×

জাতীয়

বিতর্কমুক্ত হলো না হেফাজত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২১, ০৯:১১ পিএম

নতুন কমিটিতে মামুনুল ও আজিজুলসহ আটক বিতর্কিত নেতারা স্থান না পেলেও আমির ও মহাসচিব পদে বহাল রয়েছেন বাবুনগরী ও নুুরুল জিহাদী।

নানা ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের মুখে কমিটি বিলুপ্তির দেড় মাসের মাথায় আলোচিত-সমালোচিত কওমী ঘরানার সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। সোমবার (৭ জুন) ঘোষণা করা ৩৩ সদস্যের নতুন কমিটিতে মামুনুল হক-ইসলামাবাদীসহ আটক বিতর্কিত নেতারা স্থান না পেলেও আমির ও মহাসচিব পদে বহাল রয়েছেন জুনায়েদ বাবুনগরী ও নুরুল ইসলাম জিহাদী। ঘোষিত এই কমিটিতে বিভিন্ন ইসলামী দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার ঝরে পড়ার ফলে কিছু নতুন মুখ যুক্ত হয়েছে বটে, তবে বাবুনগরীর আত্মীয়-স্বজন ও অনুসারীদের জায়গা করে দেয়ার পাশাপাশি সাবেক আমির প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফীর অনুসারীরা ফের উপেক্ষিত হওয়ায় পুরোপুরি বিতের্কর উর্ধ্বে রাখা যায়নি কমিটি।

বিশেষ করে এই কমিটিতে সব থেকে যে বিষয়টি নিয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে, ঘুরেফিরে সেই জুনায়েদ বাবুনগরীই আমির পদে বহাল রয়েছেন। যিনি সাবেক আমির প্রয়াত আল্লামা আহমদ শফী হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা একটি মামলার প্রধান আসামি হিসেবে বিতর্কিত ভূমিকায় রয়েছেন। এছাড়া বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ততার পাশাপাশি বিভিন্ন নাশকতা ও সহিংসতার পেছনে তার ইন্দন রয়েছে বলেও অভিযোগ আছে। এছাড়া নতুন কমিটিতে যারা অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন তারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলা হলেও এ তথ্যও সঠিক নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কমিটি শুধুই লোক দেখানো। কারণ হেফাজতের বিলুপ্ত যে কমিটি সেই কমিটিও করেছিলেন জুনায়েদ বাবুনগরী। এরপর কমিটি ভেঙে দিলেনও জুনায়েদ বাবুনগরী। নতুন আহবায়ক কমিটি তৈরি করলেন জুনায়েদ বাবুনগরী। আবার নতুন কমিটি করা হলো সেটিতেও আমির হিসেবে বহাল থাকলেন তিনি। মানে পুরো হেফাজত আসলে নিয়ন্ত্রণ করছেন জুনায়েদ বাবুনগরী এবং এই নিয়ন্ত্রণেরই একটি চিত্র এই নতুন কমিটি। এ অবস্থায় এই কমিটিকে নতুন বোতলে পুরোনো মদ বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর খিলগাঁওয়ে আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া মাখজানুল উলুম মাদ্রাসায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফের মহাসচিব মনোনিত হওয়া নুরুল ইসলাম জিহাদী বলেন, ছোট পরিসরে এই কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। হেফাজতের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট হবে। ৩৩ সদস্যের এ নতুন কমিটি অন্যদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারবে। এছাড়া ভবিষ্যতে প্রত্যেক জেলা কমিটির সভাপতি পদাধিকার বলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং জেলা কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে জিহাদী বলেন, আগের কমিটির যারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, তাদের নাম এই ৩৩ সদস্যের ঘোষিত কমিটি নেই। এই কমিটি পরবর্তীতে চিন্তা-ভাবনা করে দেখবে আর কে কে এই কমিটিতে যুক্ত হবেন। যারা কারাগারে আছেন তারা এখানে অন্তর্ভুক্ত হবেন কিনা, তা পরে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। একই সঙ্গে হেফাজতের নতুন কমিটি ‘সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ সঙ্গে যুক্ত থাকবে বলেও ঘোষণা দেন তিনি।

