×

জাতীয়

টিকা নিয়ে গোপন চুক্তি কেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২১, ০৮:৪৯ এএম

বৈশ্বিক মহামারি করোনার ভ্যাকসিন বা টিকা কেনায় স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সব চুক্তিতে কঠোর গোপনীয়তা রাখছে চীন। বাংলাদেশের সঙ্গেও এই গোপনীয়তা প্রত্যাশা করেছিল দেশটি। কিন্তু বাংলাদেশ সেটি রক্ষা করেনি। এ নিয়ে দুদেশের সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। টিকা প্রাপ্তিতেও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। আর এতেই প্রশ্ন উঠেছে, টিকা বেচাকেনায় গোপনীয়তার শর্ত কেন? আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অংশ হিসেবে দ্বিপক্ষীয় এই চুক্তিতে গোপনীয়তাকে রহস্যজনক বলছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশে কেনাকাটার বিষয়ে জনগণকে অবহিত করার বিধান রয়েছে। তবে চীনের নীতিতে এর ভিন্নতা রয়েছে। টিকা বিক্রিকে তারা তাদের সাম্প্রতিক ব্যবসায় বড় বিনিয়োগ মনে করছে। নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তারা একই টিকা একেক দেশে একেক দামে বিক্রি করছে। দাম প্রকাশ করায় আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়েছে চীন। আর কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, গোপন চুক্তিতে রাষ্ট্র লাভবান হলে গোপনীয়তা মেনে চলা উচিত।

এদিকে, টিকার দাম বলে দেয়া নিয়ে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন হওয়ার অভিযোগের পর বাংলাদেশ চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেও গতকাল শনিবার বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের উপরাষ্ট্রদূত হুয়ালং ইয়ান নিজের ফেসবুকে দেয়া পোস্টে জানান, চীন সরকার তো দূরের কথা, সিনোফার্মের সঙ্গেই এখনো টিকা কেনার বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি বাংলাদেশের। এর ফলে বিষয়টি নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়েছে। চীনের টিকা প্রাপ্তি নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।

অনেকেই বলেছেন, চুক্তির আগেই চীন ক্ষুব্ধ হলো কেন? কেন গোপনীয়তা ভঙ্গের দায়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে ওএসডি হতে হলো? কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভ্যাকসিন কূটনীতির আড়ালে চীন অন্যকোনো খেলা সাজাচ্ছে। যার জেরে চীন বাংলাদেশকে আরো কাছে পেতে চাইছে। কাজেই বাংলাদেশকে সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে।

তাদের মতে, চীনা টিকা বিভিন্ন দেশে ১৫-১৭ ডলারে রপ্তানি হচ্ছিল। বাংলাদেশকে ভারতীয় বলয় থেকে বের করে আনাসহ ভ‚রাজনৈতিক বিবেচনায় তারা গোপনে ১০ ডলারে বিক্রির চুক্তি করে। কিন্তু বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা মিডিয়াকে বলে দিলে বেঁকে বসে চীন। কারণ, তাদের টিকা অন্য ক্রেতারাও ১০ ডলারে চাইতে শুরু করে। সবমিলিয়ে চীন এখানে টিকার ব্যবসা করছে। একেক দেশকে একেক দামে টিকা দিচ্ছে। এখন এটা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কের মুখে পড়েছে চীন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গোপনীয়তা না মানায় গত ১ জুন বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহিদা আকতারকে ওএসডি করা হয়। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশ চীন থেকে ১০ ডলার দরে দেড় কোটি ডোজ টিকা কিনছে। এরপরই শ্রীলঙ্কা চীন সরকারের কাছে জানতে চায়, সিনোফার্মের টিকা কলম্বো ১৫ ডলারে কিনছে, আর ঢাকা কিভাবে ১০ ডলারে পাচ্ছে? এমন চিঠি পেয়েই চীন ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং তারা জানায়, বাংলাদেশ টিকা কেনাসংক্রান্ত গোপনীয়তা রাখেনি।এরপর বাংলাদেশ চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশটির রাষ্ট্রদূত ও মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।

এ বিষয়ে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, চীনের সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে এবং তারা টিকা বিক্রি করতে রাজি আছে। চীন আমাদের বন্ধু। সেই বিশেষ বন্ধুত্বের সুবাদেই আমরা তাদের কাছ থেকে এই দরে টিকা পাচ্ছি। এ বিষয়ে চীন কোনো লিখিত আশ্বাস দিয়েছে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনো দেয়নি। তবে দেবে। গোপনীয়তা রাখা না রাখায় তারা দুঃখ পেয়েছে। এখন থেকে এ বিষয়ে সতর্ক থেকে কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

এদিকে, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের উপরাষ্ট্রদূত হুয়ালং ইয়ান গতকাল নিজের ফেসবুকে জানান, গণমাধ্যমের তথ্য যদি সঠিক হয়, তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কেন শুধু মিথ্যা তথ্য দেয়া হচ্ছে! এটা বলা বাহুল্য প্রথমত, এখন পর্যন্ত সিনোফার্মের সঙ্গে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো চুক্তি হয়নি। দ্বিতীয়ত, এটি চীনা সরকার নয়, সিনোফার্ম এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি ব্যবসায়িক চুক্তি। আর আমরা আশা করি, আমাদের বাংলাদেশি ভাইবোনেরা আগের (নির্ধারিত) তারিখে প্রয়োজনীয় টিকা পাবেন।

