×

মুক্তচিন্তা

বর্তমান নিয়ে দুর্ভাবনা ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২১, ১২:১৫ এএম

আশা এবং আশঙ্কা জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। আশঙ্কাকে ব্যর্থ বা পরাজিত করে আশা নিয়েই মানুষ বাঁচে, বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। জীবন থাকলে জীবনযুদ্ধও থাকবেই। করোনাকালে মানুষের জীবনে নানা উটকো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অর্থনৈতিক সমস্যা বা আয়-রোজগারের সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নানা শারীরিক-মানসিক সমস্যা। যার খাওয়াপরার সমস্যা নেই, তিনি বাইরে বেরুতে না পেরে, মানুষের সঙ্গে মিশতে না পেরে, একাকিত্বের যন্ত্রণায় অবসাদে ভুগছেন। নিজে বেঁচে থাকলেও নিকটজনের, পরিচিতজনের, খ্যাতিমান মানুষের মৃত্যু সংবাদ শুনে বিষণ্নতা বাড়ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে গিয়ে জীবনকে মনে হচ্ছে যাতনাময়। ব্যক্তিগতভাবে করোনাকালে আমার নিজের বড় সমস্যা, ঘুম হচ্ছে না। না রাতে, না দিনে। রাতে বিছানায় গিয়ে বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজলেই মনে হয় এক গভীর অন্ধকার গহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছি। চোখ খুলি। না, অতলে কই, খাটেই তো আছে শরীর। মন বিক্ষুব্ধ হয়। উঠে দাঁড়াই। ঘরে পায়চারি করি। বারান্দায় গিয়ে চোখ রাখি আকাশে, সামনের ভবনে এবং নিচের জনহীন রাস্তায়। আকাশে চাঁদ দিব্যি জোছনা বিলাচ্ছে, সামনের ভবনগুলোও আলোহীন নয়। নিচের রাস্তা সুনসান নীরবতায় মোড়া কিন্তু আঁধারে ঢাকা নয়। তার মানে সব কিছু অন্ধকার নয়, আলো আছে, কাছেও, দূরেও। তাহলে আমি কেন ঘুমুতে পারি না? আমি কি মৃত্যু ভয়ে ভীত? করোনার করাল থাবা অথবা খাবারের অভাবে মৃত্যুচিন্তা কি আমাকে বিহ্বল করেছে? আমি কি দুর্ভাবনায় কাতর হয়ে মরার আগেই মরে আছি? না। মৃত্যু ভয় আমার নেই। আমি নিশ্চিত জানি মৃত্যু আমার হবেই। আজ অথবা কাল। অথবা আরো কয়েকটি দিন পর। তবে আমি একটু অন্য রকম মৃত্যু চাই। সুখের মৃত্যু, আনন্দের মৃত্যু। কাউকে কষ্ট না দিয়ে, নিজে কষ্ট না পেয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে জমাটি আড্ডায় বসে অথবা রাতের ঘুমের ঘোরে। জানি না, আমার মৃত্যু এমন হবে কিনা। আমার কোনো ইচ্ছাই পূরণ হয় না। মৃত্যু-বাসনাও কী আমার মতো করে পূরণ হবে? দুর্যোগ-দুর্বিপাকে পৃথিবীতে মানুষের মৃত্যু আগেও অনেক হয়েছে। শত বছর আগেই তো মরণব্যাধিতে ৫ কোটি মানুষের জীবন গেছে। তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল দেড়শ কোটি। দেড়শ কোটি মানুষ ৫ কোটি মানুষ হারানোর বেদনা-কষ্ট সহ্য করতে পেরেছে। এখন পৃথিবীতে সাড়ে ৭০০ কোটি মানুষের বাস। হিসাব মতো ২৫ কোটি মানুষের মৃত্যুশোক বহন করার ক্ষমতা মানব জাতির থাকার কথা! না, করোনা ভাইরাস যতই বেপরোয়া, লাগামহীন হোক না