×

মুক্তচিন্তা

বাজেটটি গণমুখী করা হোক

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২১, ১২:১০ এএম

আমাদের জাতীয় সংসদে গত ৩ জুন যে বিশাল আকারের বাজেট প্রস্তাব ২০২১-২২ তুলে ধরা হয়েছে তার বাস্তবায়ন অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। স্বাস্থ্যসহ অনেক খাতেই বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যবহার করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই ব্যর্থ হয়ে থাকে। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, প্রয়োজন এবং অর্থÑ উভয়ই থাকা সত্ত্বেও পরিকল্পনার অভাবে টাকাগুলো অব্যবহৃত থাকে এবং জনস্বার্থ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তদুপরি প্রতি বছর নানা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত অর্থের যৌক্তিক ব্যয় অবহেলা করে দুর্নীতির খপ্পরে পড়তেও দেখা যাচ্ছে অনেক খাতকে, কিন্তু সেই দুর্নীতি প্রতিরোধ বা দুর্নীতি যারা করছে তাদের শাস্তির আওতায় এনে টাকাগুলো উদ্ধারের কোনো পথ নির্দেশ নেই। বলা হয়েছে, মাইক্রোবাসকে গণপরিবহনের আওতায় আনার লক্ষ্যে তার মূল্য হ্রাস করা হবে। করোনার এই মহামারির যুগে যখন একের পর এক জেলায় লকডাউন ঘোষিত হচ্ছে, তখন মাইক্রোবাসকে গণপরিবহনে পরিণত করা অযৌক্তিক। মাত্র ৮-১০ জন যাত্রী চলতে পারেন মাইক্রোবাসে। বড় বাসগুলোই যেখানে দূরত্ব বজায় রেখে যাত্রী পরিবহন করছে না, সেখানে মাইক্রোবাসগুলো ৩-৪ জন যাত্রী নিয়ে কি চলতে পারবে? আদৌ না। তারও স্বাস্থ্যবিধি না মেনে এবং অত্যধিক ভাড়ার বোঝা যাত্রীদের ওপর চাপাবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই অন্তত আরো দুই বছরের মধ্যে মাইক্রোবাসকে গণপরিবহন হিসেবে গণ্য করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নসিমন-করিমন চলা বন্ধ করার কৌশল হিসেবে মাইক্রোবাসকে গণপরিবহন হিসেবে চালু করা হাস্যকর। গ্রামীণ দরিদ্র কৃষক, নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য নসিমন-করিমন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে চলেছে। হ্যাঁ, তাদের মহাসড়কে নিষিদ্ধ করা যায় কিন্তু সড়কগুলোতে চালু থাকতে দেয়া, তাদের রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা যৌক্তিক। তবে যেগুলোর ব্রেক নেই বা ব্রেক দুর্বল তাদের কোথাও চলতে দেয়া অনুচিত। তবে মাইক্রোবাসের মূল্যহ্রাস সমর্থনযোগ্য। পারিবারিক ব্যবহারের জন্য মাইক্রোবাস খুবই উপযুক্ত। যা হোক, নিচুতলার বহু গরিব মানুষ যে নসিমন-করিমনের দ্বারা তাদের অন্ন সংস্থান করে চলেছেÑ সে বিষয়টি যেন আমরা ভুলে না যাই। বাজেটের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দিক হলোÑ বিশাল অঙ্কের ঘাটতি এবং তা মেটানোর জন্য বিদেশি সাহায্য ও ঋণের দ্বারস্থ হতে হবে। ফলে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ার প্রত্যাশা এক অর্থহীন গ্রুপে পরিণত হবে। যা করা প্রয়োজন, দেশের নানা ক্ষেত্র থেকে অধিকতর অর্থ আহরণ করে ওই ঘাটতি মেটানো, তা হলেই মাত্র ওই বিশাল অঙ্কের ঘাটতির যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যেন। খাতওয়ারি বরাদ্দের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ১১.৫ ভাগ, পরিবহন ও যোগাযোগ ২৫.৮ ভাগ, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ১৫.১ ভাগ, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১৯.৭৫ ভাগ, কৃষি-৫.৬ ভাগ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ ৩.০০ ভাগ এবং প্রতিরক্ষা ৫.৫ ভাগ, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ৪.৭ ভাগ এবং বিনোদন ও সংস্কৃতি ও ধর্ম ০.৮ ভাগ। এই খাতওয়ারি বরাদ্দের দিকে তাকালে স্পষ্টতই ধরা পড়ে কৃষি খাত মারাত্মকভাবে অবহেলিত, শিল্প খাত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেই, তবে বিদ্যমান। শিল্প কারখানার মালিকদের স্বার্থে কর-রেয়াতসহ নানা প্রণোদনা, ফলে বেকারদের সংখ্যাবৃদ্ধি প্রতিরোধ নেহায়েতই একটি স্বপ্নমাত্র। কর্মরত শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি এবং না পাওয়ার নিশ্চয়তা বিষয়ে বাজেটটি মৌল। ফলে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধি অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে সামাজিক নিরাপত্তার বরাদ্দ আপাতদৃষ্টিতে যথেষ্ট বাড়ানো হয়েছে বলে মনে হলেও তা প্রয়োজন মেটাতে আদৌ সক্ষম হবে না। এক্ষেত্রে বেকারদের নামের তালিকা নির্ভুলভাবে প্রণয়ন এবং তাদের জন্য কমপক্ষে ১০ হাজার টাকা করে বেকার ভাতা চালু করাটা জরুরি। সর্বাধিক প্রহসনমূলক বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে। প্রথমেই বলি, ধর্ম যেহেতু ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়, তাই সে বাবদে রাষ্ট্রের নিজ কাঁধে কোনো দায়িত্ব গ্রহণ অসঙ্গত। এ ব্যাপারে ১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধু প্রণীত মূল সংবিধান পথপ্রদর্শক হতে পারে। থাকল বিনোদন ও সংস্কৃতি। বরাদ্দ ০.