×

জাতীয়

বাজেটে সর্বজনীন খাতে বরাদ্দ সংকোচন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২১, ০২:০১ পিএম

বাজেটে সর্বজনীন খাতে বরাদ্দ সংকোচন

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর

বাজেট পেশ করা হয়েছে এক বিশেষ সময়ে। চলমান অতিমারি থেকে উত্তরণে সর্বজনীন খাত- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, স্বাস্থ্য, শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল। একই সময়ে মুজিব শতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। এবার বাজেটের মাধ্যমে স্বাধীনতার মূল তিন স্তম্ভ- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ ছিল। অর্থমন্ত্রীও আশাজাগানিয়া বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি প্রস্তাবিত বাজেটের শিরোনামও দিয়েছেন, ‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’। দেখা যাক, বাজেটে অতিমারি মোকাবিলা এবং স্বাধীনতার মূল স্তম্ভের আলোকে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এ অতিমারি জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির যতটা ক্ষতি করেছে; তা ইতিহাসে অতুলনীয়। প্রথম ধাক্কায় দিন আনে দিন খায় তথা একদিন আয় না করলে সংসার চালানো দায়- এমন মানুষ তাদের যৎকিঞ্চিত সঞ্চয় ভেঙে অথবা আত্মীয়স্বজনের সহায়তা নিয়ে অথবা জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে সংসার চালিয়েছিল। এখন তো সঞ্চয় নেই। এখন কোথায় ধার পাবে। আগের ঋণই কীভাবে শোধ হবে? দারিদ্র্য বেড়ে দারিদ্র্যের হার তিন দশক আগের পর্যায়ে চলে গেছে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত খরচ বাড়ছেই। শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। কমছে উৎপাদনশীলতা। শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের একটি দীর্ঘ সময় জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তসহ অধিকাংশ মানুষ অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তায় জীবনযাপন করছে।

সব ক্ষেত্রের অর্জন পিছিয়ে দিয়েছে। ১৯৯২ সালের পর এই প্রথম নতুন করে দারিদ্র্য বেড়েছে। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আগের বছরের চেয়ে বরাদ্দ ১৩ শতাংশ বেড়েছে। তবে মাথাপিছু ভাতার পরিমাণ বাড়েনি। উপরন্তু বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগ অংশ সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ইত্যাদি প্রদানে যাবে। বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রয়োজনীয় শর্তপূরণ না করেও অনেকে পাচ্ছে। জনসংখ্যার সঠিক তথ্যভিত্তিক তালিকা না থাকায় অনেকে যোগ্য হয়েও কর্মসূচি থেকে বাদ পড়ছে। একই কারণে গত বছর সামাজিক সুরক্ষা খাতে ৫০ লাখ পরিবারকে আড়াই হাজার করে টাকা দেয়ার পরিকল্পনা করা হলেও ৩৫ লাখ পরিবারের বেশি তা পায়নি। নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়েছে। তাদের কোনো তালিকা নেই। বরাদ্দকৃত অর্থও নতুন যোগ হওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় অনেক কম।

কয়েক দিন ধরে করোনায় সংক্রমণ হার ও মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু এখনো সবার জন্য টিকা পাওয়া অনিশ্চিত। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, ‘মোট ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার আওতায় আনার জন্য ভাগ ভাগ করে পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগণকে টিকা দেয়া হবে এবং প্রতি মাসে ২৫ লাখ করে টিকা দেয়া হবে।’ এভাবে দিতে গেলে ৪ বছর লাগবে। ৪ বছর অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে কাটাতে হবে!