কেন, ২৫ কোটি মানুষের জীবন হরণের ক্ষমতা তার হবে না। এই অদৃশ্য অসীম শক্তিধর মানবশত্রুকে বোধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে। দেশে দেশে করোনাবধের কৌশল-হাতিয়ার খোঁজা চলছে। এর মধ্যে সাফল্যও পাওয়া গেছে। করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার হয়েছে। কয়েকটি দেশে টিকার প্রয়োগও চলছে। সুফলও মিলছে। বাংলাদেশও করোনার টিকা পেয়েছে। অপর্যাপ্ত টিকা নিয়ে উদ্বেগ আছে। আছে বেশি টিকা সংগ্রহের চেষ্টাও। হাতিয়ার আবিষ্কারে মানুষের জুড়ি নেই। অবশ্য প্রাণ রক্ষার চেয়ে প্রাণ কেড়ে নেয়ার হাতিয়ার উদ্ভাবনে মানুষ বেশি পারঙ্গম। জীবন রক্ষার গুরুত্ব যদি দুনিয়াকে করতলে রাখার খায়েশি শাসককুলের থাকত, তাহলে আজ এমন বেসামাল অবস্থা হতো না। টাইটানিক জাহাজ যখন ডোবে তখন তাতে যাত্রী সংখ্যার চেয়ে লাইফজ্যাকেটের সংখ্যা কম ছিল। এখন আমার ভাবনাজুড়ে আছে যে, আমি না থাকলেও এই পৃথিবী থাকবে, থাকবে মানুষ। সূর্য উঠবে। রাতের আকাশে থাকবে তারার মেলা। প্রশ্ন হলো, কেমন হবে আগামী পৃথিবী? কেমন হবে ভবিষ্যতের মানুষেরা? আগামীর পৃথিবী কী সব মানবশিশু, সব মানুষের বাসযোগ্য হবে? ভবিষ্যতের মানুষেরা কী হবে আরো বেশি উদার, মানবিক, কুসংস্কারমুক্ত এবং বিজ্ঞান মনস্ক? আগামীর পৃথিবীটা যে অধিকতর বাসযোগ্য হবে তার কিছু নমুনা-লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করেছিল। কলকারখানা, গাড়িঘোড়া, মানুষের চলাচল বন্ধ বা সীমিত হওয়ায় পরিবেশের দূষণমাত্রা কমে যাচ্ছিল। হিমবাহের বরফগলা কমার খবরও আমরা শুনেছি। আকাশ নীল দেখা যাচ্ছে। সাগর তীরে ডলফিনের আনাগোনা বাড়ছে। সমুদ্রের পানির স্বচ্ছতা দৃশ্যমান। পরিষ্কার আকাশে চক্কর দিচ্ছে চিল, হায় চিল সোনালি ডানার চিল। এ রকম আরো কিছু দিন চললে, কয়েক মাস চললে ধরিত্রী প্রাণ খুলে শ্বাস নিতে পারবে। মানুষের শ্বাসযন্ত্র বিকল করছে করোনা আর ধরণীর বুক হচ্ছে স্বচ্ছতায় প্রসারিত। ধোঁয়াহীন বাতাসে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের প্রবাহ এভাবে অব্যাহত থাকলে আগামীর পৃথিবী নতুন তো হবেই। কিন্তু না। এমন অবস্থা তো স্থায়ী হওয়ার নয়। যান ও জীবনের চলাচল যেমন স্বাভাবিক হবে, তেমনি কলকারখানাও সচল হবে, বা এর মধ্যে হয়েছেও। সাময়িক বিরতিকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক ভাবা যায় না। আমরা মানুষেরা কী অনাচারটাই না করেছি পৃথিবীর ওপর। পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে দিয়েছি কয়েকশ প্রজাতির জীব। আমাদের শৌখিনতা ও দুর্বুদ্ধিতার কারণে বলি হয়েছে কত নিরীহ প্রাণী। আমাদের কৃতকর্মের জন্য হারিয়ে যেতে বসেছে শকুন, যাকে কিনা বলা হয় প্রকৃতির ‘ঝাড়ুদার’। আমরা এখন কান পাতলে শুনতে পাই না কোকিলের কুহুরব, দোয়েলের শিস, লক্ষ্মীপেঁচার ডাক, চোখ মেললে দেখি না চড়ুই-শালিকের নাচানাচি। করোনার ভয়ে আজ আমরা যখন