×

জাতীয়

ডেল্টার সামাজিক সংক্রমণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২১, ০৮:২৭ এএম

সংক্রমণ বেশি চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও খুলনায়; ছড়িয়েছে ঢাকায়ও

গত বছরের অক্টোবরে কোভিড-১৯ এর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টটি (ভারতীয় ধরন) প্রথম শনাক্ত হয়। তবে বাংলাদেশে তা প্রথম শনাক্ত হয় চলতি বছরের ৮ মে। ওই দিন ভারত থেকে আসা দুজনের শরীরে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয় বলে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ২৮ দিনের মধ্যে এই ধরনের সামাজিক সংক্রমণ ঘটেছে। করোনার উচ্চ সংক্রমিত এলাকাসমূহে আক্রান্তদের ইনভেস্টিগেশন (রোগসংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা), কন্ট্রাক ট্রেসিং (আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা) এবং সন্দেহজনক রোগীদের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এমন তথ্য জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রতিষ্ঠানটি এই তথ্য প্রকাশ করে।

রোগতত্ত্ববিদরা জানান, উৎস জানা না গেলে তাকে সামাজিক সংক্রমণ বলে বিবেচনা করা হয়। আর সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। মূলত করোনা ভাইরাসের সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট দেশের নাম না জড়াতেই এমন উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি। সংস্থার এক বিবৃতিতে বলা হয়, এখন থেকে করোনার ভ্যারিয়েন্টগুলোর নামকরণ হবে গ্রিক বর্ণ দিয়ে। যুক্তরাজ্য ভ্যারিয়েন্টের নাম আলফা, দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্যারিয়েন্টের নাম বিটা ও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ হয় ডেল্টা। গত ১৬ মের পর আইইডিসিআর দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তসংক্রান্ত তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই আইইডিসিআর এবং ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স এন্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইডিএসএইচআই) করোনার ৫০টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছে। পরীক্ষাকৃত নমুনার ৪০টির মধ্যে অর্থাৎ ৮০ শতাংশে ভারতীয় ধরন পাওয়া গেছে। জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য যেসব এলাকা থেকে নমুনা নেয়া হয়েছে সেগুলো হলো- ঢাকা, গোপালগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং খুলনা। এর মধ্যে ভারতীয় ধরন সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, গোপালগঞ্জ ও খুলনায়।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্তদের মধ্যে ৮ জনের ভারতে ভ্রমণের ইতিহাস আছে। ১৮ জনের বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসার ইতিহাস আছে। অন্যদিকে ১৪ জন অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ রোগীর বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণের অথবা বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার ইতিহাস পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে।

ডেল্ট ভ্যারিয়েন্টকে ‘সুপার স্প্রেডার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা গবেষণায় দেখা গেছে এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত একজন ব্যক্তি ৪০০ জনকে সংক্রমিত করতে পারে। আর যে কোনো বয়সি মানুষই এতে সংক্রমিত হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ভ্যারিয়েন্টকে ‘উদ্বেগের ভ্যারিয়েন্ট’ বলে অভিহিত করেছে।

পরীক্ষাকৃত ৮টিতে (১৬ শতাংশ) নমুনায় কোভিড-১৯ এর বিটা ভ্যারিয়েন্ট (দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন) শনাক্ত হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে সংগৃহীত ১৬টি নমুনার ১৫টিতে, গোপালগঞ্জ জেলা থেকে সংগৃহীত ৭টি নমুনার সব কয়েকটিতে, খুলনা শহর থেকে সংগৃহীত ৩টি নমুনার সবে, ঢাকা শহরের ৪টির মধ্যে ২টিতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা থেকে ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায় আসা ৭ জনের নমুনায় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এছাড়া ভারত থেকে আসা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্ত বিভিন্ন জেলার অন্য ৩ বাসিন্দা চুয়াডাঙ্গা ও খুলনায় চিকিৎসাধীন আছেন। শনাক্তকৃত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রোগীদের মধ্যে বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, পরীক্ষিত নমুনাগুলোর মধ্যে ৩ জনের (৭ শতাংশ) বয়স অনূর্ধ্ব ১০ বছর। ৭ জনের (১৮ শতাংশ) বয়স ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে, ১০ জনের (২৫ শতাংশ) বয়স ২১ থেকে ৩০ বছর বয়স, ৮ জনের (২০ শতাংশ) বয়স ৩১ থেকে ৪০ বছর, ৮ জনের (২০ শতাংশ) বয়স ৪১ থেকে ৫০ বছর, ৪ জনের (১০ শতাংশ) বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। এদের মধ্যে ২৪ জন (৬০ শতাংশ) রোগী পুরুষ।

এর আগে ৩১ মে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম জানিয়েছিলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৭ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের ভারতীয় ধরন পাওয়া গেছে, যারা কখনো সেখানে যাননি। অর্থাৎ দেশে ভারতীয় অতি সংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ শুরু হয়েছে।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরিন বলেন, করোনার ভ্যারিয়েন্ট (ধরন) নতুন কোনো বিষয় নয়। করোনার ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা। করোনার সংক্রমণ যত বাড়বে করোনা ভাইরাস তার ধরন পরিবর্তন করে কমিউনিটিতে এর বিস্তার ঘটাতেই থাকবে। এই সংক্রমণ বন্ধ করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের। সংক্রমণ কমানোর জন্য লোকজনকে স্বাস্থ্য নির্দেশিকা অনুসরণ করতে হবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির এক সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, দুর্বলতা ছিল বলেই করোনার সংক্রমণের ‘চেইন’ সরকার ভাঙতে পারেনি। কন্ট্রাক ট্রেসিং ও নমুনা পরীক্ষা করে আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে পারেনি। সবচেয়ে বড় হলো সরকার জনগণকে এসব কাজে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। তাই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখন তো ঝুঁকি আরো বেড়ে গেল।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গঠিত জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ভারতীয় ধরনের সামাজিক সংক্রমণ হওয়া মানে বিষয়টি খুবই উদ্বেগের। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এর সংক্রমণ বেশি ছড়িয়েছে। অথচ এখনো ওই অঞ্চল থেকে সারাদেশে আমবাহী ট্রাক যাচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। দেশের কয়েকটি জেলায় ভয়ংকর এই ভ্যারিয়েন্টটি ছড়িয়েছে। ওই সব জেলাতে কঠোর লকডাউন দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। করোনার নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। সংক্রমণের এই শৃঙ্খল ভাঙতে না পারলে সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।

মেডিকেল অ্যানথ্রোপলজিস্ট ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. চিন্ময় দাস ভোরের কাগজকে বলেন, সংক্রমণটা আরো আগেই হয়েছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে তা এখন জানানো হয়েছে। ডেল্টার সামাজিক সংক্রমণ হওয়া মানে চরম ঝুঁকিতে পড়া। যে কোনো বয়সের মানুষই এই ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে। আমাদের এখন খুব সচেতনভাবে পদক্ষেপ নিয়ে এগুতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে জনগণের সম্পৃক্ততা। আমাদের এখন যুদ্ধকালীন সময়ের প্রস্তুতি নিতে হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App