×

মুক্তচিন্তা

টেকসই বাঁশ নয়, বাঁধ চান উপকূলের জনগণ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২১, ১২:১০ এএম

ইয়াস ভাসিয়ে নিয়েছে ঘরবাড়ি, গরু, ছাগল, টিউবওয়েল, চাল-ডাল, জমানো টাকা আর কত কী। ভাবলেশহীন চোখে সেই গল্প করছিলেন আবু মালেক। চোখে পানি নেই। বিপন্ন হওয়ার নমুনা আছে, ক্ষত আছে। জোয়ান ছেলে তরুণ ছোট দুই বোন আর মাকে নিয়ে শ্যামনগরে থাকে। অবাধ্য পানির জোয়ার থেকে নিজেদের রক্ষা করতে চেষ্টা করেছে তরুণ। পারেনি। প্রকৃতির বেপরোয়া শক্তির কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে। ফোনে বাবাকে সব হারানোর গল্পটা আর্তচিৎকারে করেছে কেবল। শুধু ইয়াস নয়, তার আগে আম্ফান, সিডর আরো কত কী প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল। আবু মালেক বাড়তি সচ্ছলতার জন্য ঢাকায় সিএনজি চালান। তরুণ পরিবার নিয়ে আবু মালেকের এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় বেশিদিন হবে না। কারণ সাতক্ষীরায় করোনা শনাক্তের হার তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। কী করব, কোথায় যাবÑ এমন প্রশ্ন কাউকে করেননি আবু মালেক। নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই বুঝতে চেষ্টা করছেন। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা তার দেখা নতুন কিছু নয়। প্রায় প্রতি বছর তাদের নিঃস্ব হতে হয়। ভাঙনের ক্ষয় গুনতে হয়। প্রতিকার নেই। আবু মালেক বাড়ি যেতে পারেননি। গিয়ে কী হবে। গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। দুঃখ নয়, আফসোস করে বললেন, কেমন আজব দেশে থাকি, শুধু বলা হয় উন্নয়নে ভাসছে দেশ, অথচ আমরা ভাসি ঘূর্ণিঝড়ে, জলোচ্ছ্বাসে, নদীভাঙনে! দুর্যোগ আমাদের পিছু ছাড়ে না! কোনো রক্ষা হয় না! উন্নয়নের নামে যা দেখানো হয়, তার সব সুবিধাবাদীর জন্য। দুর্যোগ কারোর জন্য আশীর্বাদ, কারোর জন্য অভিশাপ! ভালোরাই আরো ভালো থাকতে চান! ভালো থাকেন! ত্রাণ আর উদ্ধার কাজটুকুই কেবল আমাদের জন্য! আমরা তো আর ত্রাণ চাই না! টেকসই বাঁধ চাই! কথাগুলোর সঙ্গে ক্ষোভ ছিল স্পষ্ট। আবু মালেক আমার কাছ থেকে অতিরিক্ত গাড়ি ভাড়া চাননি। আমি তাকে একটি বাড়তি টাকা অফার করতে সাহস পাইনি। কারণ এই শ্রেণির মানুষের আছে কাদামাটির মতো সহজ, সরল সম্মানবোধ। ইয়াসের পর আবু মালেকের কথাই শুনলাম উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের মুখে মুখে। নিউজভিত্তিক টিভি চ্যানেলে সেই দাবিই প্রচার হচ্ছিল। আম্ফানের সময় যা শুনেছিলাম তারই পুনরাবৃত্তিÑ ত্রাণ নয়, টেকসই একটা বাঁধ চাই। দেখছিলাম কীভাবে তারা মাটি আর বালুর বস্তা ফেলছেন বুক সমান জলে ডুবে। অথচ উদ্ধারকাজ আর ত্রাণ বিতরণে অভিজ্ঞরা বুঝতে পারছেন না যে, ক্ষতিগ্রস্তদের চাহিদা বদলেছে। বুঝতে পারছেন না বলে বলা ভালো বুঝতে চাইছেন না। কারণটা পরিষ্কার, একটা টেকসই বাঁধ নির্মাণ হলে তো সংশ্লিষ্টদের কাছে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের সুযোগ আসবে না, বাঁধ সংস্কারের সুযোগ থাকবে না। এসবে তো প্রচুর লাভ। টাকা কামাইয়ের সুযোগ রয়েছে পরতে পরতে। বরং সমস্যাকে টিকিয়ে রেখে যতদিন সমাধানের নামে টাকা কামাই করা যায়। এমন যোগ বিয়োগ ও গুণনের হিসাব নতুন নয়। বহুদিনের। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা ও নদীভাঙন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই উপকূলীয় অঞ্চলে ৩ কোটি ৫০ লাখ এবং চরাঞ্চলে ৬৫ লাখ মানুষের জীবনের ঝুঁকি নিয়েই চলছে টেকসই উন্নয়ন ভাবনা! হাজার হাজার কোটি টাকা এই এলাকার বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ হলেও একটা টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। মন্ত্রী থেকে শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রতি বছর ভাঙা রেকর্ড বাজান, বাঁধ সংস্কার করার প্রকল্প নেয়া হয়েছে কিংবা অতি জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ সংস্কার করা হচ্ছে, হবের গল্প