেমন নিউজ আইটেম নয়। তবে শিরোনাম হয়ে এলো শিমুলিয়া ঘাটের ‘প্রজেক্ট হিলসা’ রেস্টরেন্টের উছিলায়। কী কারণে জালে ইলিশ উঠছে না তার তেমন ব্যাখ্যা জানা নেই জেলেদের কাছে। প্রজনন ও ডিম ছাড়ার মৌসুমে ইলিশ বা ইলিশের বাচ্চা ধরায় কড়াকড়ির সুবাদে গত ৬-৭ বছরে ইলিশ আহরণে বলা যায় বিপ্লব ঘটে গেছে। দেশে ইলিশের পরিমাণ বেড়েছে। গড় আকারও অনেক বেড়েছে। এসবের মূল কারণ, সাগরে নির্দিষ্ট সময় মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা। ওই সময় ইলিশ বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। অভয়াশ্রমগুলোতে জাটকা ধরা এবং নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ ধরা বন্ধ করার কারণে উৎপাদন বেড়েছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে জেলেদের সাময়িক কষ্ট হচ্ছে। তবে ঠকছে না। রেশনসহ কম-বেশি প্রণোদনা পাচ্ছে তারা। এক সময় তাদের রেশন-প্রণোদনায় ঠকানোর যে অভিযোগ ছিল, সেটাও ধীরে ধীরে কমতির দিকে। দেশে মোট উৎপাদিত মাছের প্রায় ১২ শতাংশ এই রুপালি ইলিশ দখল করে আছে। দেশের জিডিপিতে ইলিশের অবদান এক শতাংশের বেশি। বিশ্বে নিজস্ব পরিচয় সৃষ্টি করে সমাদর কুড়ানো ইলিশ ধরা পড়ছে না, মানে পালিয়েছে, ঘটনা এমন নয়। সাগর উত্তাল থাকায় জেলেরা সাগরে যেতে না পারায় ইলিশ ধরা পড়ছে কম। জাটকা সংরক্ষণ, অভয়াশ্রম ব্যবস্থাপনা এবং ইলিশ প্রজনন সুরক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে ইলিশের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে চালানো কম্বিং অপারেশনগুলোর ফল মিলবে ধীরে ধীরে। সবে তো জ্যৈষ্ঠ শেষের পথে। সামনে এবারের আষাঢ়-শ্রাবণে প্রচুর ইলিশের দেখা মিলবে। প্রকৃতির তাড়না বা আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা ইলিশকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। উজানের পানির তীব্র স্রোত ডিঙিয়ে ইলিশের অভয়াশ্রমে ফেরা প্রায় অসম্ভব। পর পর কয়েকটি লঘুচাপ, তার ওপর উজানের পানি জেলেদের ঘরবৈঠা করে দিয়েছে। পরিস্থিতি অনুকূলে এলে ইলিশ শিকারে ঘরের বাইর হবেন তারা। গল্প-কবিতা না জমুক ইলিশের মুখ দেখবে বাঙালি। ইলিশ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক মাতামাতি হয়েছে। গল্প আর ছোট গল্পের সঙ্গে তা কবিতায়ও। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিভিন্ন কবিতায় পদ্মা নদীর কথা এসেছে বহুবার। রবীন্দ্রনাথ যে বজরায় করে ঘুরে বেড়াতেন তার নামও ছিল ‘পদ্মা’। ইলিশ নিয়ে প্রথম সার্থক কবিতা বুদ্ধদেব বসুর, ১৯৩৮ সালের জুন মাসে লেখা। এ কবিতাতেই বাংলার আষাঢ় আর ইলিশের বর্ণনার সঙ্গে এসেছে গোয়ালন্দের ইলিশ শিকারিদের কথা। দেশভাগের আগের কথাÑ যখন অধিকাংশ ইলিশেরই গন্তব্য ছিল কলকাতা। বাংলা সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন যে ক’জন সাহিত্যিক, তাদের মধ্যে অন্যতম বুদ্ধদেব বসু। বেশ ভোজন রসিকও ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App