×

সারাদেশ

গৃহবধূর মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজাল, ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জুন ২০২১, ১০:৪৯ পিএম

গৃহবধূর মৃত্যু নিয়ে ধুম্রজাল, ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন

মারা যাওয়া গৃহবধূর সৎ শাশুড়ির কোলে মারজানের শিশু কন্যা।

নোয়াখালী সদর উপজেলার এওজবালিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মারজাহান আক্তার (২৬) নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু নিয়ে ধুমজাল সৃষ্টি হয়েছে। মৃত গৃহবধূর জানাযা পড়ানো ইমামের কাছ থেকে জোরপূর্বক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়ায় এটি হত্যা নাকি আত্মহত্যা এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।

ওই গৃহবধূ সদর উপজেলার উত্তর শুল্লুকিয়া গ্রামের মো. সোহাগের স্ত্রী এবং একই উপজেলার আন্ডারচর ইউনিয়নের আন্ডারচর গ্রামের শাহ আলমের মেয়ে। মারজাহান এক ছেলে ও দুটি কন্যা শিশু সন্তানের জননী।

স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, গত ৯ বছর পূর্বে সদর উপজেলার উত্তর শুল্লুকিয়া গ্রামের আবদুল খালেকের ছেলে মো. সোহাগের সঙ্গে উপজেলার আন্ডারচর গ্রামের শাহ আলমের মেয়ে মারজাহানের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে সোহাগ এবং তার স্ত্রী মারজাহানের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে কলহ চলে আসছিল। সম্প্রতিক সোহাগের সঙ্গে তাদের এক প্রতিবেশীর মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। বিষয়টি সোহাগের স্ত্রী মারজাহান জানতে পারলে তাদের কলহ প্রকাশ্যে চলে আসে। গত ৪ এপ্রিল ঝড়ের রাত ৮টার দিকে সোহাগ তার প্রতিবেশী প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। এতে সোহাগ ক্ষুব্ধ হয়ে মারজাহানকে শারীরিক নির্যাতন করলে তার মৃত্যু হয়।

সোহাগের সৎ মা রহিমা খাতুন জানান, তার ছেলের বৌকে প্রায় ভূতে ধরতো। ওইদিন সন্ধ্যায় ঝড় আসলে মারজাহান লাড়কি কুড়াতে গেলে তাকে আবারো ভূতে ধরলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাত  ১০টার দিকে মারজান মারা যায়।

স্থানীয় উত্তর শুল্লুকিয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মো. ইউসূফ বলেন, গত ৪ এপ্রিল রাত ১১টার সময় উত্তর শুল্লুকিয়া গ্রামের বাসিন্দা সুলতান মিয়ার ছেলে সবুজ, মফিজ উল্যা, তরিক উল্যার ছেলে হুদু মাঝিসহ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি এসে আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সোহাগের স্ত্রী মারজাহান আকস্মিক মারা গেছেন বলে জানান। মৃত ব্যক্তির জানাযা পড়াতে আমাকে অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধে আমি মারজাহানের জানাযার নামাজ পড়াই এবং দাফনের পর দোয়া করি। পরে উপস্থিত মুসুল্লিদের মারজাহানের মৃত্যুর বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে একেক জন একেক রকমের কথা বলে। গত ৯ এপ্রিল শুক্রবার মৃত মারজাহানের জন্য তার স্বামী সোহাগের বাড়িতে দোয়ার আয়োজন করে সেখানে আমাকে দোয়া করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।

তিনি বলেন, দুপুর ২টার দিকে আমি মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া শেষ করলে মারজাহানের স্বামী সোহাগ, তারা বাবা আবদুল খালেক, জামাল ও মফিজ উল্যা আমার কাছে এসে মারজাহানের একটি সমিতির কিস্তি ছিল। আপনিতো তার জানায়ার নামাজ পড়িয়েছেন, তাই তার কিস্তি মওকুপে আপনার একটা স্বাক্ষর লাগবে,  এই বলে তিনটি সাদা স্ট্যাম্পে ইমামের কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। স্বাক্ষর শেষে কৌতুহল বশত স্ট্যাম্পটি হাতে নিয়ে দেখি সেখানে লিখা আছে, মৃত ব্যক্তি মারজাহানের মৃত্যু যেকোনো ভাবেই হোক বা হইয়াছে, এ বিষয়ে কোন সমস্যা বা জটিলতা দেখা দিলে তার জন্য আমি ইমাম দায়ী থাকিব। এই মর্মে তারা আমার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্ধি লিপিবদ্ধ করে। এটা দেখে প্রতিবাদ করলে তারা আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক স্ট্যাম্পটি কেড়ে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আমি স্থানীয় ইউপি সদস্যকে বিষয়টি জানালেও আমার স্ট্যাম্পটি উদ্ধার করা হয়নি।

