×

জাতীয়

মহামারির সময়ে বড় ঘাটতির বাজেট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ জুন ২০২১, ১১:০০ পিএম

মহামারির সময়ে বড় ঘাটতির বাজেট

বাজেট ২০২১-২২

করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছেন বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তারা। কিন্তু বিপাকে এখনও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও সিএসএমই উদ্যোক্তারা। এছাড়া দেশের আমদানি-রপ্তানি কমে যাওয়াসহ স্থানীয় উৎপাদন ও সরবরাহে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এতে সরকারের আয়ের অন্যতম খাত রাজস্ব আহরণে ধস নামে। যার প্রভাব আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, মহামারি মোকাবিলায় সরকারের ব্যয় বাড়ছে। আগামীতেও তা অব্যাহত থাকবে। এতে আয় ও ব্যয়ের বড় ব্যবধানে বেড়ে যাচ্ছে ঘাটতির পরিমাণও। এমন পরিস্থিতিতে প্রথমবারের মতো জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি ঘাটতি ধরে আজ বৃহস্পতিবার ঘোষণা করা হবে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট। এটি মোট জিডিপির ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর চলতি সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটের আকার বাড়ছে ৬৪ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। বাজেট ঘোষণা করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

বিশাল আকারের এ বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে মানুষের জীবন ও জীবিকা। করোনা মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত সবার জন্য কিছু না কিছু দেয়ার চেষ্টা করবেন অর্থমন্ত্রী। এবারের বাজেট ঘাটতিতে সৃষ্টি হবে নতুন রেকর্ড। আর সেই ঘাটতি মোকাবিলায় এবার কৌশল পরিবর্তন করে অভ্যন্তরীণ উৎসের চেয়ে বৈদেশিক উৎসের প্রতি নির্ভরতা বাড়ানোর চেষ্টা করবেন অর্থমন্ত্রী। নতুন করে করের জাল বিস্তৃত করে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে এনবিআর।

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা জানান, আসছে বাজেটের মোট আকার হতে পারে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার। বাজেটে মোট আয় ৩ লাখ ৯২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। সামগ্রিক ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। মানুষের হাতে টাকার সরবরাহ বাড়াতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগ টানার চেষ্টা থাকবে বছর জুড়েই। এজন্য বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা ধরা হচেছ। আর মোট অনুন্নয়ন ব্যয় ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংক ঋণ নেওয়া হবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাস মহামারিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। টানা এক বছরেরও বেশি সময় জুড়ে চলা করোনার তান্ডবে থেমে চরম মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। লাখ লাখ মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মহীন। আড়াই কোটি মানুষের নতুন করে দরিদ্রের খাতায় নাম উঠেছে। এ অবস্থায় আসছে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে জীবন ও জীবিকা। অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থান। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কৃষিখাতে থাকছে বিশেষ ছাড়ের ঘোষণা। থাকবে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার ঘোষণা। দরিদ্র মানুষকে সুবিধা দিতে বাড়বে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা। করোনা মহামারিতে মানুষ ও সরকারের আয় কমে যাওয়ায় সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা থাকবে বাজেটে। করোনা বাস্তবতায় বাজেট অধিবেশন হবে সংক্ষিপ্ত। নতুন করের বোঝা চাপাতে চান না অর্থমন্ত্রী। মানুষকে কষ্ট না দিয়ে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতাতেও তিনি এ প্রসঙ্গে আলোকপাত করবেন।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও গবেষণা সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহি চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারিতে আমাদের সবকিছুই লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। জীবন-জীবিকা থেমে গেছে। তাই আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নিতে হবে। যে পরিকল্পনা নেওয়া হবে তা হতে হবে বাস্তবভিত্তিক। একইসঙ্গে তা বাস্তবায়ন করতে অত্যন্ত শক্তিশালী মনিটরিং ব্যবস্থাও থাকতে হবে।

তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিয়ে মানুষকে কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। করোনার কারণে দুই ধরনের দরিদ্র তৈরি হয়েছে। গ্রামের তুলনায় শহর এলাকায় দারিদ্র্যের হার বেশি বেড়েছে। কাজ হারা ও কর্মহীনদের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। বাজেটে এ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট উদ্যোগ ও ঘোষণা থাকতে হবে। এবং সে উদ্যোগ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি: করোনা মহামারি নামক অদৃশ্য শত্রুর কারণে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ছন্দপতন ঘটেছে। এর প্রভাব পড়েছে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। এজন্য আগামী অর্থবছরের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির টার্গেট কমিয়ে ধরা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বাজেটে প্রবৃদ্ধির এ্ই হার ধরা হয় ৮ দশমিক ২ শতাংশ।

এদিকে করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গেছে। ফলে মানুষের হাতে টাকার সরবরাহও কমেছে। যার ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয়ই থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আসছে বছরে মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের মোট জিডিপির আকার ধরা হচ্ছে ৩৪ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

অনুন্নয়ন ব্যয়: আগামী বাজেটে সরকারের পরিচালন ব্যয় বা অনুন্নয়ন ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করোনা মহামারীর ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়েছে। চলতি বছরের বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। সে তুলনায় আসছে বছরে পরিচালন ব্যয় বাড়বে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর আবর্তক ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ২৮ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ ব্যয় ধরা হচ্ছে ছয় হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।

উন্নয়ন ব্যয়: আসছে বাজেটে মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৭৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। যা এরইমধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের বাজেটে এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে এডিপির বাস্তবায় হয়েছে ৩৫ শতাংশেরও কম।

বাজেট ঘাটতি: দীর্ঘদিন পর এই প্রথমবারের মত বাজেট ঘাটতি ৬ শতাংশের বেশি ধরা হচ্ছে। আগামী বছরের বাজেটে বাজেট ঘাটতি ধরা হচ্ছে প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এতদিন বাজেট ঘাটতি মোট জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার বৃত্ত ভেঙ্গে তা ৬ শতাংশের ওপরে চলে যাচ্ছে। যা মূলত সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করবে। শুধু তাই নয় অনুদান বাদে আসছে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হচ্ছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। আর অনুদানসহ সামগ্রিক ঘাটতি ধরা হচ্ছে দুই লাখ ১১ হাজার ১৯১ কোটি টাকা।

ঘাটতি অর্থায়ন: বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সরকার বরাবরই দুই উৎসকে বেছে নেয়। এরমধ্যে বিদেশী ও অভ্যন্তরীণ উৎস। আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎসের নির্ভরতা কিছুটা কমিয়ে বৈদেশিক উৎসের প্রতি নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে। আসছে বছরে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ঋণ নেবে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। আর জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে ৩২ হাজার কোটি টাকা। অন্যান্য খাত থেকে নেওয়া হবে ৫ হাজার এক কোটি টাকা। বাজেটে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা। বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ পাওয়া যে লক্ষমাত্রা ধরা হচ্ছে সেটাও এ যাবতকালের সর্বোচ্চ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App