×

মুক্তচিন্তা

বিদ্যমান আইনের সংশোধন প্রয়োজন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২১, ১২:১১ এএম

আমাদের দেশে হার্ট অ্যাটাক, স্টোক, ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যুর হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশ হয়ে থাকে অসংক্রামক রোগের কারণে। এসব রোগ এবং মৃত্যুর কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে তামাক সেবন। তামাক সেবনের ফলে শ্বাসনালি, ফুসফুস, কিডনি, মূত্রথলি, মুখগহ্বর, নাসারন্ধ্র, গলদেশÑ এই ধরনের অনেক অঙ্গেই ক্যান্সারের সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে মৃত্যুর হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম। বাংলাদেশে ১৫ বছর বয়সের ওপরে প্রাপ্তবয়স্কদের ৩৫ শতাংশের বেশি লোক তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্য সেবন করে। তামাক ব্যবহারজনিত নানা অসুখে প্রতি বছর ১ লাখ ২৫ হাজারের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। তামাক ও তামাক জাতীয় পণ্য থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ২৭ হাজার কোটি টাকা। তামাক ব্যবহারজনিত কারণে মৃত্যু ও অসুস্থতায় বছরে আর্থিক ক্ষতি ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। তাই জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের অন্যতম প্রধান শত্রু এই তামাক। বিশ^জুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের ছয়টির সঙ্গেই তামাক জড়িত। তামাকের এই সর্বগ্রাসী ক্ষতি প্রতিরোধে ২০০৩ সালে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ সরকার এতে অনুস্বাক্ষর করে। এই এফসিটিসি হলো জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি অনন্য দলিল। বাংলাদেশ সরকার জনস্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এফসিটিসির আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করে। ২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৫ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি এফসিটিসির সঙ্গে অনেকাংশে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও কিছু জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। আইনের সঠিক প্রয়োগ ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছু কিছু নতুন বিষয় সংযোজনসহ আইনকে সময়োপযোগী করে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ধারা ৫-এর (৩)-এ বলা আছে, তামাক কোম্পানি ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি’র (সিএসআর) অংশ হিসেবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে আর্থিক বা অন্য যে কোনোভাবে অংশ নিতে পারবে; তবে প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক, প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না। তামাক কোম্পানিগুলো সিএসআরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে তামাক চাষিদের প্রণোদনার নামে বিশুদ্ধ পানি, সোলার বিদ্যুৎ ইত্যাদি প্রদান করে তামাক চাষে উৎসাহিত করছে। আইনে তামাক কোম্পানির ‘করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা’ বা সিএসআর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। এতে তামাক চাষিরা নিরুৎসাহিত হবে এবং তামাক চাষের পরিমাণ কমে যাবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ১০-এর (১) অনুসারে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট, মোড়ক, কার্টন বা কৌটার উভয় পাশে বা মূল প্রদর্শনী তলের উপরিভাগে ৫০ শতাংশ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচিত্র সতর্কবাণী থাকতে হবে, এক্ষেত্রে প্যাকেট বা কোটার আয়তন, পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে এবং সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করতে হবে। বড় আকারের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা ব্যবহারকারীরা স্বাস্থ্যক্ষতির বিষয়ে ভাবতে বাধ্য হয় এবং তামাক ছাড়তে উৎসাহিত হয়। বিক্রয়কেন্দ্রে প্রোডাক্ট ডিসপ্লে বা পণ্য প্রদর্শনী নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আইনে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। এই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রচারণায় মুদি দোকান, স্টেশনারি ও রেস্তোরাঁগুলোকে বিনামূল্যে সিগারেটের প্যাকেটের ডিসপ্লে সংবলিত মনোরম শোকেস প্রদান করে আসছে। এ ক্ষেত্রে বিক্রয়কেন্দ্রে পণ্যের ডিসপ্লে বন্ধ করতে হবে। বর্তমান আইনে বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি সম্পর্কে কিছু উল্লেখ করা হয়নি, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। খুচরা শলাকা বিক্রি নিষিদ্ধ হলে বিড়ি-সিগারেট সহজলভ্য থাকবে না। ফলে কিশোর-তরুণ ও স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা কমবে। আইনে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ না হওয়ায় এসব পণ্য আমদানি ও বিক্রি হচ্ছে। তরুণ ও যুবক শ্রেণি ই-সিগারেটে আসক্তি হচ্ছে। তাই এসব আসক্তি তৈরিকারী ও ক্ষতিকর দ্রব্য আমদানি ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করতে হবে। আইনে তামাকের সংজ্ঞায় ই-সিগারেট অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আইনে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে লাইসেন্সিংয়ের ব্যবস্থা প্রচলন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতালের ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক পণ্যের দোকান নিষিদ্ধ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ৩০-৩১ জানুয়ারি ঢাকায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় স্পিকার্স সম্মেলনের সমাপনী ভাষণে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তামাক ব্যবহার নির্মূল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধন করারও ঘোষণা দেন। বিদ্যমান আইনের দুর্বলতাগুলো নিরসনের লক্ষ্যে এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নে আইনটিকে এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধন করা হলে তা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে, যা জনস্বাস্থ্য রক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষতিহ্রাসে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে সহায়ক হবে। মো. নাছির উদ্দিন অনিক সংবাদকর্মী ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App