ইমাম মো. ইউসূফ বলেন, এ ঘটনায় গত ২২ এপ্রিল সুধারাম থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করলে থানা পুলিশ আইনগত কোন ব্যবস্থা নেননি। থানা ব্যবস্থা না নেয়ায় গত ২৭ মে ঘটনার বিষয়ে পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে সুধারাম থানার ওসিকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন পুলিশ সুপার।

নিহত মারজাহানের শোকাহত মা ছালেহা বেগম বলেন, সুখের জন্য মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, সংসার চালাতে জামাইকে অটোরিকশা কিনে দিয়েছি। তারপরও মেয়ের  কপালে সুখ আসলো না। ওইদিন রাতে মেয়ের জামাই সোহাগ ফোন করে বলেছে মারজাহান বিষ খেয়েছে। পরে শুনি মারজাহান মারা গেছে। তারা (সোহাগের পরিবার) বলেছে যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন থানা পুলিশে গিয়ে লাভ কি? তারা লাশ নিয়ে পেট-মাথা কাটবে। এতে মৃত মেয়েটির গুনাহ হবে। তাই আল্লাহর দিকে তাকিয়ে মেয়েকে দাফন করে ফেলি। মারজাহানের অবুঝ তিন শিশু সন্তানের জন্য সোহাগের বাবা ৫ গন্ডা (৩০ শতাংশ) জমি দিবে। এজন্য আর কোন কথা বলিনি।

ছালেহা বেগমের পাশ থেকে তার বোন (মারজাহানের খালা) বলে উঠেন, আমার ভাগ্নিকে ওরা পিটিয়ে মেরে ফেলে। আমি দেখেছি, তার গলায় এবং বুকে রক্তাক্ত জখম ছিলো। তারা আমাদের কথা বলতে দেয়নি।

মারজাহানের মামা লিটন বলেন, কিছুদিন আগ থেকে শুনেছি পাশের বাড়ির এক মেয়ের সাথে সোহাগের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। এনিয়ে মারজাহান প্রতিবাদ করলে সোহাগ তার ওপর নির্যাতন চালাতো। ঘটনার দিনও তাকে শুনেছি মারধর করা হয়েছে।

মৃত্যুর পর মারজাহানকে গোসল দেওয়া চর করমূল্লা গ্রামের রুস্তুম পাটোয়ারীর স্ত্রী সালমা খাতুন (৮০) ও নুরুল ইসলামের স্ত্রী নুর জাহান (৫০) বলেন, মারজাহানকে গোসল করাতে গিয়ে তার গলায়, বুকে এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে জখমের দাগ দেখা গেছে। তবে সে কিভাবে মারা গেছেন, তা বলতে পারবো না।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল মান্নান বলেন, আমাকে আমাদের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল হুদা ফোনে জানিয়েছেন, খালেক মিয়ার ছেলে সোহাগের স্ত্রী বিষ খেয়ে মারা গেছে। মৃত মেয়ের বাবা-মা আসছে আপনি একটু আসেন। পরে আমি সেখানে গিয়ে দেখি মেয়ের এলাকার অভিভাবকরা আসছে। আমি তাদেরকে বলেছি এটা তো থানায় জানানো দরকার। তারা বললো আমার উভয় আছি এখানে, থানা পুলিশ করে মেয়ে মানুষ কাটা-ছিড়ার কি দরকার? আমার দাফন করে ফেলি। পরে আমি সেখান থেকে চলে আসলে তারা তাদের মতো করে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন করে ফেলে।

সুধারাম থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মুহাম্মদ ইমদাদুল হক বলেন, এ ঘটনায় নিহতের পরিবার বা আত্মীয় স্বজন কোন অভিযোগ করেনি। জানাযার নামাজ পড়ানো ইমাম তার কাছ থেকে কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ার অভিযোগ এনে একটি অভিযোগ করেছেন। এ বিষয়ে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App