×

রাজধানী

বস্তি নয় যেন টাকার খনি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২১, ০৮:৪১ এএম

বস্তি নয় যেন টাকার খনি!

রোদ-ঝড়-বৃষ্টিই এখন তাদের সঙ্গী। সম্বলটুকু হারিয়ে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্ত‚পের মাঝে ঘুমন্ত শিশুসন্তান কোলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় এক নারী। গতকাল মহাখালীর সাততলা বস্তি থেকে তোলা ছবি: ভোরের কাগজ

মহাখালী সাততলা বস্তিতে অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সংযোগ ও বর্জ্য অপসারণেই মাসে কোটি টাকার বাণিজ্য

সাধারনত নিম্ন আয়ের মানুষরাই কম টাকায় থাকার জন্য বস্তিকে বাসস্থান হিসেবে বেছে নেন। যেখানে নাগরিক সুবিধার কিছুই থাকেনা বললেই চলে। কিন্তু নিম্ন আয়ের এ মানুষদের ব্যবহার করেই একদিকে দখল করা হচ্ছে সরকারি জমি, অন্যদিকে তাদেরকে শোষণ করে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিও এর বাইরে নয়। বস্তিটিতে অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির লাইন ও ময়লার টাকা বাবদই হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বস্তিবাসিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গড়ে তোলা হয়েছে এলাকা ভিত্তিক গ্যাং। উঠতি কিশোর ও নারীদের কাজে লাগিয়ে হরদম চলছে মাদক ব্যবসাও।

শুধু এগুলোই নয়, বস্তিতে দোকান বসিয়ে ভাড়া দেয়া, অটোরিকশা থেকে চাঁদাবাজি ও গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে কাড়ি কাড়ি টাকা। অবস্থাটা এমন, বস্তিটি যেন বস্তি নয়; পুরোটাই টাকার খনি। এর নেপথ্যের নায়করা গ্যাং নিয়ে বস্তিতে শোডাউন দিলেও তারা বস্তিতে থাকেন না। বছরের পর বছর গরীব খেটে খাওয়া মানুষের রক্ত চুষে তারা থাকেন অট্টালিকায়। চলাফেরা করেন নামিদামি সব গাড়িতে। যাদের মধ্যে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, থানা পুলিশ, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়াসার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সাততলা বস্তির বাসিন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

বস্তিবাসীরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারি জায়গার উপর গড়ে ওঠা সাততলা বস্তিতে রয়েছে আড়াই হাজার ‘ঘর’। প্রতি ঘরে কমপক্ষে ৮টি কক্ষ রয়েছে। কোনো কোনো ঘরে কক্ষের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০টি। কক্ষপ্রতি বর্জ্য অপসারণ বাবদ নেয়া হয় ৭০ টাকা করে। ঘরপ্রতি কমপক্ষে ৮টি কক্ষ হিসাব করলেও মাসে ১৪ লাখ টাকার বাণিজ্য হয় ময়লা সংগ্রহকে কেন্দ্র করে। স্থানীয় ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছিরের ঘণিষ্টজন হিসেবে পরিচিত আতর আলী ময়লার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। তার ঠিক করে দেয়া লোকজনই প্রতি মাসে ময়লার টাকা সংগ্রহ করে। আড়াই হাজার ঘরের প্রতিটিতেই রয়েছে তিতাসের অবৈধ গ্যাস সংযোগ। প্রতি ঘরে ২ চুলার গ্যাস সংযোগের জন্য ঘর মালিককে মাসপ্রতি গুনতে হয় ১৪০০ টাকা। যে ঘরে কক্ষের সংখ্যা বেশি তারা ৩ চুলার জন্য সংযোগ নেন। এক্ষেত্রে গুনতে হয় ২১০০ টাকা। ঘর প্রতি ২ চুলার সংযোগ হিসাব করলেও মাসে ৩৫ লাখ টাকা তোলা হয় বস্তি থেকে। গ্যাস সংযোগের মূলহোতা শাহআলম, আনোয়ার ও রতন। একই অবস্থা বিদ্যুৎ সংযোগের বেলাতেও। অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে প্রতিমাসে হাতানো হচ্ছে ৩৭ লাখ টাকা। বিদ্যুৎ সংযোগের মূলহোতা মোদাচ্ছের। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেন মোতালেব। অবৈধ পানির সংযোগের মাধ্যমে হাতানো হচ্ছে কমপক্ষে ২৫ লাখ টাকা। বস্তিবাসীর যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকেও গুনতে হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা। অটোরিকশা থেকে চাঁদা উঠানোর কাজটি করে থাকেন দেলোয়ার ও শামীম।

