×

মুক্তচিন্তা

ধূমপায়ীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩১ মে ২০২১, ১২:১৮ এএম

ধূমপায়ীদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি
১৯৮৭ সাল থেকে প্রতি বছর ৩১ মে জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এর সহযোগী সংস্থাগুলো তামাকের স্বাস্থ্যঝুঁকি তুলে ধরে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করে আসছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় : ‘ঈড়সসরঃ ঃড় ছঁরঃ’ অর্থাৎ ‘আসুন আমরা শপথ করি, জীবন বাঁচাতে তামাক ছাড়ি’। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে যত মানুষ তামাক ব্যবহার করে তার অন্তত অর্ধেক জনগণ তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশ্বের সর্বোচ্চ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। পৃথিবীর ১১০ কোটি ধূমপায়ীর শতকরা ৮০ ভাগ বাস করেন মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশে। বিপুল জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবের কারণে বিশ্বের সর্বোচ্চ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০০৯ সালে তামাকের ব্যবহার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ৩৫.৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০১৭ সালে পরিচালিত গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) তথ্যে দেখা যায়, বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার ক্রমে কমে আসছে। রিলেটিভ রিডাকশন (জবষধঃরাব জবফঁপঃরড়হ বা আপেক্ষিক হ্রাস) বিবেচনায় নিলে ৮ বছরে তামাকের ব্যবহার কমার হার ১৮.৫ শতাংশ, তামাকের ব্যবহার কমে আসার এ পরিস্থিতি ইতিবাচক। আমাদের দেহের মুখগহ্বর, স্বরযন্ত্র, জিহ্বা ও ফুসফুসের ক্যান্সারের প্রায় ৫০ ভাগের জন্যই দায়ী তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হৃদরোগের কারণে মৃত্যু ৩০ শতাংশ, ক্যান্সারে মৃত্যু ৩৮ শতাংশ, ফুসফুসে যক্ষ্মার কারণে মৃত্যু ৩৫ শতাংশ এবং অন্যান্য শ^াসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২০ শতাংশের জন্য ধূমপান দায়ী। ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স এন্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএই) ২০১৩ গবেষণা অনুসারে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে। সারা বিশ্বে সমন্বিতভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ ও তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০০৩ সালের মে মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ৫৬তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) চুক্তি অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ এই চুক্তির প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ এবং ২০০৪ সালে এ চুক্তিকে অনুসমর্থন করে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার এফসিটিসির আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এবং বর্তমান সরকার ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করে। ধূমপান মাদক সেবনের প্রবেশ পথ : তামাক সেবনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম মাদকের দিকে ধাবিত হয়ে পরিবার ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, যারা কিশোর বয়সে ধূমপানে আসক্ত হয়, তাদের অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের তুলনায় তিন গুণ বেশি, গাঁজায় (মারিজুয়ানা) আট গুণ এবং কোকেইনের ক্ষেত্রে ২২ গুণ বেশি। অর্থাৎ তামাক কেবল একটি আসক্তিই নয়, এটি তরুণদের আরো অনেক বিধ্বংসী আসক্তির পথে পরিচালিত করে। এছাড়া অল্প বয়সে তামাকের ব্যবহার শরীরের কর্মক্ষমতা এবং উদ্দীপনা কমিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ ধূমপায়ী এবং ৫০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তামাক বা ধূমপানে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি : ধূমপান করোনায় আক্রান্তের ঝুঁকি ১৪ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে তোলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বারবার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে, ধূমপায়ী বা তামাক সেবনকারীরা নানা রকম স্বাস্থ্য সমস্যাসহ জটিল ও কঠিন রোগাক্রান্ত হয়ে থাকে বিধায় কোভিড ১৯-এ বা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এবং প্রাণহানির ঝুঁকিতে শীর্ষে অবস্থান করছে। কারণ হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য বলছে সিগারেট সেবনের হাতের আঙুলগুলো ঠোঁটের সংস্পর্শে আসে এবং এর ফলে হাতে (বা সিগারেট ফিল্টারে) লেগে থাকা ভাইরাস মুখে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। এছাড়া ধূমপায়ীদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যায় ও ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি, যা কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। তদুপরি