×

ফিচার

আই ডু নট ডেয়ার এনিবডি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ জুন ২০২১, ১০:৪৭ এএম

পাকিস্তানিদের বৈষম্যের চিত্র, লীগ শাহীর জুলুম নির্যাতনের বীভৎসতা ভাসানী-মুজিবের অনলবর্ষী বক্তৃতায় বাংলায় মানস-চেতনায় জমানো মোহাচ্ছন্নতার মেঘ কেটে যেতে লাগল। স্বাধীকারের স্বপ্ন তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে।

পাকিস্তানি জেনারেলরা বলেছেন, মুজিবের কার্যকলাপে প্রমাণিত হয়েছে তিনি প্রথম থেকেই পাকিস্তান মেনে নেননি। শেখ মুজিবের চরিত্রের অদমনীয়তা, নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামী মানসিকতা, দৃঢ়তা ও সাহসিকতা তাকে পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টিতে নিয়োজিত করেছিল।

গণতান্ত্রিক যুবলীগ, মুসলিম ছাত্রলীগ এবং সর্বোপরি আওয়ামী মুসলিম লীগ, সংগঠনের কার্যধারার বিশ্লেষণে শাসকচক্র তাকেই অন্যতম দুর্দমনীয় শত্রু ও প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করতে ভুল করেনি। সে সময়ের গোয়েন্দা রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে তা প্রমাণিত হবে।

আর একজন মহান ‘বিদ্রোহী’ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৮ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ববঙ্গের ব্যবস্থাপক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। পূর্ববঙ্গ পরিষদে ১৯ মার্চ বাজেটের ওপর আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলামী করি? ন্যায়সঙ্গত অধিকারের জন্য চিরকাল লড়াই করেছি, আজও করব। আমরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পাট উৎপাদন করব, অথচ জুট ট্যাক্স, এমনকি রেলওয়ে ট্যাক্স, ইনকাম ট্যাক্স, সেলস ট্যাক্স নিয়ে যাবে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট। এইসব ট্যাক্সের শতকরা ৭৫ ভাগ প্রদেশের জন্য রেখে বাকি অংশ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টকে দেয়া হোক।’

‘কিন্তু আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, এই প্রদেশে জমিদারদের কাছে দুই কোটি টাকা সেস (কর) বাকি আছে। এক ময়মনসিংহ জেলায় ২৬ লাখ টাকা সেস বাকি। যে সমস্ত গরিব কৃষক কৃষিঋণ নিয়েছে এবং শোধ করতে পারছে না, মাননীয় অর্থসচিব সার্টিফিকেট দ্বারা তাদের বাড়িঘর নিলাম এবং জোতজমি ক্রোক করে ওই ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু প্রবল প্রতাপশালী জমিদারদের হাতে কড়া লাগিয়ে দুই কোটি টাকা বাকি সেস আদায়ের ব্যবস্থা করতে পারেননি। এই হাউসে অনেক মিনিস্টারের কাছেও লাখ লাখ টাকা সেস বাকি পড়ে আছে। যদি মরণাপন্ন কৃষকদের প্রতি এই ব্যবস্থা করা হয়, তা হলে মন্ত্রিমণ্ডলীর সোনার চেয়ার ধ্বংস হবে। কৃষকদের ওপর অত্যাচার করে মন্ত্রিত্ব করার অধিকার কারো নাই। আজ আর ব্রিটিশ শাসন নাই। আজাদ পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার। প্রত্যেক মানুষ চায় খাওয়া-পরা, রোগে ওষুধ, থাকার ঘর, চলাচলের রাস্তা ও লেখাপড়ার সুব্যবস্থা এবং এগুলো তাদের সঙ্গত দাবি।’

[caption id="attachment_284880" align="aligncenter" width="595"] যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম বইটির কভার ফটো[/caption]

১৯৪৮ সালে ১১ মার্চ ভাষা প্রশ্নে শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট সংগঠনের দায়িত্ব পালনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার বহিষ্কারে শাসক গ্রুপ নির্দ্বিধ ছিল।

অবস্থান ধর্মঘট চলাকালে ১৯৪৮ সনে ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৫০ সালে খাদ্যের দাবিতে ভুখা মিছিলের নেতৃত্ব দানের জন্য শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপরও পুনঃপুনঃ গণতান্ত্রিক আন্দোলন রচনায় শেখ মুজিব শাসকচক্রের কাছে একজন বড় মাপের ‘ট্রেইটর’ হিসেবেই চিহ্নিত হন।

ওই সনে তার সাংগঠনিক দক্ষতার ফলশ্রæতিতে জেলে থাকাকালীন অবস্থাতেই তাকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

জেল থেকে মুক্তি পেয়ে মওলানা ভাসানী-শেখ মুজিব বাংলার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির ওপর নগ্ন হামলা, জাতিসত্ত্বা বিনাশ ও নিপীড়ন এবং শোষণ-বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এ সবের কারণে ১৯৫২ সনে ১৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্বেই তিনি কারাগার থেকে ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য ছাত্র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও পরামর্শ দেন।

