×

জাতীয়

শিক্ষাঙ্গনে চরছে গরু-ছাগল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২১, ০৮:৪৬ এএম

শিক্ষাঙ্গনে চরছে গরু-ছাগল
শিক্ষাঙ্গনে চরছে গরু-ছাগল
শিক্ষাঙ্গনে চরছে গরু-ছাগল
শিক্ষাঙ্গনে চরছে গরু-ছাগল

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন গরু-ছাগলের দখলে। ছবি: ভোরের কাগজ

শিক্ষাঙ্গনে চরছে গরু-ছাগল

* রাখা হয়েছে ধান-খড় * জমেছে ঘাসের জঙ্গল * ভাঙছে দেয়াল-আসবাব

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের বারান্দায় বেঁধে রাখা হয়েছে গরু-ছাগল। তাদের বিষ্ঠায় কালো প্রলেপ পড়েছে পাকা মেঝেতে। বিদ্যালয়ের মাঠজুড়ে ধানের খড়ের স্তূপ। শ্রীমঙ্গলের বৌলাশীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের সামনের মাঠজুড়ে ঘাসের জঙ্গল। লতাপাতা জাতীয় উদ্ভিদ বিদ্যালয়ের পাকা দেয়াল বেয়ে ছাদ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। দীর্ঘদিন মানুষের পা না পড়ায় এমন দশা হয়েছে ওই স্কুলের। হবিগঞ্জের মাধবপুরের হরিতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনের রুমে রুমে ধানের খড় রাখা হয়েছে। রাজশাহীর চারঘাটের ভায়ালক্ষ্মীপুর বুধিরহাট কলেজ মাঠে বড় বড় গাছ কেটে রাখা হয়েছে। একই উপজেলার পিরোজপুর ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের সামনে শিশু-কিশোরদের খেলারসামগ্রী ভেঙে পড়ে আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, করোনা মহামারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পদচারণা নেই। পাঠদান কার্যক্রম বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ রয়েছে খেলাধুলাও। এই কারণে প্রভাবশালীরা সুযোগ নিয়ে গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গোচারণভূমি আর চাতাল হিসাবে ব্যবহার শুরু করেছেন। গত ১৪ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এমন চিত্র ফুটে উঠেছে। অথচ শিক্ষা প্রশাসন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বার্তা দেয়া হলেও তা শুধুই ‘মুখের কথা’ হিসেবেই রয়ে গেছে। শিক্ষক-কর্মচারীদের স্ব স্ব স্কুলে যাওয়ার কথা থাকলেও তারা শুধু বেতন-ভাতা তোলার জন্য উপজেলা সদরে গিয়েছেন। কিন্তু স্কুলমুখো হননি। খোলার আগে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মেরামত বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগে পড়তে হবে।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক ভোরের কাগজকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য একটি গাইডলাইন দেয়া আছে। সেই গাইডলাইন মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরা কাজ করবেন। প্রসঙ্গত, ওই গাইডলাইনে বলা আছে- পরিকল্পনামাফিক প্রয়োজনীয় জীবাণুনাশক প্রয়োগসহ পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের দায়িত্ব বণ্টন, নির্দিষ্ট সময় পর পর হাত ধোয়ার ব্যবস্থাসহ কিছু বিষয় লিখে দৃশ্যমান স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু কোথাও এমন দৃশ্য চোখে পড়েনি ভোরের কাগজের সরেজমিনে। তবে এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি মহাপরিচালক। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. মিজানুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, মাঝেমাধ্যে পরিষ্কার করে আবার করে না। এই নিয়েই চলছে। বাস্তবতা বোঝেন তোÑ উল্লেখ করে তিনি পাল্টা প্রশ্নে বলেন, আগে মানুষের জীবন, তারপর অন্য কিছু। তারপরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়। সবমিলিয়ে সমস্যা আছে আবার সমাধানও আছে। আগামী ১৩ জুন স্কুল খুলবে এরকমটা ধরে নিয়ে স্কুল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য আবার নির্দেশনা দেয়া হবে বলে জানান তিনি।