প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ডাক্তার আছে ৫ দশমিক ২৬ জন। দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। স্বাস্থ্য খাতের মাত্র ২৬ দশমিক ১৩ শতাংশ খরচ আসে সরকারি ব্যয় থেকে। বাকি টাকা জনগণকে পকেট থেকে দিতে হয়। বাজেটের অংশ এবং জিডিপির অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে গত বারের চেয়ে বরাদ্দ কমেছে। গত বাজেটে জিডিপির অংশ হিসেবে বরাদ্দ ছিল ১ দশমিক ০২ শতাংশ। এবার তা কমে জিডিপির দশমিক ৯৫ শতাংশ হয়েছে। গত অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের অংশ হিসেবে বরাদ্দ ছিল ৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এবার তা কমে হয়েছে ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছাড়া জিডিপির অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে বাংলাদেশ সবার চেয়ে পিছিয়ে। স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন এবং সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করা না গেলে অর্থনীতির সংকোচন থামানো যাবে না।

অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্ররা বসে আছে। টিউশন বা অন্যান্য কাজের মাধ্যমে তারা যে আয় করত তারও সুযোগ নেই। ছাত্ররা এখন ঋণগ্রস্ত। অনেকেই হতাশায় আত্মঘাতী হয়ে উঠছে। ইউনিসেফের মতে, ৩ কোটি ৬৮ লাখ শিক্ষার্থী সব অনলাইন ক্লাস ও নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ সামান্য বাড়লেও বাজেটের অংশ এবং জিডিপির অংশ হিসেবে গতবারের চেয়ে বরাদ্দ কমেছে। জিডিপি ও বাজেটের অংশ হিসেবে গেল অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল যথাক্রমে ২ দশমিক ২৪ এবং ১২ দশমিক ২৮ শতাংশ। কিন্তু তা এবার নেমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ।

জনপ্রশাসন এখনো রাজস্ব বাজেটের সবচেয়ে বড় ব্যয় খাত। বাজেটের ৬০ দশমিক ৭২ শতাংশই ব্যয় হবে পরিচালন খাতে। পরিচালন ব্যয়ের এক-চতুর্থাংশের বেশি ব্যয় হবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন পরিশোধে। অন্যদিকে দুই বছরে করপোরেট কর কমেছে ৫ শতাংশ। এতে ব্যবসায়ীরা ছাড় পাবেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য করে কোনো ছাড় নেই।

কর্মসংস্থান ধরে রাখতে বাজেটে প্রত্যক্ষ তেমন উল্লেখ করার মতো ব্যবস্থা দেখা যায়নি। অধিকাংশ মানুষের কর্মজোগানদারি কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (সিএমএসএমই) খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরাসরি নগদ সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়নি। এ খাতে পূর্বে ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ বাস্তবায়নের ধীর অগ্রগতির কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা বাজেটে নেই। রপ্তানি পণ্য ও বাজারের বৈচিত্র্যকরণ, অঞ্চলভিত্তিক এবং খাতভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন কর ব্যবস্থা নিলে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর করা যেত। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হতো।

অনেক পুরনো তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। এক তথ্যের সঙ্গে অন্য তথ্যের সামঞ্জস্যতা পাওয়া যায় না। বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বাজেট সম্পর্কিত সব তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তি সহজ করা প্রয়োজন এবং তাতে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সঠিক তথ্য-উপাত্ত থাকলেই সঠিক নীতি-কৌশল প্রণয়ন করা যায়।

বাজেট ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্রায়ন দরকার। সংসদের কার্যবিধি অনুযায়ী সংসদীয় কমিটি কর্তৃক অর্থবিল যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই। এমনকি রাষ্ট্রপতির সুপারিশ ব্যতীত অর্থবিল উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে। উত্থাপিত বিলে কোনো নতুন প্রস্তাবনার সুযোগ নেই। সংসদ বাজেট পুরো গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে কিন্তু পরিবর্তন করতে পারে না। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা দলের বাইরে ভোট দেন না। বিরোধিতার এবং কার্যকর তর্কবিতর্ক ও পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত বিধায় বাজেটে প্রতিবারই স্বজনতোষণ, সম্পদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক কেন্দ্রীভবন প্রাধান্য পায়। অতিমারি জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতির যে অভূতপূর্ব ক্ষতি করেছে বাজেটে তা থেকে উত্তরণে পর্যাপ্ত রূপরেখা অনুপস্থিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App