×

মুক্তচিন্তা

নন-এমপিও শিক্ষকরা বেঁচে থাকবেন কীভাবে

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২১, ১২:৩০ এএম

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তাহলে শিক্ষক শিক্ষার মেরুদণ্ড। আধুনিক উন্নত রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। অথচ আমরা দিনের পর দিন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ও পাঠদানের অনুমতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের কোনো প্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান না করে খাটিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, দেশে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৭ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক প্রতিষ্ঠান এমন অঞ্চলে তৈরি হয়েছে যে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলে অত্র অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ভাগ্যে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ তৈরি হবে না। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন লক্ষাধিক। নন-এমপিও পর্যায়ে মাধ্যমিক থেকে শুরু করে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাদের পাঠদানে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হচ্ছে। তারা পাঠদান শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে বেতন পাচ্ছে অথচ যারা শিক্ষা দিল তারা বেতনবিহীন থেকে যাচ্ছে দিনের পর দিন। এটা অত্যন্ত অমানবিক এবং জাতির জন্য লজ্জা। রাজনৈতিক নেতা ও আমলারা গলা ফাটিয়ে মঞ্চে বক্তব্য রাখছে শিক্ষকরা হচ্ছে জাতি গড়ার কারিগর। তারাই আবার চেয়ারে বসে শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার কথা লক্ষ রাখছে না। মনে হয় কেন জানি আমলাদের মাঝে একটা মনমানসিকতা কাজ করছে যে শিক্ষকদের সম্মান ও সুবিধা কত কম দেয়া যায়। পৃথিবীর আরো এমন কোনো দেশ আছে কিনা তা আমার জানা নেই যে শিক্ষকতা করলে বেতন নেই। শহরের প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে অধিক বেতন আদায়ের ফলে শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। অন্যদিকে গ্রামীণ এমপিওভুক্তিহীন প্রতিষ্ঠানে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী খুঁজে বের করে আনতে হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রে বেতন আদায় করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, এনটিআরসি কর্তৃক নিয়োগের বাইরে যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের বেশির ভাগকেই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এ আশায় অনেকেই চাকরিটা ছাড়তেও পারছে না আবার অনেকেরই ইতোমধ্যে বয়স অনেক বেশি হয়ে গেছে। অন্য কোনো চাকরিতে প্রবেশ করে এখন আর চাকরি করার মানসিক শক্তিই নেই। এসব নির্মম সত্যকে মনে জমিয়ে রেখে আশায় দিন গুনছে অনেকেই। কিছু কিছু জায়গায় শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়িয়ে দিনাতিপাত করছেন তবে সব বিষয়ের শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তারপর আবার শুরু হয়েছে করোনা কাল। গ্রামের দিকে এমনও অনেক নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক রয়েছেন যাদের অনলাইনে ক্লাস করানোর জন্য ধার করে স্মার্টফোন কিনতে হয়েছে সরকারের নির্দেশনার কারণে। এসব চিত্র একেবারেই বাস্তবধর্মী। অথচ সরকারের কথা অনুযায়ী মনে হয় শিক্ষকরা সবই পাচ্ছে। অথচ যারা বেতন পাচ্ছে এমপিওভুক্তির মাধ্যমে কিংবা সরকারি প্রতিষ্ঠান তারাও কিন্তু একই সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাচ্ছে এবং অন্যান্য সব প্রকার রাষ্ট্রীয় নিয়মকানুন মেনে চলছে এই ক্ষেত্রে বেতনের ক্ষেত্রে শুধু বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সবকিছু যেন অদৃশ্য সুতায় বন্দি। বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দেশ গড়ার কাজে নিজেদের এ মহান পেশায় সম্পৃক্ত করে হতাশায় নিমজ্জিত হাজার হাজার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। অনেক সময় বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ হচ্ছে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জন্য সুখবর। সুখবরটা হলো নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য এককালীন ৫ হাজার টাকা আর কর্মচারীদের জন্য ২ হাজার ৫০০ টাকা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এ ধরনের সংবাদ, যা জাতিকে বিব্রত করে। শিক্ষা জীবন শেষ করে চাকরির আশায় শিক্ষক হওয়ার লোভে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়ে দীর্ঘদিন বেতন ছাড়া থাকা মানুষের জীবনে চরম ক্ষতি। ২০১০ সালের পর ২০১৯ সালে ২ হাজার ৭৪৩টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল যার মধ্যে স্কুল ও কলেজ ১ হাজার ৭৬৩টি, কারিগরি প্রতিষ্ঠান ৪৮৬টি এবং মাদ্রাসা ৫১২টি। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠানে অর্ধেক করে বিভাগ এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে কারিগরি অধিদপ্তরের বিএম শাখাতে বেশি। একই প্রতিষ্ঠানে একই সঙ্গে চাকরিতে প্রবেশ করে কেউ বেতন পাচ্ছে কেউ পাচ্ছে না এটা একটা অমানবিক বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার পরে যোগদানকারীদের বেতন হয়েছে কিন্তু বাদ গেছেন সিনিয়ররা। এসব বিষয়ের জটিলতা নিরসনে আরো মানবিক সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি। এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের এমন কোনো ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না। ২০১৯-এর পর নতুন করে কোনো প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। সরকার প্রতি বছর এমপিও প্রক্রিয়া চালু রাখার কথা বললেও কাজে নেই কোনো অগ্রগতি। এনটিআরসি নামক নিয়োগের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে সরকারের কিন্তু এদের কার্যক্রম এতই দুর্বল যে, শিক্ষা ব্যবস্থার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে এর ব্যবস্থাপনা। সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধরনের আশ্বাস প্রদান করা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে এর অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো নয়। বাজেটে শিক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি করে এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে আরো বেশি বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। মোট কথা হলো, শিক্ষাকে মুখে মুখে গুরুত্ব না দিয়ে বাস্তবে গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারকে দেশের প্রয়োজন মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে যেভাবে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে তা আর না করতে দেয়াই উচিত। তার মানেটা হলো শিক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। এই ক্ষেত্রে এমপিওভুক্তির কোনো বিষয় থাকবে না সব শিক্ষাকে দুই ভাগে ভাগ করতে হবে এর এক ভাগে থাকবে সরকারি অন্যভাগে থাকবে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনা থাকবে তবে কোনো ব্যয় বহন করবে না। এতসব হতাশার মাঝেও আলোর মুখ দেখার প্রত্যাশায় দিন গুনছে হাজার হাজার শিক্ষিত বেকাররা। এ থেকে এদেরকে মুক্তি দেয়ার জন্য সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট। আধুনিক যুগের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলতে হলে শিক্ষায় আধুনিকায়নের বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের উচিত শিক্ষা খাতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া। বিশেষ নজর প্রদানের মাধ্যমে আধুনিক উন্নতমানের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তকরণ এখন সময়ের দাবি।

নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার : প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App