×

অর্থনীতি

জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা চাই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২১, ১০:৪৫ পিএম

জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা চাই

এম এম আকাশ। ফাইল ছবি

এবারের বাজেট করোনা যুদ্ধের চলমান অবস্থায় প্রণীত বাজেট। সেই হিসেবে মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে স্বাস্থ্য খাতে সরকার অনেক বেশি বরাদ্দ দিবেন এবং রোগ প্রতিরোধ, রোগের চিকিৎসা এবং রোগীদের পুনর্বাসনের জন্য নানা কর্মসূচি এবারের বাজেটে থাকবে।

আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ লোক অসংগঠিত খাতে নিয়োজিত। বর্তমান করোনাকালে অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। একটি হিসাব মতে (অক্সফাম ও অ্যাকশন এইড) বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি লোক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, ৮৬ শতাংশ মানুষের আয় হ্রাস পেয়েছে এবং ৭৮ শতাংশ মানুষ খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের জন্য আয় সমর্থনের (Income Support) জরুরি প্রয়োজন রয়েছে সেজন্য জরুরিভাবে দ্রুত ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ খাতে প্রচুর বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ব্যয়ের প্রয়োজন। শোনা যাচ্ছে এবার অন্তত বরাদ্দের ক্ষেত্রে তা কিছুটা হতেও পারে। এটা দেখার জন্য ৩ তারিখ পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

এছাড়া শুধু জীবন রক্ষা হলে চলবে না। জীবিকাও রক্ষা হওয়া চাই। সেজন্য এসএমই অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্যও প্রচুর বরাদ্দ দরকার। রপ্তানিমুখী শিল্প ও প্রবাসী শ্রমিকদের যদি রক্ষা করা না যায় তাহলে বৈদেশিক মুদ্রায় সংকটও সৃষ্টি হতে পারে, যদিও বর্তমানে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এত ভালো যে সরকার শ্রীলঙ্কাকে ডলার সাহায্য দিচ্ছে!

কিন্তু সবচেয়ে বড় যে সংকট বর্তমানে মানুষকে বিক্ষুব্ধ ও সরকার সম্পর্কে আস্থাহীন করে দিচ্ছে তা হচ্ছে সরকার ব্যয় বরাদ্দ যতটুকুই করুক না কেন তাতে প্রচুর নয়ছয় হচ্ছে এবং সুশাসনের অভাবে গরিব মানুষ তার প্রাপ্য হিস্যা পাচ্ছে না। এর বিরুদ্ধে করোনার কারণে আন্দোলন-সংগ্রামও তেমন একটা জমে উঠছে না। বিএনপির হুংকার ও বামপন্থিদের মানববন্ধনের মধ্যে আন্দোলন সীমাবদ্ধ।

আমরা ইতোমধ্যেই দেখেছি স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির করাল গ্রাস। সেটি যখন একজন সাহসী সাংবাদিক প্রকাশ করেছিলেন তখন উল্টো তার ওপরে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের খড়গ নেমে আসল। আমরা দেখেছি নগদ অর্থ ও রিলিফ বণ্টনে যাদের প্রাপ্য নয় তারাও অর্থ ও খাদ্যদ্রব্য পাচ্ছেন। আর যাদের প্রাপ্য তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। অভিযোগ করার জন্য কোনো রাস্তাও তারা দেখছেন না। আমরা দেখছি পোশাক শিল্প ও বৃহৎ শিল্পের মালিকরা প্রচুর ‘রিফাইন্যান্স লোন’ পাচ্ছেন কিন্তু তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার হয়নি। এরপরও শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে (পোশাকশিল্পে এর মাত্রা প্রায় ৮ শতাংশ)। অনেক খবরের মধ্যে বড় খবর হচ্ছে রেমিট্যান্স হিসাবে যে বিপুল অর্থ দেশে এসেছে তার একটা বড় অংশই হয়তো ধনীদের পাঠানো হাত ঘুরে আসা কালো টাকা। তবু ভালো যে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এবার অপ্রত্যাশিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

