×

জাতীয়

পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতায় কিশোর অপরাধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২১, ০৮:৪৮ এএম

পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতায় কিশোর অপরাধ

কিশোর অপরাধ। প্রতীকী ছবি

মাত্র ২০০ টাকার জন্য এক কিশোর খুন করেছে আরেক কিশোরকে। মাদক কিনতে দেয়া ২০০ টাকা ফেরত না পাওয়ায় ছুরি দিয়ে গলা কেটে খুন করা হয় সালাহউদ্দিন নামক ইজিবাইক চালক কিশোরকে। গত ১১ এপ্রিল সাতক্ষীরার এডিশনাল চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জিয়ারুল ইসলামের কাছে হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেয় অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৪ বছর বয়সি কিশোর। জবানবন্দি নেয়ার পর তাকে যশোরের পোলারহাট সরকারি শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানো হয়েছে।

গত ১ মে রাত ৯টায় নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীতে ২০ বছর বয়সি জাকির হোসেন সাগরকে মোবাইল ফোনে বাড়ির বাইরে ডেকে নিয়ে স্থানীয় বাহরকোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে নৃশংসভাবে কুুপিয়ে আহত করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জে কিশোর গ্যাংয়ের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষে নিহত হয় কে এল জুবিলি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র আরিফ হোসেন অনন্ত। ওই দিনই (২৯ মার্চ) গভীর রাত থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত ওয়ারি, গেন্ডারিয়া ও রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে অনন্ত হত্যায় তিন কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, যাদের বয়স ১৩ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।

যে বয়সে বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, মাঠে খেলার কথা, সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতিভা বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার কথা- ওই বয়সে ছুরি-চাকু, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। চুরি, ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ, মাদক সেবন, যৌন হয়রানিসহ লোমহর্ষক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে কিশোররা। গ্যাং কালচারে সম্পৃক্ত হয়ে বেপরোয়া কর্মকাণ্ড করছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজ পরিবর্তনের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন চর্চার বিষয়টি ভেঙে পড়েছে। ফলে সমাজে একটা শূন্য অবস্থা তৈরি হওয়ায় শিশু-কিশোররা নেতিবাচক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, পুঁজিবাদী সমাজ, সামাজিক অসমতা, বৈষম্য, সাংস্কৃতিক শূন্যতা দায়ী। শিশুশ্রম, বিশ্বায়ন, পর্নোগ্রাফি, ড্রাগের কারণে ধনী-দরিদ্র সব পরিবারের শিশুরাই অপরাধের পথে পা বাড়াচ্ছে। নেতিবাচক দিকেই উদ্ধুদ্ধ হচ্ছে। পারিবারিক নিয়ন্ত্রণের অভাব, পারিবারিক ভাঙনের কারণে কখনো শিশুরা নিজেই অপরাধে জড়িত হচ্ছে; আবার কখনো তাদের চুরি, ছিনতাই, মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রযুক্তি একটি বড় কারণ। ফেসবুক, টিকটক শিশুদের বিপথগামী করছে। অন্যদিকে শিশুদের অপরাধমূলক আচরণ সংশোধনের সুযোগ খুবই কম। সংশোধনাগার কম। যে চারটি রয়েছে সেখানে সংশোধনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থা উত্তরণে পথশিশুদের মূলস্রোতে আনতে হবে। সামাজিকভাবে তাদের অ্যাড্রেস করা, রাষ্ট্রীয়ভাবে সাপোর্ট সিস্টেম বাড়ানো, শিশু উন্নয়ন প্রয়োজন।

বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, ১৮ বছর বা এর কম বয়সি শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশোধিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য তাদের উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্য মতে, ওই সব কেন্দ্রে থাকা কিশোরদের ২০ শতাংশ হত্যা এবং ২৪ শতাংশ নারী ও শিশু নির্যাতন মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সের কিশোররাই বেশি অপরাধে জড়াচ্ছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে শিশু-কিশোরের সংখ্যা ৪ কোটি। এর মধ্যে ১৩ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত। এছাড়া সাড়ে ৯ লাখ দরিদ্র, প্রান্তিক ও দরিদ্র। কখনো জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে আবার কখনো কখনো এরা অন্যদের টার্গেট হয়। তাদের দিয়ে অপরাধ করানো হয়। দরিদ্রতা, পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব, নজরদারির অভাব, নৈতিক অবক্ষয় আরেকটি কারণ। প্রযুক্তিও একটি কারণ। বিভিন্ন ধরনের ভিডিও দেখে অপরাধে উদ্ধুদ্ধ হয়।

সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, আধুনিক সমাজে পরিবার ভেঙে ছোট পরিবার গঠন এবং জীবনযাত্রা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়াটাও শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ। এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। যুব ১৮ থেকে ৩৫। আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বসে আগে শিশু-কিশোরদের সংজ্ঞা ঠিক করা উচিত। সুযোগ পেলেই মানুষ খারাপ কাজে আগ্রহী হয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- কেউই সঠিক দায়িত্ব পালন করছে না। পরিবারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বন্ধুদের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ বাড়ছে। অন্যদিকে প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের সমন্বয় ঘটছে না। শিশুরা পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রযুক্তির নেতিবাচক চর্চা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজ ও রাষ্ট্রের অবকাঠামোর সঙ্গতি প্রয়োজন। বুদ্ধিভিত্তিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা, খেলাধুলা, সুস্থ বিনোদন, সুস্থ সংস্কৃতির উন্নয়ন, পারিবারিকভাবে নজরদারি বাড়ানো, মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষায় সুশিক্ষিত করা। তবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এককভাবে কিশোর অপরাধ নির্মূল সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ।

কিশোর অপরাধ ও উন্নয়নে কেন্দ্র নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শিল্পী রাণী দে। গ্যাং কালচারে কিশোরদের জড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, পুঁজিবাদী সমাজ, বিশ্বায়ন গ্যাং কালচারের একটি কারণ। শিশু-কিশোররা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক এমনকি সাইবার অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। এজন্য পরিবার ও রাষ্ট্র দায়ী। সুশিক্ষা পাচ্ছে না। পরিবারের নিয়ন্ত্রণ নেই। বিনোদনের অভাব পূরণ হচ্ছে না। গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় একটা পরিচিত পাওয়ার আশায়। অন্যদিকে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় অর্থ ও শক্তির বিনিময়ে কৌশলে কিশোরদের যুক্ত করছে।

শিশু-কিশোররা অপরাধের সঙ্গে জড়িত না অপরাধের শিকার এটি চিহ্নিত করা প্রয়োজন। তারা আইনবিরোধী কাজের সঙ্গে জড়িত। তারা অপরাধীর ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হচ্ছে। যেখানে উন্নয়নের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। তাদের হ্যান্ডকাফ পড়ানো হচ্ছে, পুলিশ ভ্যানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, যা তাদের ওপর নেতিবাচক মনস্তাত্তিক প্রভাব ফেলছে। আমরা শিশুদের চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। তাদের গুরুত্ব দিচ্ছি না। তখন অপরাধীদের সংস্পর্শে এসে বিপথগামী হয়। সাংস্কৃতিক শূন্যতা দেখা দিয়েছে। খেলার জায়গা নেই। পারিবারিক ভাঙন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র শিশুদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। পথশিশুদের একটি বিরাট অংশ বিপথগামী। তারা মাদকের সঙ্গে জড়িত। এজন্য চুরি, ছিনতাই করছে। শিশুদের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App