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে এবং অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙ্গিনা বালু, কাঠ ব্যবসায়ীরা গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করছেন। এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে পরিবেশও দূষিত হচ্ছে।

জানতে চাইলে চারঘাট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, উপজেলায় অধিকাংশই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এগুলোর দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের। কিন্তু তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন না। সরেজমিনে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, স্কুলগুলোতে বিরাজ করছে বেহাল দশা। শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে গ্রামাঞ্চলের প্রতিষ্ঠানগুলোরই করুণ অবস্থা। গত ২৯ মে উপজেলার বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দরজা-জানালা খোলা এবং ভাঙা। প্রতিষ্ঠানের ভেতরে গরু-ছাগলের গোবর-বিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠানের বারান্দায় বাঁধা রয়েছে গরু, ছাগল আর মহিষ। মাঠে চড়ছে ভেড়ারদল। সেই সঙ্গে গৃহিণীরা করছেন ধান শুকানোর কাজ। দূর থেকে দেখে চেনার উপায় নেই- সেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না বাসাবাড়ির আঙ্গিনা।

উপজেলার বিয়াঘাট ইউনিয়নের নারায়ণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মো. জিয়াউল ইসলাম জিয়া জানান, এলাকার কৃষকদের কথা বিবেচনা করে অনেকটা বাধ্য হয়েই স্কুল মাঠ ছেড়ে দেয়া হয়েছে। স্কুল খোলার আগেই সব পরিস্কার করে দেয়া হবে। যোগেন্দ্রনগর মাদ্রাসার সুপার জাহাঙ্গীর আলম জানান, করোনার কারণে দীর্ঘদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই অবস্থা হয়েছে। উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শাহাদত হোসেন জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সব প্রস্তুতি আমরা নিয়ে রেখেছি। জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে সব প্রতিষ্ঠান প্রধানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বলে দেয়া হয়েছে। এরপরও আমরা নিয়মিত খোঁজখবর রাখছি। গুরুদাসপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. হাফিজুর রহমান জানান, দুএকটা প্রতিষ্ঠানে অগোছালো পরিবেশ থাকতে পারে। আশা করছি খুব শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হবে। গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তমাল হোসেন বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী স্ব স্ব বিভাগকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তারপরও কেউ বিষয়টি অবহেলা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ভোলার চরফ্যাশনের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় বেঞ্চ-ডেস্কে ধুলাবালির আস্তরণ পড়ে আছে। স্কুলগুলোর দরজা-জানালায় মাকড়সা জাল বুনেছে। কয়েকটি স্কুলের মেঝেতে রয়েছে তালের খোসা। এছাড়া উপকূলীয় এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বারান্দায় জেলেরা জাল সংস্কার করছেন। কোথাও কোথাও স্কুলসংলগ্ন মাঠে চরানো হচ্ছে গরু-ছাগল। স্কুলগুলোর বারান্দায় মহিষকেও রাখতে দেখা গেছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয় গোয়ালঘর কিংবা বালু-খোয়া রাখার গোলা। পরিস্থিতি দেখে বোঝার উপায় নেই এটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দৃশ্যমান এতকিছুর পরও এ চিত্রটি নজরে নেই প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের কারো। সেখানকার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আবু সিদ্দিক বলেন, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে এখানে যা খুশি তাই হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তৃষিত কুমার জানান, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা হোমওয়ার্ক করছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত সমস্যা নেই। সব শিক্ষকরাই বিদ্যালয়গুলো পরিচ্ছন্ন রাখছে।

