×

সাময়িকী

নিরুদ্দেশ

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২১, ০৩:৩২ পিএম

নিরুদ্দেশ

বয়সটা ছিল রোমান্টিকতার। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়ি তখন। সেকেন্ড ইয়ারে। মন ছিল অস্থির। কেমন যেন। না পারি নিজেকে বুঝতে, না পারি অন্যকে। বই পড়া আর সংগ্রহ করা ছিল আমার নেশা। বন্ধুরা আমার কাছ থেকে বই নিত পড়ার জন্য। তাদের মধ্যে অনেক মেয়ে বন্ধু আবার বইয়ের মধ্যে গুঁজে দিত চিরকুট। তাতে থাকত ভালো লাগার কথা। ভালোবাসার কথা। আমার পক্ষ থেকে জবাব না পেয়ে পরে যখন চিরকুট বিষয়ে জানতে চাইত, তখন সেগুলো না দেখার ভান করতাম। বলতাম, কই দেখিনি তো! বইটা তো ওই দিনই আরেক বন্ধুকে দিয়েছি পড়তে। সে খুব অবাক হতো আমার উদাসীনতায়। তবে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার বাহানা বুঝতে কষ্ট হতো না। এভাবে অনেক অনেক চিরকুটের বন্যায় আমি নিজে একদিন প্লাবিত হলাম। দুই কূল ভাসিয়ে নদী আজ ভরা যৌবনা। বয়ে চলে নিরবধি মোহনার খোঁজে। মনের আকাশে ঘুড়ি ওড়ায় সে সর্বক্ষণ। পড়তে বসলে তার কথা খুব মনে পড়ে। লিখতে গেলে মনে পড়ে। ক্লাসে স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে চোখ চলে যায় তার দিকে। কিন্তু তাকে সেটা বুঝতে দিই না। কেমন যেন আড়ষ্টতা পেয়ে বসেছে আমাকে। ভালো লাগার কথা কাউকে বলার মতো সাহস আমার নেই। তাই ভাবলাম, চিরকুটই একমাত্র ভরসা। কলেজ থেকে বাসায় ফিরে প্রতিদিন পড়তে বসতাম লাইব্রেরি রুমে। সাজানো-গোছানো লাইব্রেরিটার একটা আদি ইতিহাস আছে। সেখানে ছিল বইয়ের এক বিশাল ভাণ্ডার। চার হাজারের অধিক বই ছিল। এর কিছু ছিল বাবার সংগ্রহের। বাড়িতে আমার অনেক বইয়ের মধ্যে আছে প্রিয় কিছু বই। কিছু বই উপহার পাওয়া। কিছু বই খুঁজে খুঁজে কেনা। কোনো বই একবার পড়েছি। কোনোটা একাধিকবার। সফোক্লিস, হোমার, সক্রেটিস, শেকসপিয়ার, শেলি, বাইরন, বারট্রান্ড রাসেল, ম্যাক্সিম গোর্কি থেকে শুরু করে শেখ সাদি, মাইকেল, সুকান্ত, রবিঠাকুর, নজরুল, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ সবার বই ছিল সংগ্রহে। বন্ধুরা বই নিত পড়ার জন্য। কিন্তু এর মধ্যে অনেকেই ফেরত দিত না। তার পরও পড়তে দিতাম। কেননা বই তো পড়ার জন্যই। শেলফে তুলে রাখার জন্য নয়। যেসব বই কেউ ফেরত দিত না, সেগুলো আবার কিনতাম। আমার মনে আছে, রবিঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ সাতবার কিনেছি; বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’ কিনেছি পাঁচবার আর শেকসপিয়ারের ‘ওথেলো’ কিনেছি দুবার। নিজে যেমন বই পড়তে ভালোবাসতাম, তেমনি অন্যকেও পড়তে উৎসাহিত করতাম। আমার পড়ার টেবিলটা ছিল লাইব্রেরির উত্তর-পূর্ব কোণে। টেবিলের পাশে বড় একটি জানালা। জানালার ওপারে পরিপাটি বাগান। পড়তে বসে জানালা দিয়ে উদাস মনে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। পড়ন্ত বিকালে গাছ থেকে পাতা পড়ার শব্দ মনের আয়নায় তৈরি করত অন্য রকম এক অনুরণন। অনেক সময় ঝাপটা বাতাস শুকনো পাতাগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে যেত বাগানের এক পাশে। সেই দৃশ্য ছিল চমৎকার ছান্দনিক। মনে হতো, কেউ তুলির আঁচড়ে আঁক কেটে কেটে মেঘের ছবি আঁকত বাগানের বালুময় মেঝেতে। ভাবনার জগতে অতল গহ্বরে যখন তলিয়ে যেতাম, তখন ছেদ পড়ত টমির ডাকে। আমি পড়তে বসলেই সে এসে জানালার কয়েক হাত দূরে আমার দিকে মুখ করে বসে পড়ত। আজ পণ করেছি, যে করেই হোক মনের কথাগুলো লিখব চিরকুটে। ভালো লাগার মানুষটিকে সেটা দেব বইয়ের মধ্যে গুঁজে। কিন্তু কোনোভাবেই গুছিয়ে লিখতে পারছি না। দু-এক শব্দ লিখেই চিরকুটটি হাতের তালুতে নিয়ে গোল করে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারছি। এভাবে যতবার জানালার বাইরে ছুড়ে মারছি, দেখছি টমি সেটা মুখে করে নিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। কোনোভাবেই ছন্দ মিলিয়ে লিখতে পারছি না। এদিকে স্বস্তিও পাচ্ছি না লিখতে না পারার অপারগতায়। একসময় ভাবলাম, এ কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। সন্ধ্যার আগে বাসার বাইরে যাওয়ার জন্য যেই না উঠতে গেছি, দেখি সব কটা কোঁকড়ানো চিরকুট আমার টেবিলের ডান পাশে পড়ে আছে। আমি তো হতবাক! তাহলে টমি এ কাজ করেছে! ভাগ্যিস কেউ দেখে ফেলেনি! কেননা মাঝেমধ্যে মা এসে পড়ার টেবিলে চা-নাশতা দিয়ে যেতেন। বকাঝকা করতেন সারা দিন বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকি বলে। অনেক রাত অবধি পড়াশোনা করার অভ্যেস ছিল আমার। পূর্ণিমা রাতে জানালার ওপাশে জোছনাগুলো ঝরে পড়ত শুভ্র তুষারের মতো। বাগানের মেঝেতে ঝরে পড়া জোছনায় একধরনের দ্যুতি তৈরি হতো। ঝিরিঝিরি বাতাসে গাছের পাতাগুলোয় জোছনারা খেলা করত সাগরের ঢেউয়ের মতো। এ যেন সবুজ আর জোছনার লুকোচুরি। আমি হারিয়ে যেতাম দূর অজানায়। জোছনামাখা ভাবনাগুলো প্রতিধ্বনিত হতো গাছের পাতায় পাতায়। হঠাৎ টমির চিৎকারে ফিরে পেতাম নিজেকে। যতক্ষণ জেগে থাকতাম, ততক্ষণ সে বসে থাকত জানালার ওপারে। তার মানে সে কি আমাকে পাহারা দিত? অথচ আমি ওর জন্য যতটা করতাম, তার চেয়ে বেশি করতেন মা। বাসার অদূরে এক কসাইয়ের দোকান থেকে প্রতিদিন হাড়যুক্ত মাংস কিনতেন তিনি। সেগুলো হালকা মসলায় রান্না করে দিতেন টমিকে খেতে। তার পরও টমির সব ভালোবাসা ছিল আমার প্রতি। টমি ছিল আমার আপনের অধিক। পড়ার টেবিলে যতক্ষণ থাকতাম, সে জানালার ওপারে বসে থাকত আমার দিকে মুখ করে। চুপচাপ তাকিয়ে থাকত। আমিও নাশতা খাওয়ার সময় মিষ্টি টোস্ট বিস্কুটের কিছুটা অংশ ছুড়ে মারতাম তার দিকে। মাটিতে পড়ার আগেই সে লাফিয়ে ধরে ফেলত। যেটা ধুলোয় পড়ে যেত, সেটা আর খেত না। পরবর্তী ক্যাচ ধরার জন্য অপেক্ষা করত। ওর সাথে খেলা করতে গিয়ে দেখা যেত নাশতার অনেকটাই চলে গেছে জানালার ওপারে। কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম যখন, তখন টমি রুমের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকত। বাসা থেকে বের হয়ে যখন হাঁটতে শুরু করতাম, তখন সেও আমার আগে আগে চলত। রাস্তার