৮ ভাগ। ফলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। আমাদের নৈতিক অধঃপতন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির যে সংকট তার পেছনে প্রধান কারণই হলো আমাদের সাংস্কৃতিক কমকাণ্ডে অবহেলা। বাংলাদেশকে যে সম্ভাবনাময় অবস্থায় ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছিলাম, আজ সেখান থেকে পিছিয়ে পড়ার পেছনে প্রধানতম কারণ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আমাদের মারাত্মক অধঃপতন। তাই সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ কমপক্ষে ৩.০০ ভাগের উন্নীত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কোনো যুদ্ধবাদী দেশ নয়। আন্তর্জাতিক কিংবা আঞ্চলিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কোনো শত্রু নেই। ফলে সামরিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধি যুক্তিহীন। বরং পুলিশ ও গোয়েন্দা এবং বর্ডার গার্ড প্রভৃতি বাবদে উপযুক্ত বরাদ্দ যৌক্তিক। শিক্ষা খাত একটি মারাত্মক সংকটে নিপতিত আজ প্রায় দেড় বছর ধরে করোনা মহামারির কারণে। এ থেকে উত্তরণের জন্য অনলাইন বা টিভি চ্যানেলে শিক্ষাদানের উদ্যোগ সফল হয়নি। তেমনই সফল হয়নি অনলাইন পরীক্ষা গ্রহণ। প্রায় শতভাগ পরীক্ষার্থী অনলাইনে বই খুলে বসে পরীক্ষা দেয় বলে শিক্ষার্থী মহল থেকেই শুনেছি। তাই দ্রুত শিক্ষার্থী ও শিক্ষিত-শিক্ষিকাদের শতভাগকে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দিয়ে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জুলাই ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি চালু করা উচিত। সে কারণে বিভিন্ন উৎস থেকে এবং তার জন্য বরাদ্দ আরো বাড়ানো প্রয়োজন। করোনা প্রতিরোধের প্রচেষ্টার ব্যাপারে আত্মতুষ্টির অবকাশ। ইউরোপ, আমেরিকা, ভারত প্রভৃতি দেশ ও অঞ্চল করোনার তৃতীয় ধাক্কার প্রবল আশঙ্কার খবর জানাচ্ছে। তাই বাংলাদেশে সে ধাক্কা লাগবে না এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। সর্বাধিক প্রয়োজন বিনামূল্যে শতভাগ মানুষের করোনা টেস্ট। দৈনিক ন্যূনতম ৫০ হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা এবং তার সুযোগ সব জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ছাড়ানো। তা করতে পারলে প্রতিদিনকার প্রকৃত আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা পাওয়া সম্ভব হবে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সংখ্যক করোনা টেস্টিং কিটস ও পিসিআর ল্যাব সর্বত্র প্রতিষ্ঠা করা, সব পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালে করোনা ওয়ার্ড, ডাক্তার, নার্স প্রভৃতির সঙ্গে অন্তত ১০-১২টি করে আইসিইউ বেড স্থাপন জরুরি। এগুলো করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কঠোরভাবে দুর্নীতিমুক্ত করা ও প্রয়োজন মতো অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। আমাদের ব্যক্তিগত উপার্জন চার শতাধিক ডলারে উন্নীত হওয়ার যে কথা প্রচার করা হয়, তাতে ব্যাপকভাবে স্তম্ভকের ফাঁকি। এই উপার্জন শতকরা ১০ জনের বেশি মানুষের নয়। যদি তা হতো আমরা ইতোমধ্যেই একটা উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারতাম। ওই গড় উপার্জন মানুষের জীবনে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলে না। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা বর্তমানে যা দেয়া হচ্ছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির নিরিখে তা তিনগুণ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বাজেটে সেভাবে অর্থ বরাদ্দ করার সুপারিশ করছি। সর্বোপরি উৎপাদন খাতে ব্যয় কার্যত আদৌ বৃদ্ধি করা হয়েছে কিনা স্পষ্ট হয়নি। বন্ধ কলকারখানা চালু করা, নতুন নতুন শিল্প কারখানা রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপন, কৃষির ব্যাপক উন্নতি ব্যতিরেকে দারিদ্র্য বিমোচন ও বেকারত্ব দূরীকরণ অসম্ভব। তাই বাজেটকে সেভাবে সংশোধন করা হোকÑ করা হোক জনমুখী। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App