×

সাময়িকী

শোকসভা নয়, গুণী বেঁচে থাকতেই সুখসভা করুন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২১, ০৩:২৮ পিএম

শোকসভা নয়, গুণী বেঁচে থাকতেই  সুখসভা করুন

সাগর কূলের সন্তান সংগীতগুরু সৈয়দ মহিউদ্দিন। জনজীবনের সুখ দুঃখ ও বেদনার সাতকাহনে যেন তারই সুরে কর্ণফুলীর তীরে আছড়ে পড়ে ঢেউয়ের ছন্দ। জোয়ার-ভাটার তালে সুর মিলিয়ে ক্লান্ত ছাম্মান (সাম্পান) মাঝি কণ্ঠে তোলেন তারই লেখা-

ছাম্মান মাঝি ছাম্মান বায় আগের ডইল্যা পেছিঞ্জার নঁঅয় পায়, কেঁএ কুরুত, কেঁএ কুরুত ঢেক্কা মাঝিত্যে আর গঅম নঁঅ লায়॥

শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালি ঘোষ, কল্যাণী ঘোষের কণ্ঠে ব্যাপকভাবে চাটগাঁর গান পরিচিতি লাভ করে। অন্যান্য অঞ্চলের লোকের কাছে দুর্বোধ্য এই আঞ্চলিক ভাষা ও লোক-জীবনের প্রতি গভীর দরদ, দায়িত্ববোধ তাঁর চেতনায় মিশে আছে। বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী তীরবর্তী বিস্তীর্ণ প্রান্তিক জনপদের সুখ-দুঃখের গল্প, প্রেম-ভালোবাসার মিশ্রণে আনন্দ-বেদনার কাব্যে, স্রষ্টা-সৃষ্টি ও মানব প্রেমের গভীরতায় বুনেছেন সুরের ইন্দ্রজাল। প্রেমিক-মনের সৌন্দর্যে অলৌকিক আনন্দের সন্ধানে জন্মভূমিকে ভালোবেসেই রাজধানীমুখী হতে চাননি। তাই হয়তো, স্বমহিমায় উদ্ভাসিত সৈয়দ মহিউদ্দিন নামটি আজো রয়ে গেল লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাঁর বিখ্যাত একটি গান-

মেজ্জান দিইয়ে, মেজ্জান দিইয়ে ওইতারত ওইতারত গরিবুল্লাই মেইট্টা বঁঅচি, ডঁঅর মাইনসুল্লাই বাসুনঅত কী সুন্দইরজ্যা বিছানঅত।