জানা যায়, গত ২ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে আলেমদের ‘সরলতার সুযোগে’ একটি মহল তাদের ‘ভুলপথে ঠেলে দেয়ার ‘পাঁয়তারা’ করছে বলে অভিযোগ করেন হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা আমির আহমেদ শফীর অনুসারীরা। হেফাজত তাহলে দুই ভাগে বিভিক্ত কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে নতুন মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদী বলেন, এখানে বিভক্তির কিছু নেই। তারা (শফীর অনুসারী) আমাদের বলেছেন, এই কমিটিতে তারা আমাদের সাথে থাকবেন। তারা যে সংবাদ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, তা হেফাজতে ইসলামের কোনো ব্যানারে করেনি। তারা আল্লামা আহমদ শফীর ভক্তবৃন্দ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এখানে বিদ্রোহ ঘোষণার কোনো নিউজ আমরা পাইনি।

এদিকে আহমদ শফীর ছোট ছেলে আনাস মাদানীকে না রাখলেও বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ মাদানীকে কমিটির সহকারি মহাসচিব পদে স্থান দেয়া হয়েছে। তবে ইউসুফ মাদানী এই পদ ও কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা জানতে চান, আপনারা আহমদ শফির বড় ছেলে ইউসুফ মাদানীকে কমিটিতে রেখেছেন, তারা বলেছেন, এই কমিটি তারা মানেন না এবং এই কমিটিতে থাকবেন না। এর জবাবে জিহাদী বলেন, আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, ওনারা এই কমিটিতে থাকবেন বলেছেন। তারা বললে আপনার সঙ্গে বলেছে, আমাদের সঙ্গে তো বলেনি।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই হেফাজতের আমির ছিলেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী। তিনি গত বছর মারা যাওয়ার পর নানা আলোচনার মধ্যে গত ১৫ নভেম্বর সম্মেলনে বাবুনগরীকে আমির করে হেফাজতের ১৫১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠিত হয়েছিল। তার আগে থেকে দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় থাকা হেফাজতের নেতারা গত বছরের শেষ দিকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতায় নেমে ফের আলোচনায় আসেন। সংগঠনটির নেতা মামুনুল হক ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকিও দেন। পরে তিনি হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবের পদ পাওয়ার পাশাপাশি ঢাকা কমিটির সাধারণ সম্পাদকও হন। নতুন কমিটি গঠনের ছয় মাস পার হওয়ার আগে গত মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের প্রতিবাদে হেফাজতের কর্মসূচি সহিংসতায় গড়ায়। এরপর মামুনুল ছাড়াও সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হলে চাপে পড়ে হেফাজত। পুলিশ দাবি করে, হেফাজত নেতারা নাশকতার বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। এমন নানা বিতর্কের মুখে গত ২৫ এপ্রিল হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন আমির জুনায়েদ বাবুনগরী।

সংবাদ সম্মেলনে ৩৩ সদস্যের কেন্দ্রেীয় কমিটি ছাড়াও মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে প্রধান উপদেষ্টা করে ১৬ সদস্যের আরেকটি উপদেষ্টা কমিটি ঘোষণা করেন হেফাজতের মহাসচিব। এছাড়া হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটির অন্যতম নেতাদের নিয়ে আরেকটি খাস কমিটি (বিশেষ কমিটি) ঘোষণা করা হয়েছে। এতে মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, জুনায়েদ বাবুনগরী, আতাউল্লাহ হাফেজ্জীসহ নয় জনকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এই খাস কমিটিতেও মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও জুনায়েদ বাবুনগরীসহ ঘুরেফিরে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারাই স্থান করে নিয়েছেন। এই খাস কমিটি মূলত সংগঠনের ‘মসলিসে শুরা’ (সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারনী ফোরাম) হিসেবে বিবেচিত। এই কমিটিই হেফাজতের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এখানে উল্লেখ্য, এই মহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা। এছাড়া খাস কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত কেন্দ্রীয় কমিটির নায়েবে আমির আতাউল্লাহ হাফেজ্জী খেলাফত আন্দোলনের আমিরের দায়িত্বে রয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App