১৬ ফেব্রুয়ারি হতে অনশন শুরু করেন। রাষ্ট্র ভাষা ও রাজবন্দিদের মুক্তি, গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি ১২ দিন একটানা অনশন করেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তার বলিষ্ঠ সংগ্রামের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্বভার তার ওপর অর্পিত হয়। সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই তিনি সমগ্র পূর্ববঙ্গে অক্লান্তভাবে সংগঠন গড়ে তোলার সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্ত, জাতিসত্ত্বা সংস্কৃতি বিনাশের ষড়যন্ত্র, ভাষার ওপর নগ্ন হামলা, শোষণ-বৈষম্যের নিদারুণ চিত্র, লীগ শাহীর জুলুম নির্যাতনের বীভৎসতা ভাসানী-মুজিবের অনলবর্ষী বক্তৃতায় বাংলায় মানস-চেতনায় জমানো মোহাচ্ছন্নতার মেঘ কেটে যেতে লাগল। শোষণ বঞ্চনামুক্ত, ন্যায়সঙ্গত বৈষম্যহীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার লড়াই স্বাধীকারের স্বপ্ন আকাক্সক্ষার নব উজ্জীবিত চেতনার প্রত্যয় তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে।

জনমত মুসলিম লীগের জুলুম ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে লাগল। ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত পটভ‚মিকা এবং দুটি বেসিক প্রিন্সিপ্যাল রিপোর্টে বা বি-পি-সি বাঙালির কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল যে, পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি কলোনিতে পরিণত করবার গভীর এক চক্রান্ত চলছে। যে চক্রান্তের অর্থই পূর্ববঙ্গের গণতান্ত্রিক সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কেন্দ্রীয় স্বার্থের যুপকাষ্ঠে বলিদান, বাঙালির গণতান্ত্রিক অধিকারকে খর্ব করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে চিরদাসত্বে বন্দি হওয়া।

১৯৪৭ থেকে সাত বছর। প্রত্যক্ষ নির্বাচনের দাবিতে ভাসানী-মুজিব চারণের বেশে পূর্ববঙ্গ চষে বেড়ান। আন্দোলন এ সংগ্রামের চাপে নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৫২ সালের ২২ ডিসেম্বর পাকিস্তান গণপরিষদ মূলনীতি কমিটির দ্বিতীয় রিপোর্ট পেশ করেন খাজা নাজিমুদ্দিন। এই রিপোর্টে সমমর্যাদার ভিত্তিতে ফেডারেল আইন সভার প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাবনায় ৪০০ সদস্যবিশিষ্ট ফেডারেল পার্লামেন্ট এবং ১২০ সদস্যবিশিষ্ট প্রাদেশিক পরিষদ গঠনের কথা বলা হয়। এই রিপোর্টে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যার আধিক্যকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি এবং ভাষার প্রশ্নটি অমীমাংসিত থেকে যায়। ফলে পূর্ব বাংলা থেকে এই রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়। এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের মুসলিম লীগ মহল এই অভিমত ব্যক্ত করে যে, দ্বিতীয় রিপোর্ট পূর্ব বাংলাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, এর অধিক ছাড় দেয়া যায় না। বিশেষত ফেডারেল পার্লামেন্টে পূর্ব বাংলার সমঅধিকারের বিষয়টি মুসলিম লীগের পাঞ্জাবী চক্র কোনোক্রমেই মেনে নিতে পারেনি। পাকিস্তান মন্ত্রিসভায় চৌধুরী মোহাম্মদ আলী এবং মোস্তাক আহমদ গুরমানী প্রমুখরা প্রকাশ্যে এই রিপোর্টের বিরোধিতা করেন। এই সময় পাকিস্তানের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য পাঞ্জাবী চক্র খুবই তৎপর হয়ে ওঠে।

প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তান গণপরিষদ শাসনতন্ত্র প্রণয়কল্পে তৃতীয় মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট দাখিল করা হয়। এতে প্রস্তাব করা হয় যে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইন সভার উচ্চ পরিষদে মোট সদস্য সংখ্যা হবে ৫০ জন। পাকিস্তানের প্রত্যেকটি প্রদেশ থেকে ১০ জন করে প্রতিনিধি নিয়ে এই উচ্চ পরিষদ গঠিত হবে। ‘হাউস অব পিপলস’ গঠিত হবে ৩০০ জন সদস্য নিয়ে। এদের মধ্যে পূর্ব বাংলায় হবে ১৬৫ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হবে ১৩৫ জন। তবে যৌথ অধিবেশনে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান এই উভয় অঞ্চল থেকে সমসংখ্যক প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করবেন। এই রিপোর্টে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব করা হয়।

অবশ্য কেন্দ্রের হাতে প্রভ‚ত ক্ষমতা রক্ষিত হয়। মূলনীতি কমিটির তৃতীয় রিপোর্টের বিরুদ্ধে পাকিস্তানে বিশেষত পাঞ্জাবে আন্দোলন শুরু হয়। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর সেনাপতি আইয়ুব খানের সহায়তায় গণরিষদ ভেঙে দেন এবং পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। এখানেই পাকিস্তানের জন্য একটি শাসনতন্ত্র রচনার পরিসমাপ্তি ঘটে।

আগামীকাল প্রকাশিত হবে ‘ আই ডু নট ডেয়ার এনিবডি’ (২য় পর্ব) ‘যেভাবে স্বাধীনতা পেলাম’- বইটি পাওয়া যাচ্ছে ভোরের কাগজ প্রকাশনে (ভোরের কাগজ কার্যালয়, ৭০ শহীদ সেলিনা পারভীন সড়ক, মালিবাগ, ঢাকা)। এছাড়া সংগ্রহ করা যাবে bhorerkagojprokashan.com থেকেও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App