সম্ভ্রান্ত সমাজপতিদের প্রতি তীব্র ক্ষোভে ঐতিহ্যবাহী মেজবানের বাস্তব চিত্র এঁকেছেন সাবলীলভাবে। জনপ্রিয় গানটি ১৯৮৩ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং বেতারে রেকর্ড করেন আঞ্চলিক গানের কিংবদন্তি শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব। অঞ্চল ও সম্প্রদায়ভেদে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও খাঁটি উচ্চারণে তুলে ধরেছেন মাইজভাণ্ডারিসহ সমাজের উঁচু-নিচুর ব্যবধান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা-খরা, ইতিহাস-লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কঠিন বাস্তবতাকে উপলব্ধির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় লীন হয়ে সমাজের নানা বিষয় অবলোকন করেছেন দার্শনিকের দৃষ্টিতে। ঐতিহ্য চেতনা ও অনুরাগের সম্মিলনে বিভিন্ন আঙ্গিকের দুই হাজারের অধিক গানে দেশপ্রেম-মুক্তিযুদ্ধ-মানবপ্রেম ও মানব জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো শব্দের মজবুত গাঁথুনি ও সুরের সুতায় গেঁথেছেন রূপকে, উপমায়। জীবনের কঠিন সত্য ও বাস্তবতাকে ব্যক্তিগত অনুভূতি দ্বারা, বুদ্ধিবৃত্তি, কল্পনায়, চমৎকার বাক্য বিন্যাসে সাজিয়েছেন। সংবেদনশীল মনে, নিপীড়িত মানুষের অসহায় যন্ত্রণাকে অন্তর দিয়ে অনুভব করেছেন- অ জেডা ফঁইরার বাপ, অ জেডা ফঁইরার বাপ একদিন বুঝিবা জেডা, একদিন বুঝিবা। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের তীক্ষè বাণ ছুড়ে দেয়া জনচিত্তে সাড়া জাগানিয়া কালোত্তীর্ণ গানটি নিরক্ষর-খেটে খাওয়া জনগণের নিজস্ব সম্পদ। নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যাটল ট্রেনে ছাত্রছাত্রীরা আনন্দ নিয়ে উপভোগ করতেন গানটি। প্রেমানুভূতি মিশ্রিত আধুনিক গানসহ লৌকিক জীবন ও ভাষায় তার গীতবাণী চিত্রময়রূপে মানুষের চিত্তের অতল স্পর্শ করে। সমাজ সচেতনতা, প্রতিবাদী উচ্চারণ, গণমানুষের প্রতি সুগভীর সহানুভূতিসহ পূর্ণ আস্থায় ফুটে ওঠে মানবতাবাদের ছবি। সামাজিক দুর্ভোগ ও অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে নিষ্ঠুর দমননীতির যূপকাষ্ঠে, শাসন-শোষণ, ধারাবাহিক অবিচার ও উৎপীড়নের পরিণতি দেখে দুর্দশাক্লিষ্ট বাংলার এ মাটিতেই তাঁর শৈশব-বেড়ে ওঠা। শাস্ত্রীয় সংগীতে সুপ্রশিক্ষিত হলেও অকৃত্রিম জীবনের রূপ, মাটির সোঁদা গন্ধ-মিশ্রিত ঐশ্বর্য খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর মমতামাখা আঞ্চলিকতায়। চট্টগ্রামের সংস্কৃতি, আনন্দ-উৎসব-বেদনাকে মাধুর্যমণ্ডিত সুরে, শিল্পীর সুললিত কণ্ঠে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভক্তের হৃদকোঠরে পৌঁছে দিয়েছেন। বলিষ্ঠ কণ্ঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মানসিকতা তার বংশগত গুণ। রাগপ্রধান, আধুনিক, পল্লীগীতি, আঞ্চলিক, মাইজভাণ্ডারিসহ বিভিন্ন আঙ্গিকের গান রচনায় স্বমহিমায় ভাস্বর মাইজভাণ্ডারের প্রেমাসক্ত মরমি চেতনার চিরকুমার সৈয়দ মহিউদ্দিন। সংসার বিরাগী হলেও জগৎসংসার যাকে আলাদা করতে পারেনি, চট্টগ্রামবাসী তারই পরমাত্মীয়। শুধু শেফালি ঘোষের জন্যই লিখেছেন শতাধিক গান। এছাড়া কণ্ঠশিল্পী মমতাজ, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, তপন চৌধুরী, রবি চৌধুরী, ফকির শাহাবউদ্দিন, কল্যাণী ঘোষ, সন্দীপন, নিশিতা বড়ুয়া, আবদুল মান্নান কাওয়াল, সেলিম নিজামী, প্রেমসুন্দর বৈষ্ণব, আলাউদ্দিন তাহের, শিমুল শীল, সঞ্জিত আচার্যসহ সমকালীন খ্যাতিমান শিল্পীর কণ্ঠে জনপ্রিয় তার অসংখ্য গান। বিকৃত বাণীতে গানের উচ্চারণ, মেজাজ ও অলংকারকে শুদ্ধ ভাষার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন অনেক শিল্পী। এ বিষয়ে প্রবল হতাশা, অভিমানে তিনি বলেন, ‘‘আমার বাপ-দাদা যে ভাষায় কথা বলেছেন সেটাই আঞ্চলিক। ‘ছাম্মানঅলা’ কে শুদ্ধ করে ‘সাম্পানওয়ালা’ বললেই কি আঞ্চলিক হলো? শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, দয়া করে আমার আঞ্চলিক গানকে আধুনিক উচ্চারণে বা বিকৃত বাণীতে গাইবেন না।’’ ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর ডিসি হিলের মঞ্চ থেকে নামার সময় পা পিছলে বাম হাত, বাম পা ভেঙে যায়। বর্তমানে শয্যাশায়ী এবং নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করছেন তিনি। মেরুদণ্ডের হাড়ের ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহযোগিতা কামনা করে তার আকুল আবেদন, ‘হে মানবতার প্রতীক, চিকিৎসকের পরামর্শে সিঙ্গাপুরে উন্নত চিকিৎসা নিতে পারলে হয়তো আমি হাঁটাচলা করতে পারব। কিন্তু এত ব্যয়বহুল চিকিৎসা নেয়ার সাধ্য আমার নেই। অপচিকিৎসায় মৃত্যুকে বরণ করতে চাই না বলেই আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আশা করি আপনার কৃপাদৃষ্টি আমায় সুস্থ করতে সহায়তা করবে। জয় হোক মানবতার।’ অসংখ্য মনীষীর জন্ম চাটগাঁর মাটিতে। অল্পসংখ্যক গুণী পাদপ্রদীপের আলো পেলেও উপেক্ষা-অনাদরে-অবহেলায় অন্তরালে রয়েছেন বহু মহাজন। এঁদেরই শিল্পচেতনায় লোক-ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয়, কিন্তু সভ্য সমাজে বাস করেও সঠিক মূল্যায়ন করতে পারি না। গানই যার ধ্যান-প্রেম, গানের জন্যই একসময় ত্যাগ করেছিলেন পরিবার-পরিজন। ব্যক্তিগত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমি বেঁচে থাকতেই আপনারা ‘সুখসভা’ করুন, নিজের চোখে দেখে যাই। কিন্তু মারা গেলে দয়া করে আমার নামে ‘শোকসভা’ করবেন না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গানের মাঝেই বেঁচে থাকতে চাই ভক্তকুলের হৃৎকমলে।” চট্টগ্রামের অন্যতম পথিকৃত নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ গীতিকবি এ কবি ফটিকছড়ি উপজেলার পূর্ব সুয়াবিল গ্রামে সৈয়দ আমির হোসেন ও সৈয়দা আনোয়ারা বেগমের কোল আলো করেন ১৯৪৭ সালে। রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম নিয়ে গানের জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও শিকড় থেকে সরেননি। একাত্তরের হানাদার বাহিনী ‘পাঞ্জাবি’ ছিল বলেই রাগে-ক্ষোভে মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে পাঞ্জাবি ব্যবহার করেন না। সংগীত শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীর পূর্ণাঙ্গ মানস গঠনই তার উদ্দেশ্য। প্রচলিত ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যৌবনের সন্ধিক্ষণ থেকেই বিরামহীন সৃষ্টিনেশায় ডুবে থাকা কবির কাব্যপ্রতিভা আজ আকাশচুম্বী। প্রেমধর্মের চিরন্তন আকাক্সক্ষায় প্রতিনিয়ত অন্তরে অনুভব করেন শিকড়ের টান। তার মরমি হৃদয়ের সাক্ষ্য বহন করে লোকজ আঙ্গিকের গানগুলোতে। বিস্তৃত তার অন্তর্জীবন, যা অনুভবের এবং বহুমুখী বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। চিন্তা-চেতনা ও যাপনের তথ্যচিত্র রেখেছেন রচিত রত্নখণ্ডে, যা জ্ঞানের, সত্যের, সুন্দর ও সাধনার। নিজের প্রায় পাঁচশত গান সুর করে শিল্পীর কণ্ঠে তুলে দিয়েছেন। একান্ত সাক্ষাৎকারের একটি অংশে অভিমান ও ভালোবাসা মিশ্রিত কণ্ঠে বলেন- ‘‘বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান’ বইটির লেখক ও কল্যাণী ঘোষকে আন্তরিক ধন্যবাদ। কিন্তু বইটিতে রয়েছে অসংখ্য ভুলভ্রান্তি। এলাকার মানুষ দিয়েই আঞ্চলিক কাজ-তথ্য সংগ্রহ-সংরক্ষণ কিংবা গবেষণা করানো উচিত। এছাড়া কেবল শেফালি ঘোষ গাইলেই আঞ্চলিক গান হয় না, বা চট্টগ্রামের ভাষার সব গানই আঞ্চলিক নয়। সব গানকে একাধারে আঞ্চলিক বলা যাবে না। তাই চট্টগ্রামের লেখকের মাধ্যমে নামসহ বইটিকে সংশোধন করার অনুরোধ রইল বাংলা একাডেমির সম্মানিত মহাপরিচালকের প্রতি। এ বিষয়ে বিকল্প আরেকটা বইও হতে পারে। আশা করি তিনি ভেবে দেখবেন।’’ জাতীয়ভাবে পরিচিতি না থাকলেও সৈয়দ মহিউদ্দিন মানুষের কবি, সাফল্যের বিচারে আপাতত এটাই তার মাপকাঠি। তার ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যজীবন বিশদভাবে মূল্যায়িত হলে নিঃসন্দেহে নতুন প্রজন্ম উপকৃত হবে। চাঁটগার বাইরে সমকালীন সুধীজনদের কাছে অপরিচিত হলেও নিঃসন্দেহে একসময় বাঙালির চিত্তকে আলোকময় করে তুলবে তার পল্লিসুরের হিরণ¥য় জ্যোতি। সৈয়দ মহিউদ্দিন একটি নাম, ব্যক্তি বা দীক্ষাগুরু নন, যেন একটি প্রতিষ্ঠান। বাঙালির লোকায়ত সাধনা ও সংস্কৃতির চেতন-মানসে দীক্ষাগুরু হিসেবে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পরিচিত বৈরাগ্যমুখী সৈয়দ মহিউদ্দিনের জীবনবোধ ও অন্বেষার সূচনা। আঞ্চলিক পরিচিতি, প্রকাশ এবং গানের পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা নিঃসন্দেহে বাংলার লোকসাহিত্য, লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবে। বিদায়ক্ষণে রোগাক্রান্ত বদনেও একান্ত অনুরোধে গেয়ে শোনালেন তার রচিত শিশুকালে শোনা সেই প্রিয় গানটি- পিরিত মানে পুডুর-পাডুর, কাঁঅম নাই যাআত্তে কাঁঅম গঁঅরন বান্দরন্নান খুইট্টাই খুইট্টাই, খাওজ্জাইয়েরে পুক বাছন এই জমানার পিরিতির লক্ষণ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App