মোড় পর্যন্ত গিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ত। আমি আর পেছন ফিরে তাকানোর অবকাশ পেতাম না। কিন্তু বুঝতে পারতাম টমি আমার পথপানে চেয়ে আছে। তার থেকে কিছুদূর যেতেই দু-তিনবার ‘ঘেউ ঘেউ’ করে কিছু একটা বলত আমায়। হয়তো সাবধান করে দিত; নয়তো কলেজ থেকে তাড়াতাড়ি ফিরতে বলত। কিছুই বুঝতাম না ওর ভাষা, কিন্তু আমার অনুমানটা ছিল প্রখর। কলেজ থেকে ফেরার সময় দেখতাম টমি আমাদের ছাদে উঠে পায়চারী করছে। আমাকে দেখেই ‘ঘেউ ঘেউ’ করতে শুরু করত। দৌড়ে নিচে চলে আসত। বাসার মধ্যে পা রাখতেই মাটিতে শুয়ে পড়ত টমি। আমি ওর বুকের ওপর পা রেখে আদর করতাম। সে অনেকক্ষণ ওই আনন্দ উপভোগ করত। আমিও টমির কাঁধে, গলায় হাত রেখে আমার ভালো লাগা আর আদর প্রকাশ করতাম। একটা সময় রোজ খেয়াল করতাম, কলেজ থেকে ফেরার সময় টমি রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত আমার অপেক্ষায়। আমাকে আসতে দেখেই দুই পা সামনের দিকে টানটান করে দিয়ে শুয়ে পড়ত। ওর বুকে-পিঠে পা দিয়ে আদর না করা পর্যন্ত উঠত না। একসময় পড়াশোনার জন্য ফ্রান্সের প্যারিসে আসার প্রস্তুতি শুরু হলো। বাসায় আমাকে নিয়ে সবার ব্যস্ততা দূর দেশে পড়তে যাব, এটা যতটা না আনন্দের, পরিবারের সবার কাছে ছিল ততটা কষ্টেরও। বড় ভাই যাত্রার সব ব্যবস্থা করে পাঠিয়েছেন। আত্মীয়স্বজন আসছে আমার সাথে দেখা করতে। কেউ কেউ বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছে। কেউ আবার গিফটও নিয়ে এসেছে আমার জন্য। কিন্তু আমার মন বলছে অন্য কথা। ভাবছি, আহা! বারবার পড়া বইগুলো তো অধিক বোঝার ভয়ে সাথে নিতে পারব না। বইয়ের আলমারি, পড়ার টেবিল, জানালা, জানালার ওপারে কত বছরের চেনা পৃথিবীÑ এসব ফেলে যাওয়া কতো কঠিন। বুকের মধ্যে কষ্টের বাঁশি এভাবে বেজে উঠবে, তা আগে বুঝতে পারিনি। কখনো ভাবিনি, বিদায়ের আগে আমার শৈশব-কৈশোরের সবটুকু ভালো লাগা, ছোট ছোট আনন্দ-বেদনা, কিছু স্মৃতিময় ঘটনা একে একে আমাকে ঘিরে নতুন করে জেগে উঠবে। যদিও এ যাওয়া শেষ যাওয়া নয়, তবুও এটাই স্বাভাবিক, এটাই নিয়ম, এভাবেই যেতে হয়। এক বিকালে আমার মনে হলো, আমার প্রিয় কুকুরটিও কিছু একটা অনুমান করে ফেলেছে। সে আর আগের মতো আমার কাছে আসে না। আমার আদর চায় না। আমাকে দেখলে দৌড়ে কাছে আসে না। সে শুধু কিছুটা দূর থেকে আমাকে দেখে। উদাস মনে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। কোনো আওয়াজ করে না। সে এখন আমাকে কী যেন বলতে চায়। সে অনেক কিছু আমার কাছে জানতে চায়। হয়তো-বা আমার চোখমুখ থেকে সে উত্তর খুঁজে নেয়, কিন্তু আমি তার প্রশ্ন বুঝি না। আমি তার ভালোবাসার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি না। আমরা তো মুখের বলা ভাষাই বুঝতে পারি না, না-বলা ভাষাহীনের ভাষা বুঝব কী করে? আজ প্যারিসের উদ্দেশে রওনা হব। সবাই ব্যতিব্যস্ত আমাকে নিয়ে। আমার লাগেজগুলো গাড়িতে তোলা হয়েছে, যারা বিমানবন্দর পর্যন্ত যাবেন না, তাদের কাছ থেকে একে একে