ধূমপান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায় বিধায়, সহজেই ক্ষতিকর ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এমনকি অকালমৃত্যু পর্যন্ত হয়ে থাকে। ‘দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন’-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে বলা হয়েছে, অধূমপায়ীদের তুলনায় প্রায় তিন গুণ সংখ্যক ধূমপায়ী জটিল অবস্থায় ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হয়েছেন। তাদের কৃত্রিকভাবে শ^াস-প্রশ্বাস চালাতে হয়েছে এবং এরপর তাদের বেশিরভাগই মারা গিয়েছেন। এছাড়া ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের (বিএমজে) এক গবেষণা বলছে, দিনে একটি সিগারেট খেলেও হৃদরোগের ঝুঁকি ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে ক্ষরণের ঝুঁকিও বাড়ে ৩০ শতাংশ। নারীদের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি আরো বেশি, অনেকাংশে ৫৭ শতাংশের মতো। প্রতি বছর তামাক ব্যবহারের ফলে বিশে^ ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে আরো প্রায় ১০ লাখ মানুষ, যার বড় একটি অংশ শিশু। বাংলাদেশে অকাল মৃত্যু ঘটানোর ক্ষেত্রে তামাকের অবস্থান পঞ্চম। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশে^ প্রতি বছর তামাকের কারণে মারা যাবে ১ কোটি মানুষ। ৭০ লাখেরই অকাল মৃত্যু হবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে। এই মৃত্যুর বড় অংশই হবে ফুসফুস ক্যান্সার, সিওপিডি এবং যক্ষ্মার মতো ব্যাধির দ্বারা। তামাক চাষ : তামাক চাষের কারণে দেশে খাদ্য উৎপাদনের জমি কমে যাচ্ছে। তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণে গাছ ব্যবহারের কারণে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র অভিভাবকরা যদি তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থের ৬৯ শতাংশ খাদ্যের জন্য ব্যয় করে, তবে দেশে অপুষ্টিজনিত শিশুমৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনা সম্ভব। সব তামাকপণ্যের কর ও দাম বৃদ্ধি : তামাকজনিত রোগব্যাধির চিকিৎসা ও অকাল মৃত্যুর কারণে প্রতি বছর ৩০ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু একই অর্থবছরে সরকার তামাক খাত থেকে রাজস্ব পায় অনেক কম (২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা)। অর্থাৎ সরকারের নেট ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের কর বৃদ্ধি এবং করোনা মোকাবিলায় অতিরিক্ত ৩ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হলে সরকার অতিরিক্ত ১১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব পেতে পারে। এই টাকা করোনা মহামারি মোকাবিলায় কাজে লাগানো যেতে পারে। পরিশেষে, তামাক এখন একটি মহামারি, প্রতিদিন ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ তরুণ-যুবসমাজ সিগারেটে আসক্ত হয় এবং এদের ৩ জনের মধ্যে ১ জনের ধূমপানজনিত রোগে মৃত্যু হয় (ডঐঙ)। তামাকের কারণে বিশে^ এই মৃত্যুহার, এইচআইভি (এইডস), টিবি, প্রসূতি মৃত্যু, যানবাহন দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, নরহত্যা ও ওষুধজনিত মৃত্যুর সর্বমোট সংখ্যার চেয়ে বেশি। পৃথিবীতে বছরে ৮০ লাখ লোকের মৃত্যু হয় তামাকজনিত রোগের কারণে। বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহার মৃত্যুর প্রতিরোধমূলক একমাত্র কারণ হিসেবে বিবেচিত এবং প্রতি ১০ জনে একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী। বাংলাদেশে ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনের ফলে ফুসফুস ক্যান্সার, মুখগহ্বরের ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ (সিওপিডি), ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা, হাঁপানি, বার্জাজ ডিজিজ ইত্যাদি রোগে ১২ লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়। তাই আমাদের দেশে এখনই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সেই সঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারলে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মৃত্যু ও ৩ লাখ ৮২ হাজার জনকে পঙ্গুত্ব থেকে বাঁচানো যাবে এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে বছরে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার লোকসান থেকে বাঁচানো যাবে। তামাক ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে আনার বিভিন্ন পন্থার মধ্যে অন্যতম একটি যথোপযুক্ত উপায় হলো তামাকজাত সামগ্রীর ওপর অধিক হারে কর আরোপ করা, সুতরাং সব ধরনের তামাক পণ্যের ওপর সিগারেটের সমপরিমাণ কর আরোপ করা, সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মিল রেখে তামাকের মূল্যের বার্ষিক সমন্বয় সাধন করা আজকের দিনে সবার দাবি। অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস ; সাম্মানিক উপদেষ্টা ও অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টাল সার্জারি, বারডেম হাসপাতাল। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App