সরকার বাজেটে এবারো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তা যদি হয়, তাহলে সেটা, যারা ন্যায়সঙ্গতভাবে ট্যাক্স প্রদান করে তাদের সুবিধা না দিয়ে ক্ষমতাবান লুটেরা পুঁজিকেই বেশি সুবিধা দিবে। সরকার অবশ্য একে ‘কাল টাকা’ না বলে ‘অপ্রদর্শিত আয়’ বলে অভিহিত করছেন। অপ্রদর্শিত আয় হলেও আয়ের উৎসটি কর আদায় ফর্মে লেখা বাধ্যতামূলক করা দরকার।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, তার কাছে বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের যে তালিকা আছে তাতে যথাক্রমে অসৎ আমলা, অসৎ রাজনীতিবিদ এবং অসৎ ব্যবসায়ীরা আছেন। তাদের নাম প্রকাশ ও শাস্তি এখনো হয়নি। সুতরাং আশঙ্কা থেকে যায় যে এই বাজেটেও আধিপত্য থাকবে ক্ষমতার ত্রিভুজের যার একটি বাহু অসৎ আমলা, অপর বাহুটি অসৎ ব্যবসায়ী এবং সর্বশেষ বাহুটি অসৎ রাজনীতিবিদ। এই ত্রিভুজ ক্ষমতা কাঠামোকে উদ্ঘাটিত করে ভাঙতে হবে। সংসদ সদস্যরা এক্ষেত্রে বাজেট আলোচনার সময় সাহস করে এগিয়ে আসতে পারবেন কি?

সুতরাং এই বাজেটে শুধু সঠিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, দরকার অসততা-লুটপাট-কুশাসনের অবসানের। সে জন্য চাই জনগণের ও সব দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির সংগ্রাম। যেখানেই অন্যায়, যেখানেই লুটপাট, যেখানেই কুশাসন সেখানেই জনগণকে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের ঝাণ্ডা তুলে ধরতে হবে।

মনে রাখতে হবে সারা বিশ্ব আজ একটা টালমাটাল অবস্থার মধ্যে আছে। যে কোনো মূল্যে আমাদের করোনা সংক্রমণের ও মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে হবে। তাই নির্বাচিত এলাকা বিশেষে লকডাউন, মাস্কসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও দ্রুত দেশবাসীকে টিকার আওতায় আনাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পরিকল্পিত পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা, আগাম আমদানি করে এসব পণ্যের ২০ শতাংশ সরকারি গুদামে রেখে দেয়া এবং প্রয়োজনমতো কম মূল্যে বাজারে ছাড়ার সক্ষমতা সরকারকে অর্জন করতে হবে। যাতে হঠাৎ করে বাজার লাগামহীন হয়ে না পড়ে।

প্রচলিত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে এখন পর্যন্ত সব আপেক্ষিকভাবে সুবিধা বঞ্চিতরা অংশগ্রহণ করতে পারেননি। নগরের বস্তিবাসী ও শ্রমিকদের জন্য রেশনিং চালু করা, নব্য গরিবের ও বেকার হয়ে যাওয়া মধ্যবিত্তের জন্য টিকে থাকার ব্যবস্থা করা, প্রান্তিক ও দুর্যোগাক্রান্ত এলাকায় বিশেষ বরাদ্দ দেয়া ইত্যাদি জরুরি ইতিবাচক বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে।

খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষিতে বাজেট বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা দরকার। বিশেষত সরাসরি কৃষকের জন্য ঋণ (অবশ্যই নিম্ন সুদে) প্রদান, উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষিপণ্যের লাভজনক দামও নিশ্চিত করতে হবে। এসএমই, নারী উদ্যোক্তা ও দরিদ্র মায়েদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ বাখতে হবে।

দেশে যাতে মন্দা দেখা না দেয় সেজন্য এবারের বাজেট উদার ও বড় হলে ক্ষতি নেই, সেই বৃহৎ ব্যয় কিছুটা সহায়তামূলক ‘ট্রান্সফার পেমেন্ট’ (Transfer Payment) হলেও ক্ষতি নেই, এতে বড় প্রকল্পে প্রত্যক্ষ বস্তুগত বা স্থির পুঁজির বিনিয়োগ হয়তো কম করতে হবে, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও হয়তো একটু কম হবে কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই, মানুষের জীবন রক্ষা ও দরিদ্রদের জীবিকা রক্ষাকেই এবার বাজেটে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে।

এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App