প্রসঙ্গত, করোনা সংকট মোকাবিলায় চীনের প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের সঙ্গে টিকা আনার আলোচনা শুরু হয় বেশ কয়েক মাস আগে। বাংলাদেশ-চীনের টিকা ক‚টনীতির প্রক্রিয়ার মাঝেই বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত লি জিমিং দাবি করেন, দ্রæত সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় টিকা কিনতে দেরি হয়েছে বাংলাদেশের।

এরপর টিকা কেনার প্রক্রিয়ায় আলোচনায় আসে অপ্রকাশযোগ্য চুক্তি। যার জন্য চীনা ভাষায় লেখার জায়গায় সই করে ফেলা এক ধরনের চাহিদাপত্র দিয়ে পরে তা কমানোসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রশাসনিক নানা দুর্বলতার কথাও উঠে আসে।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক শমসের মবিন চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, গোপন থেকে লাভবান হলে টিকা ও চুক্তি নিয়ে চুপচাপ থাকলেই ভালো হতো। গোপন থাকার চুক্তিতে সই করব আর কথা রাখব না। এটা হতে পারে না। তার মতে, চীন হয়ত কম টাকায় টিকা দিয়ে বাংলাদেশকে আরো কাছে টানতে চাইছে। কিন্তু সব বলে দেয়ায় এখন চীন ক‚টনৈতিকভাবে অসুবিধায় পড়েছে। আমার ধারণা, এখানে ভ্যাকসিন ডিপ্লোমেসিসহ অন্য কিছু বিষয় কাজ করছে।

কূটনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ জমির বলেন, সবকিছুর গুরুত্ব ও গোপনীয়তা রক্ষা করে চলা উচিত। বাংলাদেশ ১০ ডলারে টিকা পাচ্ছে। এটি দেশের স্বার্থে বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে টিকার দাম বলে দেয়া হয়েছে। এখন দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক হোঁচট খেলে এর দায় কে নেবে? তিনি বলেন, কোয়াড নিয়ে সমস্যা হয়েছে। এখন আবার টিকা নিয়ে। এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকছে না।

টিকার বিষয়ে পুরো ব্যবস্থাপনাকেই দুর্বল বলে চিহ্নিত করেছেন আরেক ক‚টনৈতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবীর। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, চীনারা জানে, কীভাবে কী করতে হয়। তার মতে, করোনার সময় টিকা বেচতে বেশি দাম চাওয়া যেমন ঠিক হয়নি তেমনি আমাদের গোপনীয়তা ফাঁস করাও উচিত হয়নি। পুরোটাই দায়িত্বহীনতা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুঃখ প্রকাশে সবকিছু ঠিক হয় না। শুরু থেকেই যদি পরিপক্বতা থাকত, তাহলে আজ এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, দামের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় আমরা দুঃখপ্রকাশ করে চীনকে চিঠি দিয়েছি। তাদের জানিয়েছি, ইচ্ছে করে নয়, ভুলবশত এটা হয়েছে। তারা এখনো সেই চিঠির জবাব দেয়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, চীনের সঙ্গে তাদের কথা হয়েছে এবং চীন টিকা দেবে।

জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, সবকিছুতেই জনগণের জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু চীনে এই সংস্কৃতি নেই। তারা কাউকে কিছু জানাতে রাজি নয়। কিন্তু আমাদের এখানে এই সংস্কৃতি বিদ্যমান। এজন্য টিকার দাম বলা হয়েছিল। কারণ ১০ কিংবা ২০ ডলারেই টিকা কিনুন না কেন, টাকাটা যাবে জনগণের। আর এ বিষয়টি চীনকে বোঝাতে হবে। এতেও তারা রাজি না হলে অন্য উৎস থেকে টিকা আনতে হবে। জনগণকে ধোঁকা দিয়ে কোনো কাজ করা যাবে না।

অনেকেই বলেছেন, দাম প্রকাশ করে দেয়ায় সিনোফার্মের টিকা নিয়ে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। বাণিজ্যিক স্বার্থে চীন দাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়েছিল। কারণ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দামে তারা টিকা সরবরাহ করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় সিনোফার্ম ১০ ডলার মূল্যে টিকা সরবরাহে সম্মত হয়েছিল। বাংলাদেশের মিডিয়ায় এই খবর প্রকাশের পর শ্রীলঙ্কা প্রথম আপত্তি জানায়। বলে বাংলাদেশকে ১০ ডলারে টিকা দেয়া হলে শ্রীলঙ্কার কাছে ১৫ ডলার চাওয়া হচ্ছে কেন? বিষয়টি এখানে শেষ হয়ে যায়নি।

চীন বাংলাদেশের কাছে এক কূটনৈতিকপত্রে জানতে চেয়েছে- কেন দাম প্রকাশ করা হলো। বলা হয়েছিল দাম প্রকাশ করা হলে তারা বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চীন বলেছে, তাদের আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। অনেক দেশই তাদের কাছে আপত্তি জানিয়েছে। এই পত্র যখন এলো তখন বাংলাদেশ দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠিয়েছে। বিব্রতকর এই পরিস্থিতি সামাল দিতে কূটনৈতিকভাবে চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ খবর চীন এখনো সায় দেয়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App