শোনান। নির্মম বাস্তবতা হলো, মানুষের জীবন ও তার সহায় সম্বল রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি, হয় না। দুর্নীতিবিরোধী সরকার আমলে কেন আজ পর্যন্ত টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি, এই প্রশ্নের উত্তর না নিতে পারলে, না দিতে পারলে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানটা সমালোচিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়, সমালোচিতও হয়। বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার নিয়ে ইতোপূর্বে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ এবং উত্তরণের উপায় : ঘূর্ণিঝড় আম্ফানসহ সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এই ৯ বছরে উপকূলীয় ১৬টি জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৯ হাজার কোটি টাকা। ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা খুলনা, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালী এলাকা। অথচ বরাদ্দের ১৯ হাজার কোটির টাকা বেশি খরচ করা হয়েছে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের এলাকায়। যেখানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, বরাদ্দকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হলে উপকূলের ৪ হাজার ৭০০ কিলোমিটার মাটির বাঁধ, ১ হাজার কিলোমিটার জিও ব্যাগনির্মিত বাঁধ এবং ২০০ কিলোমিটার ব্লক নির্মিত বাঁধ সম্পূর্ণ নতুনভাবে নির্মাণ করা সম্ভব ছিল। অথচ সেই কাজটি করা হয়নি। বাঁধ নয়, এতদিন যেন বাঁশ সংস্কার করা হয়েছে। যে বাঁশ উপকূলীয় জনজীবনকে দেয়া হয়েছে, সহায়-সম্বলহীন করেছে। কেন টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হয়নি কিংবা কতটুকু করা হয়েছে ইত্যাদি বিষয়গুলো কোনো জবাবদিহিতার মধ্যে পড়ে কিনা, সেই প্রশ্নটিই বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কে আছেন জবাব দেবার? জবাব তো দিতেই হবে। পাউবোর লোকে যখন কথা বলেন, অস্পষ্টতা থাকে। সদুত্তর মেলে না। ১৯ হাজার কোটি টাকা তো জনগণের টাকা এবং তা কম নয়। ৯ বছর ধরে কোথায় গেল এই টাকা, কতটুকু কাজ হলোÑ এমন প্রশ্নের জবাব জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি থাকল। জবাব দিতেই হবে। লুটপাটের কেচ্ছাকাহিনী নতুন নয়। প্রকল্প মানেই টাকা কামাইয়ের বিরাট সুযোগ। দ্বিমতের সুযোগ নেই যে, এই ঘৃণ্য সুযোগ নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত হয় দায়িত্বশীলদের অসততায় ও লোভে। মনিটরিং ও রাজনৈতিক সদ্বিচ্ছার অভাবে। আবার যার বা যাদের মনিটর করার কথা, তিনি বা তারা নিজেরাই যদি দায়িত্ববান ও সৎ না হন, তাহলে তো লুটপাট কমে না বরং আরো বাড়ে, গতিশীল হয়। লুটপাটের সিন্ডিকেট তৈরি হয়। অবস্থা সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে কিনা, ভাবা দরকার। পানি উন্নয়ন বোর্ড নিজেদের স্বচ্ছতা প্রমাণ করবেন, সেই আশা করতে পারি। নিশ্চয়ই সৎ লোক আছেন। তিনি মুখ খুলবেন। তার মুখ খোলায় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের দুর্দশা কমবে। হতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। বছর বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের দুর্দশা ও ক্ষতিকে পাশে রেখে, জিইয়ে রেখে মধ্যম আয়ের দেশের ঢেকুর তোলা কিংবা টেকসই উন্নয়নের কথা বলা, রীতিমতো ধোঁকার শামিল বৈকি। স্ববিরোধীও। বড় বড় কথার সঙ্গে যায় না। পরিশেষে বলি, প্রতি বছর উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের এমন দুর্যোগ পরবর্তী দুর্দশা ও ক্ষতিগ্রস্ততা আর দেখতে চাই না। আবু মালেকের মতো মানুষ ত্রাণ চান না। স্থায়ী সমাধান চান, টেকসই বাঁধ। লুটপাটের সংস্কৃতিতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ না হয়ে, টেকসই বাঁশ নির্মাণ হলে এই বাঁশ খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

স্বপ্না রেজা : কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App