×

মুক্তচিন্তা

রক্তেরাঙা ঈশান বাংলার শহীদ গাথা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২১, ১২:৩১ এএম

শাসকের ধারালো ছুরির টানে যেদিন বাংলার মানচিত্র ফালা হয় সেদিনই বাঙালির জীবনে অন্তহীন দুঃখও ভবিতব্য হয়। খণ্ডিত বাংলা থেকে কাত করে ঢেলে ফেলা বাঙালির ঢল নামে আসাম আর পশ্চিমবঙ্গে। সীমান্ত অঞ্চল বলে শ্রীহট্টের বাস্তুহারা মানুষের স্রোত বরাক উপত্যকামুখী হয়। তবে আসামের বাঙালির একটা বিরাট অংশের আগমন কিন্তু কেবলই দেশভাগ নয় বরং ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিবিধ ঘটনাক্রমে। ভাষার নামে রাজ্য গঠন হওয়ার পর আসমিয়াকে রাজ ভাষা করার দাবি ক্রমে গুঞ্জন থেকে গণআওয়াজে রূপ নেয়। দুই ভাষা গোষ্ঠী অধিকার আর স্বার্থের প্রশ্নে একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে, ইন্ধন জোগায় কুটিল রাজনীতি আর নির্মমতার উদ্গাতারা। ১৯৬০-এর এই বিদেশি খেদাও আন্দোলন কার্যত বাঙ্গাল খেদাও আন্দোলনে মোড় নেয়। যার তীব্রতা ছিল আগের সব আন্দোলন থেকে অনেক বেশি। স্থানে স্থানে বিক্ষিপ্ত হিংসা আর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয় বাঙালি। সব ওজর আপত্তি, আন্দোলন অভিযোগ বেপাত্তা করে ২৪ অক্টোবর ১৯৬০ সালে আসাম বিধানসভায় আসমিয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার আইন পাস হয়। এর প্রতিবাদে বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। এখানে উল্লেখ প্রয়োজন যে, আসমিয়া ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি বাঙালিদের কোনোকালেই অশ্রদ্ধা ছিল না। শুধু দাবি ছিল নিজের মাতৃভাষার অধিকার আদায় করা। মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা হরণের প্রতিবাদে একটা সময় এ আন্দোলন মানুষের শিরায় শিরায় ছড়িয়ে গেল। সাত থেকে সত্তর সবাই রাজপথে নেমে এলেন। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত হলেও জনবিন্যাসের কারণে সীমাবদ্ধতায় আটকে ছিল। অনড় একগুঁয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিস্ফুরণ ঘটে ১৯ মে ১৯৬১ সালে। এদিন অবিভক্ত কাছাড়জুড়ে [বর্তমান দক্ষিণ আসামের বরাক উপত্যকা] ভোর ৪টা থেকে পালিত হচ্ছিল সর্বাত্মক হরতাল। ভাষা সংগ্রামীরা অন্ধকার থাকতেই ঊষার দুয়ারে আঘাত হেনে তিমির রাতের শেষ দেখতে দলে দলে শিলচর রেল স্টেশনে পৌঁছেছিলেন। উদ্দেশ্য ভোরের ট্রেন আটকে দেয়া। ট্রেনের চাকা ঘোরানোর জন্য প্রশাসন মরিয়া হয়েও হেরে গেল। রেল স্টেশন থেকে অবরোধ সৃষ্টিকারীদের হটিয়ে দিতে পুলিশ দফায় দফায় লাঠি চালাতে শুরু করল। বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে পুলিশ শিলচর রেল স্টেশনে গুলি চালায়। দেখতে দেখতে রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েনÑ কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, সুকোমল পুরকায়স্থ, কানাই নিয়োগী, কুমুদ দাস, সুনীল সরকার, হিতেশ বিশ্বাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর ও তরণী দেবনাথ। লাঠিচার্জ এবং কাঁদানে গ্যাসে আহত শতাধিকের মধ্যে পরদিন হাসপাতালে মৃত্যু হয় বীরেন্দ্র সূত্রধরের। সত্যেন্দ্র দেবনাথ নামে আরেক ভাষাশহীদের মৃতদেহ পরদিন স্টেশনসংলগ্ন পুকুরে ভেসে ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, পুলিশ নাকি তাকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল। তারপর আর ’৬১-এর আন্দোলন প্রান্তিক মানুষের কেড়ে নেয়ার চিৎকারে আবদ্ধ রইল না। সর্বভারতীয় সংবাদপত্রগুলোর দৌলতে পৌঁছে গেল দেশ দেশান্তরে। সংগ্রাম প্রসারিত হলো পশ্চিমবঙ্গেও। দেশ-বিদেশের তাবড় তাবড় বাঙালি নেতারা বরাকে আসতে লাগলেন। শহীদের আত্মত্যাগ যাতে বিফল না হয় তাই আন্দোলন আরো দুর্বার হলো। অবশেষে আন্দোলনের নেতাদের কাছে দিল্লি থেকে আলোচনার ডাক এলো। তার আগে আসামে এসে তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী যে সমাধান সূত্র দিয়েছিলেন তাতে বাংলা ভাষার অধিকার সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয় বলে আন্দোলনকারী নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ২ ও ৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে, কাছাড়ের [বর্তমান বরাক উপত্যকা] সরকারি ভাষা বাংলাই হবে। এই একাদশ ভাষাশহীদই পরবর্তীতে ইতিহাসের পাতায় বরাক উপত্যকাকে স্বাভিমানী ঈশান বাংলার মর্যাদা দিয়েছে। বরাকের বাঙালির নৈমিত্যিক যাপনকথায় শত আগ্রাসনের চাপ ভেদ করে বাঙালিত্ব নিয়ে টিকে থাকার জীবনীশক্তি দিয়েছে। সংসারের ফেনিল সাগরে বছরের বাকি দিনগুলো হাবুডুবু খেলেও উনিশের একটা ফিরতি ঢেউ তাকে আবার তটে এনে আছড়ে ফেলে। সে অনুভব করে, তার যা কিছু শোভন, যেটুকু যাপন, কথন লিখন আচরণ সবটুকুর বাহনই হচ্ছে ভাষা আর সংস্কৃতি। স্মৃতির ধূসরতা আর বহু আত্মপ্রবঞ্চনার পরও উনিশের ডাক উপেক্ষার ক্ষমতা বরাকের বাঙালির নেই।

দীপঙ্কর ঘোষ  : শিলচর, আসাম, ভারত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App