এছাড়াও বস্তিজুড়ে শতাধিক দোকান তৈরি করে প্রতিমাসে দোকানপ্রতি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা ভাড়া নেয়া হচ্ছে। রিকশা ও অটোরিকশা রাখার জন্য গ্যারেজ বানিয়েও হাতানো হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এসবকিছুর পেছনে কাউন্সিলর নাছিরের লোকজন জড়িত বলে দাবি বস্তিবাসির। জানা গেছে, প্রভাবশালী মহল বস্তির চৌধুরীপাড়া, মন্দিরপাড়া, পোড়া বস্তি, বাউন্ডারি বস্তি, কবরস্থান ও স্টাফ মহল্লা এলাকায় গ্যাং গড়ে তুলেছে। কেউ চাইলেও এই সিন্ডিকেটের বাইরে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ নিতে পারেন না। তবে, যারা কয়েক দশক ধরে বস্তিতে রয়েছেন, তারা সরাসরি ডেস্কো, তিতাস ও ওয়াসার কর্মকর্তা কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে এসব লাইন নেন। কেননা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিলে প্রতি মাসে গুনতে হয় দেড়গুন বেশি টাকা। শুধু এসবই নয় বস্তিকে ঘিরে চলছে মাদকের রমরমা ব্যবসাও। বাউন্ডারি বস্তিতে একসময় সীমা বেগমের স্বামী পিংকু মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করলেও বন্দুক যুদ্ধে তার মৃত্যুর পর এখন সীমা বেগমই হাল ধরেছেন। বাউন্ডারি বস্তি ঘিরে সীমা বেগমের আলাদা গ্যাং তৎপর থাকে সারাক্ষণ। মাদক ব্যবসা ছাড়াও বাউন্ডারি বস্তি এলাকায় পানির সংযোগ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি।

এ ছাড়া ইউসুফ মীর্জা, সাইদুল, হেনা আফরিন, নাপিত সবুজ, আনোয়ার, ইমন, নুর হোসেন, বডু জাকির, ঢাকাইয়া শামীম, গ্যাস মানিক, জাকির, ক্যারেন্ট জলিল, সাদ্দাম, ওমর ফারুকসহ ১২-১৩ জনের চক্র গ্যাস, বিদ্যুতের চাঁদা তোলে এবং মাদক ব্যবসা করে। বস্তিবাসি জানান, এখন বস্তির সব জমি প্রভাবশালী মহলের পছন্দের মানুষদের দখলে থাকায় অধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তেমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে না। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর আবারো নয়া বাণিজ্যে নামে প্রভাবশালী মহলটি। উচ্ছেদ অভিযানের কিছুদিন পরই প্রশাসনকে ম্যানেজ করে জায়গা প্রতি হাতানো হয় লাখ লাখ টাকা।