বিদায় নিচ্ছি। প্রিয়জনরা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন আমাকে বিদায় দিতে গিয়ে। কেউ কেউ দোয়া পড়ে মাথায় ফুঁ দিচ্ছেন আমার মঙ্গল কামনায়। সবার কাছে আমি যে কতটা প্রিয় মানুষ ছিলাম, সেটা বিদায়ের কালে উপলব্ধি করেছি। সবার আবেগ-অনুভূতির মায়াজাল কাটিয়ে উঠতে গিয়ে আমার চোখেও জল এসে পড়ছিল। বারবার মনে পড়ছিল বিশ্বকবির লেখা সেই পঙ্ক্তির কথা, ‘যেতে নাহি দিব। হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ বিদায়ের শেষক্ষণে এবার গাড়িতে ওঠার পালা। দরজা খুলে ঢুকতে গিয়েই কী যেন মনে করে উঠতে পারলাম না। চারদিকে তাকালাম। খুঁজে ফিরছি কাউকে। কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে তাকে দেখলাম না কোথাও। আমার অনুসন্ধিৎসু চোখ দেখে মা জানতে চাইলেন, ‘কারে খোঁজো, বাবা?’ বিষণ্ন বদনে মাকে বললাম, আমার টমিকে তো দেখছি না। মা আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আশপাশে আছে হয়তো। আল্লাহর নাম নিয়ে গাড়িতে ওঠো, বাবা।’ খুব করে ইচ্ছে করছিল বিদায়ের সময় টমিকে একটু আদর করার। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। ঐ সময় টমিকে খুব মিস করছিলাম। অগত্যা রওনা হলাম। পুরো চব্বিশ ঘণ্টা জার্নির পর প্যারিসে পৌঁছলাম। সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা জায়গায় এসে সব সময় ফেলে আসা অতীতের কথা, আত্মীয়স্বজনের কথা, প্রিয়জনদের কথা খুব করে মনে পড়ছিল। আর প্যারিসের রাস্তায় যখন দেখতাম ফরাসিরা কুকুর নিয়ে চলাফেরা করছেন, তখন আমার টমির কথা মনে পড়ে যেত। আমার প্রতি তার ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, আমাকে আগলে রাখার চেষ্টাÑ এসব ক্ষণিকের জন্যও ভুলতে পারতাম না। কোনো এক জোছনা রাত। প্যারিসে আমার জানালার ধারে পড়ার টেবিলে বসে মাকে চিঠি লিখছি। আজ জানালার বাইরে টমি নেই। কিন্তু তার অবস্থান আমার সত্তাজুড়ে। চিঠির শেষে টমির বিষয়ে জানতে চাইলাম। প্রায় দুই সপ্তাহ মাস পর মায়ের চিঠি এলো। সেটা পড়ে নিজেকে সংবরণ করা কঠিন হয়ে পড়ছিল আমার জন্য। অনেক কথার মাঝে মা টমিকে নিয়ে লিখেছেনÑ স্নেহের খোকা, তুমি হয়তো খেয়াল করোনি, তুমি প্যারিসে যাওয়ার কয়েক দিন আগে থেকেই টমি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। বারান্দার এক কোণে চুপচাপ শুয়ে থাকত। তুমি যেদিন চলে গেলে, সেদিন থেকে টমিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সবখানে তাকে খোঁজা হয়েছে। অবশেষে স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় দশ হাজার টাকা পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল টমিকে খুঁজে পেতে। তবুও পাওয়া যায়নি। সে আর ফিরে আসেনি। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে টমির ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি। জানি সে বেঁচে নেই। কিন্তু তার চলে যাওয়াটা ছিল চিরপ্রস্থান নাকি নিরুদ্দেশ? সেটা আর জানা হয়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App