নোয়াখালী দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে গরু-ছাগলের বিচরণ, ভবনের বিভিন্ন কক্ষ গৃহস্থলীর কাজে ব্যবহার হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষে রাখা হয়েছে ধানের বস্তা, অন্য কক্ষে রাতে বেঁধে রাখা হয় ছাগল, ভবনের ছাদে শুকানো হয় সিদ্ধ ধান। ফলে ছাত্রছাত্রী নয় এলাকার লোকজনের নানা কাজে মুখরিত থাকে বিদ্যালয়গুলো। হাতিয়া পৌরসভা ১নং ওয়ার্ডে অবস্থিত কান্তাগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিদ্যালয়টির মাঠ গরুর চারণভূমিতে পরিণত করছে এলাকাবাসী। বৃষ্টি এলে সেই গরুগুলোর অবস্থান হয় বিদ্যালয়ের বারান্দায়। সরেজমিনে এও দেখা গেছে, শুধু উপজেলা সদরকেন্দ্রিক কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো অনেকটা ভেঙে পড়েছে। গ্রামের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী অনুপস্থিত থাকায় চেয়ার টেবিল ও বেঞ্চ-ডেস্ক ভেঙে ভেঙে পড়ছে। রক্ষণাবেক্ষণ না থাকায় ভবনের দরজা-জানালাগুলো ভেঙে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠানের। হাতিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ভবরঞ্জন দাস বলেন, আমাদের এখনো বিদ্যালয় খুলে দেয়ার অফিসিয়ালি কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। খুলে দেয়ার আগে আমরা স্ব স্ব বিদ্যালয়ের বিভিন্ন মেরামতের কাজ সেরে নেব। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাও করে নেব।

নওগাঁর ধামইরহাটের বিভিন্ন স্কুল ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানে নেতাদের নেতৃত্বে রক্তদান, চক্ষুশিবির, দন্ত চিকিৎসা, সালিস দরবারও চলেছে। আমাইতাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবাধে গরু-ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বারান্দায় খড়ের স্তূপ। চকময়রাম সরকারি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গরু, ছাগল ও স্থানীয় ছেলেদের আড্ডা। ধামইরহাট সফিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের একপাশে গরু-ছাগল ঘুরে বেড়াচ্ছে, অন্যপাশে মানুষ ধান শুকাচ্ছে। রাসেল স্টেডিয়াম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় ধানের বস্তা। মোজাফ্ফর রহমান দাখিল মাদ্রাসায় গেটে তালা থাকায় ফটক থেকে দেখা গেছে বারান্দাগুলোতে ময়লা আবর্জনা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। চন্ডিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে সারাক্ষণ পতাকা ঝুলছে। মাঠে গরু-ছাগল ঘুমাচ্ছে। ধামইরহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে ইট, বালু, খোয়া ছিটকে পড়েছে, মাঠে ঘাস আর ঘাস। অমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. তরিকুল ইসলাম জানান, তার প্রতিষ্ঠানেও স্থানীয়দের ধানের বস্তা ও খড়ের পালা গাদা রয়েছে। ধামইরহাট সফিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান ইউসুফ মর্তুজা জানান, আমরা পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে পারিনি। চন্ডিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. মুকুল হোসেন জানান, সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানীয় নেতা ধান কাটার শ্রমিকদের আশ্রয় দেয়াসহ বিদ্যালয় ভবনের ভিতরে ধান মাড়াই করেছেন। অপর একজন নেতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ভেঙে ফেলেছে।

(প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ভোরের কাগজের চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিনিধি মাইনুল হক সান্টু, মাধবপুর (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি রাজীব দেবরায়, গুরুদাসপুর (নাটোর) প্রতিনিধি মো. মাজেম আলী মলিন, চরফ্যাশন (ভোলা) প্রতিনিধি এআর সোহেব চৌধুরী, হাতিয়া (নোয়াখালী) প্রতিনিধি মো. ফিরোজ উদ্দিন ও ধামইরহাট (নওগাঁ) প্রতিনিধি মো. আবদুল আজিজ মন্ডল।)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App