×

জাতীয়

দৈনিক ১০ লাখ টাকা জমা হতো বাবুনগরীর কাছে, হিসেব নেই

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২১, ০৮:০১ পিএম

কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কমান্ড সেন্টার হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের হাটহাজারী। সেখানকার আল-জামিয়াতুল আহ্লিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা থেকেই হেফাজত তাদের অধিকাংশ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। সংগঠনটির মূল দুর্গ হিসেবে চিহ্নিত এই জায়গায় চলে অলিখিত অর্থের লেনদেনও। হাটহাজারী মাদ্রাসা সূত্রে জানা যায়, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আমির নির্বাচিত হওয়ার আগে এবং পরে তার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাক্ষাত করতে প্রতিদিন ১০০ থেকে ২০০ শুভাকাঙ্ক্ষী আসতেন। তারা এক থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হাদিয়া দিতেন। ফলে দৈনিক ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা পড়ত বাবুনগরীর কাছে। অথচ এসব টাকার কোনো লিখিত হিসাব থাকতো না বলে জানা গেছে।

হেফাজতের সঙ্গে যুক্ত শফীপন্থী হাটহাজারী মাদ্রাসার এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী যখন হেফাজতের আমির নির্বাচিত হন, তখন সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হেফাজতের শুভাকাঙ্ক্ষীরা আসতেন। সেটা সংখ্যায় ১০০ থেকে ২০০ হবে। তারা আলাপ-আলোচনা শেষে বিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার সময় হুজুরের হাতে হাদিয়া দিয়ে যেতেন, আমরা দেখেছি। কিন্তু সেটার কোনো হিসাব লেখা হতো না। অথচ এসব টাকা কিন্তু হেফাজতকে ভালোবেসে সংগঠনের ফান্ডে জমা দিতেন শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তিনি (বাবুনগরী) মহাসচিবের দায়িত্বে থাকার সময়ও একইভাবে শুভাকাঙ্ক্ষীরা আসতেন। তবে সেটা এতো বেশি ছিল না। কিছুটা কম ছিল। কী পরিমাণ টাকা দিতেন শুভাকাক্সিক্ষরা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা আমি নির্দিষ্ট করে বলতো পারবো না। তবে কমপক্ষে এক হাজার থেকে শুরু করে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

কোটি টাকা আত্মসাৎ বাবুনগরীর : রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতের অবস্থান কর্মসূচি উপলক্ষে নানা উৎস থেকে অর্থ সহায়তা পায় সংগঠনটি। বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকাও সে সময় অন্তত ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। সেই অর্থের অন্তত এক কোটি টাকার হিসাব দিতে পারেননি জুনায়েদ বাবুনগরী। পুরো টাকাই তিনি আত্মসাৎ করেছেন বলে সংগঠনটির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ও প্রধান নিরীক্ষক (অডিটর) মাওলানা সলিমউল্লাহর একটি ভিডিওবার্তায় নিশ্চিত হওয়া যায়। চলতি বছরের শুরুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর সংগঠনটির আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে।

জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে গত ৭ বছর ধরে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আর্থিক সহায়তার কোনো হিসাব-ই নেই। সংগঠনটির প্রয়াত আমির আল্লামা আহমদ শফী অন্তত ৫ বার কমিটি গঠন করেও সংগঠনের কোনো হিসাব বের করতে পারেননি। বারবার তৎকালীন মহাসচিব (পরবর্তীতে আমির) জুনায়েদ বাবুনগরী কৌশলে কমিটিগুলো ভেঙে দিতেন বলে অভিযোগ করে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে অডিটর সলিমুল্লাহ (বাবুনগরীকে ইঙ্গিত করে) তথ্যপ্রমাণসহ চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেছেন, বাবুনগরী চিকিৎসা বাবদ ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন, চিকিৎসা বাবদ ২০ লাখ টাকার হিসাব এখন পর্যন্ত দিয়েছেন? আহমদ শফী যে ২৫ লাখ টাকা ক্যাশ দিয়েছিলেন (বাবুনগরীকে)। এই ক্যাশ কোনো খাতে জমা হয়েছে কি না? তিনি সব টাকা হজম করে ফেলেছেন। এই অডিটরের দাবি, চিকিৎসা ব্যয় ছাড়াও বিভিন্ন সময় সংগঠন থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়েছেন জুনায়েদ বাবুনগরী। সংগঠনের তৎকালীন মহাসচিব হিসেবেও অনেকে তার কাছে টাকা দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে এসব টাকার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। ২০১৬ থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত হেফাজতের প্রধান নিরীক্ষক ছিলেন মাওলানা সলিমউল্লাহ। তবে জুনায়েদ বাবুনগরীর কাছ থেকে অর্থের হিসাব চাওয়া এবং এ বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করায় তাকে শেষ পর্যন্ত প্রধান নিরীক্ষকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। বর্তমানে হেফাজতের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই ফটিকছড়ির নাজিরহাট আল জামিয়াতুল ফারুকীয়া মাদ্রাসার মুহতামিম (মহাপরিচালক) মাওলানা সলিমউল্লাহ।

গত সপ্তাহে গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর প্রেস সচিব ও খাদেম ইনামুল হাসান ফারুকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দৈনিক লেনদেনসহ আর্থিক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে জানা গেছে। সংগঠনের আয়-ব্যয় সংক্রান্ত অনেক প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেও বিলুপ্ত কমিটির মহাসচিব নুরুল ইসলাম জিহাদীর তত্ত্বাবধানে টাকা লেনদেন করা হতো বলে রিমান্ডে স্বীকার করেন তিনি। এ বিষয়ে সংগঠনটির আরেক সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মাঈনুদ্দিন রুহীও অভিযোগ করেন, তৎকালীন আমির আল্লামা আহমদ শফীকে এড়িয়ে পরবর্তীতে কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছিলেন তারা ব্ল্যাংক চেকের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরোধিতা করে নেওয়া কর্মসূচি ঘিরে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে এখন পর্যন্ত সারাদেশে ১৫৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এজাহারভুক্ত মোট আসামির সংখ্যা তিন হাজার ২৭০। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি ৮০ হাজারের বেশি। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত সংগঠনটির অর্ধশতাধিক শীর্ষ নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় দেড় হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া এখনো গ্রেপ্তারের তালিকায় রয়েছেন সংগঠনটির শীর্ষ ১৪ নেতা, যারা তাণ্ডবের ঘটনার পরপরই গা-ঢাকা দেন। এসব ঘটনার মধ্যে হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে সংগঠনের তহবিল, বিভিন্ন মাদরাসা, এতিমখানা ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানের অর্থ এবং ধর্মীয় কাজে দেশে আগত বৈদেশিক সহায়তা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে।

ইতোমধ্যে হেফাজতের অর্থের জোগানদাতা হিসেবে ৩১৩ জনকে (দাতা) চিহ্নিত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এছাড়া সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের ব্যাংক হিসাবে ছয় কোটি টাকার অস্তিত্ব পেয়েছে ডিবি। যার প্রেক্ষিতে গত ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, নূর হুসাইন কাসেমী, মামুনুল হকসহ ৫৪ নেতার ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের তথ্য যাচাই-বাছাই করে গরমিল পায়। সংগঠনটির কয়েকজন শীর্ষ নেতা দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন এবং অবৈধ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ করেছেন বলে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন দুদকে পাঠানো হয়। সেই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে ইতিমধ্যে দুদক এসব নেতার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। তারই অংশ হিসেবে গত ২৭ মে এসব নেতার তথ্য চেয়ে সব ব্যাংক, এনবিআর ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরসহ সরকারি-বেসরকারি ১১টি প্রতিষ্ঠানে চিঠি পাঠায় সংস্থাটি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App