সরজমিনে সাততলা বস্তি ঘুরে দেখা যায়, পুরো বস্তি ঘিরেই রয়েছে অবৈধ গ্যাস সংযোগের লাইন। মানহীন পাইপ দিয়ে প্রতি ঘরে সংযোগগুলো নেয়ায় ঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করতে হচ্ছে বস্তির খেটে খাওয়া মানুষদের। বিদ্যুতের মানহীন তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ফলে যে কয়বার বস্তিতে আগুন লাগছে তার কারণ হচ্ছে এই গ্যাস সংযোগে লিকেজ অথবা বিদ্যুতের তারে শর্টসার্কিট। ঘরগুলো বাশ ও কাঠ দিয়ে তৈরী করায় মুহুর্তে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে আগুন। সবশেষ গত সোমবার ভোরেও গ্যাস লিকেজ থেকে আগুন লেগে পুড়ে গেছে বস্তির ১২৫টি ঘর। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে মানহীন এসব সংযোগে যেকোনো সময় আরো বড় ধরণের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বস্তিবাসী।

সাততলা বস্তির অংশ বাউন্ডারি বস্তির বাসিন্দা ঘর মালিক ইতি আক্তার ভোরের কাগজকে জানন, ৮টি কক্ষের একটি ঘর বানিয়ে ভাড়া দিয়েছিলেন। সোমবারের আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে, ঘর করার পর চান্দি ইউসুফের মাধ্যমে মাসে ১৪০০ টাকা চুক্তিতে গ্যাসের লাইন নেন। সাইদুলের কাছ থেকে নিয়েছেন বিদ্যুতের সংযোগ। শুধু পানির সংযোগটা ৪টি ঘরের মালিকরা মিলে ওয়াসায় ঘুষ দিয়ে নিয়েছেন। ওয়াসার টাকাটা তারা সরকারি কোষাগারে বৈধভাবে দেন বলে দাবি করেন। তবে, বেশিরভাগ পানির সংযোগ অবৈধ বলে জানিয়েছেন একাধিক বাসিন্দা।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত অপর ঘরমালিক নাসিমা বেগম ভোরের কাগজকে বলেন, প্রথমে একজন ১০ টাকা ইউনিট হিসাবে বিদ্যুতের সংযোগ দিলেও সাইদুল ৭ টাকা ইউনিট হিসেবে বিদ্যুতের সংযোগ দেয় জানতে পারি। পরে সাইদুলের দেয়া বিদ্যুতের লাইন ব্যবহার করছি। গ্যাসের লাইন দিয়েছে ইউসুফ মীর্জা। তবে, তারা কিভাবে কার মাধ্যমে আমাদের এ সংযোগ দেয় আমরা জানি না। আমাদের দরকারে তাদের সহযোগিতা নিয়েছি। জানা গেছে, স্থানীয় কাউন্সিলরের ছত্রছাঁয়ায় সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে গড়া শক্ত সিন্ডিকেটের কারণে তিনটি সেবা খাতের (গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি) মধ্যে গ্যাস থেকে এক কানাকড়িও যায় না সরকারের ঘরে। তবে বিদ্যুৎ ও পানি থেকে যৎসামান্য অর্থ জমা হয় সরকারি কোষাগারে।

বস্তি ঘিরে কোটি টাকার বাণিজ্যের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চেয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. নাছিরকে দফায় দফায় ফোন করা হলেও তার ব্যবহৃত ফোন নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়। এমনকি একাধিক খুদে বার্তা পাঠিয়েও উত্তর মেলেনি। তবে, বস্তিতে গড়ে ওঠা মাদক ব্যবসা ও অন্যান্য অপরাধ সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে বনানী থানার ওসি নূরে আযম মিয়া ভোরের কাগজকে বলেন, বস্তি মাদকের আখড়া- সাধারণ মানুষের মধ্যে এ ধরণের ধারণা থাকলেও এখন তেমনটি নেই। মাদক ব্যবসায়ীরা বেশিরভাগ ভ্রাম্যমাণভাবে মাদকের কেনাবেচা করে থাকেন। পাশাপাশি সাততলা বস্তিতে কোনো মাদক চক্র বা গ্যাং গড়ে উঠেছে; তেমন তথ্যও আমাদের কাছে নেই। তবে, এ ধরণের তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান চালাবো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App