ঘরবন্দি, তখন পশু-পাখিরা মুক্ত। ওদের এই মুক্তজীবন দীর্ঘায়িত হলে আগামীর পৃথিবী আরো রূপময়, বর্ণময় এবং সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা হয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু মানুষ তো ঘরবন্দি থাকবে না, থাকতে পারে না। তখন প্রকৃতি ও পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার পরিকল্পনা কি আছে? অথবা পরিকল্পনা থাকলে তা বাস্তবায়ন বা কার্যকর করার সদিচ্ছা কি সবার আছে? কেমন হতে পারে ভবিষ্যতের মানুষ? সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। একবার মনে হয়, ভবিষ্যতের মানুষ হবে, মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। আবার মনে হয়Ñ না, ভবিষ্যতের মানুষ আরো বেশি অমানুষ হবে। বেপরোয়া হবে, স্বার্থপর হবে। মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর, কুচুটে, বিদ্বেষপরায়ণ, সংকীর্ণ এবং একচোখা, একরোখা। উদারতা, মানবিকতা শিখতে হয়। মানুষের জন্ম হয় নগ্নভাবে। মানুষ ক্রমাগত পরিচর্যায় এবং শিক্ষায় হয়ে ওঠে মার্জিত, পরিপাটি। করোনার মতো মহামারি মোকাবিলা করে মানুষ কী ভালো মানুষ হয়ে উঠবে? অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষের মধ্যে মানবিকতা, উদারতা, সহমর্মিতা বাড়বে নাকি মানুষ আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে উঠবে দেখার বিষয় সেটি। দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা কিন্তু মানুষের হৃদয়বৃত্তি, চিত্তবৃত্তিকে সেভাবে পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেনি। জনস্বাস্থ্য ও জনকল্যাণের চেয়ে মারণাস্ত্র উৎপাদনেই কিন্তু ব্যয় হয়েছে বেশি অর্থ। সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে। অসাম্য ও অন্যায্যতা বেড়েছে। অন্যের ‘হক’ কেড়ে নেয়ার দুরভিসন্ধি বেড়েছে। শিক্ষার প্রসার হয়েছে কিন্তু ধর্মান্ধতা কমেনি। উদারতার বিস্তার না হয়ে হিংসার প্রসার ঘটেছে। এই অবস্থায় বলা মুশকিল যে, ভবিষ্যতের মানুষ আসলে কেমন হবে। তবে আমার মনে হয়, কোন ধরনের বা কেমন প্রকৃতির মানুষ শেষ পর্যন্ত বেশি সংখ্যায় বেঁচে থাকবেন, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভর কবরে ভবিষ্যতের মানুষ কেমন হবে। যাদের মধ্যে স্বার্থপরতা সীমাহীন, যারা নিজের ছাড়া অন্যের ভালো চায় না, যারা উগ্র তারাই যদি বেঁচে থাকেন, তাহলে এটা বলা যাবে না যে, ভবিষ্যতের মানুষ সবুজ ঘাসের গালিচা বিছিয়ে নতুন সূর্যোদয়কে ‘এসো এসো’ বলে স্বাগত জানাতে পারবে। তারপরও আমার আশা : মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। আজ না হোক, কাল করোনা পরাজিত হবে। বিজ্ঞান সফল হবে। আজ যা যা বেঠিক, আগামীর পৃথিবীতে তার সব না হলেও অনেক কিছু ঠিক হয়ে যাবে। ভালো থাকুন সবাই। সব মানুষের মঙ্গল হোক। বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App